Sunday, 1 August 2021

মোটকু বন্ধু (হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ ডে)


 ---মোটকু বন্ধু:-


আমাদের মোটকু। ক্লাস এইটের বি সেকশন। আমরা তো তাকে সেই মোটকু নামেই ডাকি, ভালো নাম সৌনক পাল। মোটকু আমাদের স্কুলের ফুটবল টিমের গোল কিপার। ভোলানন্দ হাই স্কুলের সাথে ফাইনাল ম্যাচ। সেই ম্যাচে মোটকু পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিল। মোটকুর জন্য জিতে গেলাম আমরা। ম্যাচ শেষে আমরা সবাই মোটকু কে কাঁধে নিয়ে মিছিল করলাম। লম্বু বান্টি, খুশি হয়ে তার ক্যাসিও ঘড়ি টা মোটকুর হাতে পরিয়ে দিয়ে বলল, এই ঘড়ি তোর কাছে তিন দিন রাখিস। আমি খুশি হয়ে রাখতে দিলাম।

মোটকু খুশি হয়ে বান্টি কে জড়িয়ে ধরল। মোটকুর খুব শখ ছিল এই ঘড়ি পরার।

আমরা তাকে মোটকু নামেই ডাকি, সে রাগও করে না। মোটকু, মোটকু এবং মোটকু।

স্কুলের পিকনিকে মুরগি, ডিম, আর খাসি রান্না হলো। ইমন খাসির মাংস টা মোটকুর প্লেটে দিয়ে বলল, আমি এতো খেতে পারব না। তুই খা।

শৌর্য তার ডিমটা দিয়ে দিল মোটকুর প্লেটে। মোটকু খুশি হয়ে সব খাচ্ছে। বেশ আয়েশ করে খাচ্ছে। আমরা সবাই দেখছি আর হাসছি। মোটকুও হাসে। মোটকু হাসলে তার মুখের ভেতর ডিমের হলুদ কুসুম দেখা যায়।

আমরা তাকে মোটকু নামে ডাকি। সত্যি সত্যি আমরা তাকে মোটকু নামে ডাকি। আমাদের কোনো আয়োজন মোটকু ছাড়া অসম্ভব ! মোটকু থাকতেই হবে। সেই মোটকুর একদিন জ্বর হলো। খুব জ্বর। একদিন, দুই দিন, তিন দিন। মোটকু তো স্কুলে আসে না। খবর আসল মোটকুর বেশ খারাপ জ্বর হয়েছে।

খবর শুনে আমাদের ভীষণ মন খারাপ। নিজেদের জমানো টাকা থেকে সবাই চাঁদা দিয়ে আধ কেজি আঙ্গুর কেনা হলো। সেই আঙ্গুর নিয়ে আমরা পনের জন দল বেঁধে গেলাম মোটকুর বাড়িতে। বাড়িতে ঢুকতেই মোটকুর বাবার সাথে দেখা, বলে কি ব্যাপার! অয়ন সামাল দিয়ে বলল, আমরা মোটকুর কাছে এসেছি। মোটকু আমাদের বন্ধু।

মোটকুর বাবা একটা হাসি দিয়ে বলল, যাও ভেতরে যাও।

আমরা তো তাকে মোটকু নামেই চিনি। ও আমাদের মোটকু। মোটকু কে এমন করে শুয়ে থাকতে দেখে আমাদের খুব কষ্ট হলো। মনিশ লুকিয়ে কাঁদল। ক্লাসে মনিশ মোটকুর পাশেই বসে।

হ্যাঁ আমরা তাকে মোটকু নামে ডাকি।

আমাদের মোটকু ডাক শুনে সে এতটুকু কষ্ট পেত না কারণ মোটকু জানত আমরা তাকে কতটা ভালোবাসি। আমাদের যে কোনো আয়োজনে মোটকু কে সবার আগে ডাকি । মোটকু ছাড়া আয়োজন অসম্ভব। আমাদের খেলাধুলা, আড্ডা, লুকিয়ে সিনেমা দেখা, কোথাও ঘুরতে যাওয়া সব কিছুতে মোটকু কে আমরা সবার আগে রাখতাম। আমরা এমন করে ভালোবাসতাম বলেই মোটকু কখনো আমাদের উপর অভিমান করে থাকতে পারত না।

