Tuesday, 31 August 2021

দশটা সুঁই পাঁচ ট্যাকা!


---দশটা সুঁই পাঁচ ট্যাকা

দশটা সুঁই পাঁচ ট্যাকা, পাঁচ ট্যাকা ....... দূর থেকে একটা জীর্ণ, ক্লান্ত স্বর ধীরে ধীরে উত্তমের কানে স্পষ্ট হতে থাকে, কানে লো ভলিউমে বাজতে থাকা অঞ্জনের "একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে" ছাড়িয়ে তীব্র হতে থাকে কন্ঠের আকুতি। সকাল সকাল নিউ-ব্যারাকপুর রেল স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে আছে উত্তম। আজ ট্রেন লেট করেছে, অফিসে যেতে দেরি হবে সেই বিরক্তিকে ছাপিয়ে, এমন কন্ঠের প্রতি আকৃষ্ট হওয়াটাও তাকে বিরক্তই করছে বৈকি। আজকাল সাহায্য চাওয়ার ধরন দেখে মানুষ কে বিশ্বাস করা খুব কঠিন। আচ্ছা এই ভদ্রলোক তো সাহায্য চাইছেন না, তিনি তো সুঁচ বিক্রির প্রচার করছেন।

ততক্ষণে উত্তমের মনে পড়লো, সে এখনো ঠিকমতো লোকটিকে দেখেইনি। মাথা ঘুরে তাকাতেই উত্তমের চোখে পড়লো, বৃদ্ধ এক ব্যাক্তি। বয়সের ভারে নুয়ে গেছেন পুরো, ধনুকের মতো বাঁকা শরীরটাকে ধরে রেখেছেন ডান হাতে থাকা একটা লাঠিতে ভর করে। সে লাঠিতে ছোট ছোট শাখার মতো ডাল বাঁধা, তাতে ঝুলছে বিভিন্ন সাইজের কাইতন(সুঁচে সুতো পরানোর মেশিন), তাবিজ, কড়ি, ছোট নেল কাটার সহ বিভিন্ন পণ্য। বাঁ হাতে একটা পকেট নোট বুক টাইপের কিছু একটা, যার মধ্যে কিছু খুচরো পাঁচ/দশ/কুড়ি টাকার নোট আর ছোট ছোট কাগজ ভাজে ভাজে যাতে সুঁচ গেঁথে রাখা। প্রতি কাগজে দশটা করে সুঁচ।

'দশটা সুই পাঁচ ট্যাকা,পাঁচ ট্যাকা......' ভদ্রলোক ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন। কেউ ডাকলে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে পণ্য হাতে তুলে দিয়ে টাকাটা বা হাতের নোট বুকের ভাজে পুরে রাখছেন, আর প্রয়োজনে বাকি টাকা ফেরত দিচ্ছেন। এ সময়টাতে হাতের লাঠিটাকে ডান হাতের কনুইয়ের ভাজে এক সুনিপুণ কৌশলে আটকে রাখছেন। পৃথিবীতে কেউ খুচরো টাকাকে এমন মমতায় হাতে তুলতে পারে, এই ভদ্রলোককে না দেখলে হয়তো উত্তমের জানাই হতোনা।

এখন উত্তমের অস্থিরতা কেটে গেছে, কেমন শান্ত একটা অনুভুতি কাজ করছে ভেতর ভেতর। কানে বাজছে পল সাইমনের "সাউন্ড অব সাইলেন্স" অরিজিনালটা না, ডিস্টার্বড এর কভারটা। উত্তমের ভীষণ কাছের এই ভার্শানটা, বিশেষ করে ডেভিড ড্রাইম্যানের ব্যারিটোন ভয়েসের সাথে কিবোর্ডিস্ট ভ্যান ডোনেগানের কম্বিনেশনে গানটা মনে হয় অন্য মাত্রা পেয়েছে! আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, এই গানটার কিবোর্ড পিসে উত্তমের মাঝে মাঝেই মনে হয় বুঝি যতিন-ললিতের সুরে কেয়ামত সে কেয়ামত তক সিনেমার "অ্যায় মেরে হমসফর " গানটি শুরু হয়ে যাবে। আচ্ছা সাউন্ড অব সাইলেন্স কে তো নৈশব্দের শব্দ বলা যায় তাইনা?

ভদ্রলোক উত্তমকে অতিক্রম করে বা দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। হঠাৎ একজন বোরখা পরিহিতা ভদ্রমহিলা বয়স হয়তো চল্লিশোর্ধ্ব হবে "জয়দেব কাকা" বলে এগিয়ে আসেন। ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে যান। ভদ্রমহিলা তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, "কাকা আপনি এখানে কি ব্যাপার? কাকিমার খবর কি? আপনি এটা কী ব্যাচেন?" ভদ্রলোক কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর চোখে নোনা জল জমাট বাঁধতে শুরু করেছে, তিনি শুধু ভাঙা গলায় বলেন " আমার সব লেইক্ষা লইয়া, আমগোরে বাইর কইরা দিসে" বলেই তিনি ধিরে ধিরে হাঁটতে শুরু করেন। আর ডাক তোলেন, দশটা সুঁই পাঁচ ট্যাকা,পাঁচ ট্যাকা...... এবারের সুরটায় খুব মায়ায় ভরা।