ঠিক এতো বছর পর এসে কেন জানিনা এই মোটকুর কথা খুব মনে পড়ছে। অনেকদিন দেখা হয় না। অনেক দিন। এবার বাড়ি গেলে মোটকু কে জড়িয়ে ধরে রাখব অনেকক্ষণ। যেমন করে জড়িয়ে ধরেছিলাম ভোলানন্দ হাই স্কুলের সাথে ম্যাচ জেতার পর।

আমি জানি না নিজের ভেতর এমন করে এতো অস্থিরতা কেমন করে জমা হচ্ছে। কিছু ঘটনা, কিছু নির্মমতা, কিছু দৃশ্য দেখে আমার ভেতর পুষে রাখা গল্প গুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে।

মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার বন্ধন টা যখন শক্ত হয়ে পড়ে তখন অন্য সব ম্লান হয়ে যায়। আমাদের ক্লাস এইটের সৌনক পাল মানে মোটকুর প্রতি আমাদের ভালোবাসা, মায়া এবং বন্ধুত্ব টা এতো বেশি দৃঢ় ছিল যে তাকে মজা করে ডাকা মোটকু নামটা খুব স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল সবার কাছে। মোটকুর কাছেও।

আরে আমাদের ক্লাসে শুধু মোটকু না। ছিল কালা রবি, চিকনা কৌশিক, লম্বু বান্টি, বাইট্যা সোমনাথ সহ অনেকে, আমার নাম ছিল, 'ম্যাও', সে আবার পরে বলা যাবে একদিন ক্ষন। আমরা সত্যি সত্যি এই নামেই বন্ধুদের ডাকতাম। তারা কখনো রাগ করত না। রাগ করত না কারণ আমরা সবাই ছিলাম বন্ধু। আমরা বন্ধুরা সবাই জানতাম একজন আরেকজন কে কেমন ভালোবাসি। ভালোবাসি বলেই আমাদের সম্পর্কের মধ্যে নামের চেয়ে টান টা বেশি বড় হয়ে উঠেছিল।

অথচ সমসাময়িক কিছু নির্মমতা নিজের সেই সময়গুলো কে একটা দ্বিধায় ফেলে দিচ্ছে।

প্রযুক্তির সহজলভ্যতা, গেমসে আসক্তি, এ প্লাস বা আরো বেটার নম্বর প্রাপ্তির প্রতিযোগিতা এই সবকিছু কেমন করে যেন স্কুলের বন্ধু-বান্ধব দের সম্পর্ক গুলোকে খুব ঠুনকো করে দিয়েছে। সারাদিন লেখাপড়া আর প্রযুক্তি নির্ভর এটা সেটা নিয়ে সময় কাটাতে কাটাতে ছেলেমেয়েদের খুব কাছের বন্ধু হয়ে ওঠার মানুষ যেন খুঁজে পাওয়া কঠিন। এখন বন্ধুত্বের চেয়ে প্রতিযোগিতা বেশি। সেই প্রতিযোগিতায় লম্বু, মোটকু, চিকনা কেউ কারো বন্ধু হয়ে উঠে না। হয়ে ওঠে শত্রু। লম্বু বলে যে বন্ধুটা জড়িয়ে ধরতে পারে না, সেই বন্ধুর লম্বু ডাক অবশ্যই বিষাদ লাগে, লাগা উচিতও। আপন যে মানুষ হতে পারে না, সেই মানুষ কখনও এমন করে ডাকার অধিকার পেতে পারে না।

প্রতিযোগিতা আমাদের বন্ধুত্বের চেয়ে শত্রু হতে শেখাচ্ছে বেশি। এই প্রতিযোগিতা কারণে সময়ের অভাবে আমাদের একসাথে খেলাধুলা, ঘোরাঘুরি, আড্ডা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। দুরে সরিয়ে নিয়েছে মানবিক গুণাবলী, নৈতিকতা এবং মমত্ব বোধ...



-©উshaস চttopaধ্যায়~-----

No comments:

Post a Comment