ভদ্রমহিলা জয়দেব কাকার পিছু পিছু হাঁটতে থাকেন, তাদের কথা চলমান কিন্তু উত্তমের শ্রবণসীমায় তার কিছুই পৌঁছায় না। উত্তমের এখন অস্থির লাগা শুরু হয়েছে, জয়দেব কাকার সব কিছু লিখে নিয়ে কে তাঁকে বের করে দিয়েছে? জানবার তো উপায় নেই। এমন অবস্থায় সিগারেট খুব কাজে দেয়। উত্তম বসবার জায়গা ছেড়ে ফুটওভার ব্রিজের গোড়ায় এসে সিগারেট জ্বালায়। এ জায়গাটায় দুটো মাঝারি ধরনের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, আর একটা চায়ের দোকান। এ যায়গাটাকে স্টেশনের অলিখিত স্মোকিং জোন বলা যায়। পাবলিক প্লেসে নন স্মোকারদের মাঝে দাঁড়িয়ে উত্তমের সিগারেট খেতে ইতস্তত বোধ হয় খুব। কিন্তু এ শহরে স্মোকিং জোন কোথায়? তাই এই অলিখিত স্মোকিং জোন ফর্মুলা।

সিগারেট শেষ হতে হতেই, এনাউন্সমেন্ট হয় যে শিয়ালদা যাওয়ার গাড়ি ২ নম্বর লাইনে প্রবেশ করবে। উত্তমও প্রস্তুত হতে থাকে। ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে থামতেই উত্তম দেখে তার সামনের বগিটা মোটামুটি খালিই। সামনে দু’চারজন মহিলা আর গোটা দশেক পুরুষ যাত্রী। তাই তাড়াহুড়ো না করে আস্তে ধীরে ট্রেনে উঠে বগীর শেষদিকে যেতেই চোখে পড়ে সেই ভদ্রমহিলা বসে আছেন, তাঁর পাশের সিটটা ফাঁকা। উত্তম বেশি কিছু চিন্তা না করেই পাশে বসে পড়ে।

ট্রেন চলতে শুরু করলেই উত্তম ভেবে চিন্তে ভদ্রমহিলাকে আঞ্চলিক সুরে জিজ্ঞেস করে ওঠে "আপা, জয়দেব কাকার ঘটনাডা কী? আপনে তাঁরে চিনেন? আমি আফনেগো কতা শুনছি। আমারে কওন যায়?" ভদ্রমহিলা তখন বলা শুরু করলেন। ৭১এর সময়, যখন ওপারে সব গোলমাল চলছে, তিনি তখন খুব ছোট ছিলেন, তখন তাঁর বাবা-মা সহ ওনারা জয়দেব কাকার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। দুর্গানগর রেল স্টেশনের পূর্ব দিকে ছিলো জয়দেব কাকার নিজস্ব বাড়ি। সামনে ছিলো একটা বড় আকৃতির মুদি দোকান। আর তাঁরা ছাড়াও ছিলো আরো তিনটা ভাড়াটিয়া পরিবার। জয়দেব কাকা এবং তাঁর স্ত্রীর আচরণের কারনে তাঁরা সবাই ছিলেন পরিবারের মতো। কাকার ছিলো ছোট একটা ছেলে, যাকে ভীষণ ভালবাসতেন তাঁরা সবাই। ভদ্রমহিলার বাবার চাকরির সুবাদে তাঁরা বহুদিন আগেই কামারহাটি চলে যাওয়ায় আর যোগাযোগ থাকেনা তাদের মাঝে।

আজ তিনি কাকার কাছে শুনলেন, সেই ছোট ছেলেটি এখন অনেক বড়, বিয়ে করেছে সংসার হয়েছে। স্ত্রীর সাথে বাবা-মায়ের বনিবনা না হওয়ায় কায়দা করে সমস্ত সম্পত্তি নিজের নামে লিখে নিয়ে, সে সব বিক্রি করে ছেলে এখন বউ নিয়ে চলে গেছে। আর কাকা এবং কাকি থাকেন এক বস্তিতে। দিনে যতটুকু উপার্জন করতে পারেন তাই দিয়ে চলে তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত জীবন চাকা। ঘটনা বলতে বলতে ভদ্রমহিলার কন্ঠ ভারি হয়ে আসে। তিনি বলেন "জানেন ভাই আমারো একটাই পোলা" বলেই চোখ মুছতে থাকেন তিনি। দমদম স্টেশন চলে আসে, ভদ্রমহিলা নেমে যান। উত্তমের ও এখানেই নামবার কথা, কিন্তু মন চাইছে না।

ট্রেন চলতে শুরু করেছে- উত্তম সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। কানে বাজছে, অ্যান্ড্রু কিশোরের গাওয়া "ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে..."। গানের মাঝে হঠাৎ সেই স্বর দশটা সুঁই পাঁচ ট্যাকা, পাঁচ ট্যাকা ....... উত্তম চট করে এদিক ওদিক খুঁজে দেখে বগিতে অল্প কিছু মানুষ যার যার মতো ব্যস্ত।

উত্তম আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে। কানে বাজতে থাকে-
"ও আমি কত জনে কত কি দিলাম,
যাইবার কালে একজনারও দেখা না পাইলাম।
আমার সঙ্গের সাথী কেউ হলো না,
আমার সঙ্গের সাথী কেউ হলো না রে,
রইবো না আর বেশী দিন তোদের মাঝারে"
এবং দশটা সুই পাঁচ ট্যাকা, পাঁচ ট্যাকা .......

-©উshaস চttopaধ্যায়~----- 

No comments:

Post a Comment