Tuesday, 10 August 2021

প্রায় এগারো বছর পর!


--- প্রায় এগারো বছর পর


বিথীর জন্য একটা শাড়ি কিনেছি। খয়েরি পাড় দেওয়া বেগুনী রঙের একটা সুতির শাড়ি। ঠিক এগারো বছর পর বোধহয় আমি বিথীর জন্য শাড়ি কিনলাম। না না, শুধু শাড়ি না। আমার মনে হয় এই এগারো বছরে আমি বিথীর জন্য কিছুই কিনিনি। সত্যিইতো, হ্যাঁ সত্যিই, আমি এই এগারো বছরে বিথীর জন্য একটা জিনিসও কিনিনি। শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, গয়না, কসমেটিক্স কিছুইতো কিনিনি।

আমার ছেলে আর্যর বয়স এগারো আর মেয়ে শাওনের ছয়। বিয়েটা আমাদের নিজেদের পছন্দেই করা। পরিবারের সম্মতিও ছিলো। প্রায় তের বছর আগের বিয়ে। বিয়ের পর প্রায় বছর দুয়েক আমিই কেনাকাটা করতাম। মাঝে মাঝে বিথী আমার সাথে গিয়ে কিনতো। তখন অল্প মাইনের চাকরি। একটা বাজেট নিয়ে সবকিছু কেনাকাটা করি। বিথীর তখন থেকেই তাঁতের শাড়ি বেশ পছন্দ। সেই সময় খরচ কমাতে অফিস শেষ করে আমি চলে যেতাম দেশপ্রিয় পার্কে। অল্প টাকায় বেশ ভালো ভালো শাড়ি পাওয়া যেত সেখানে। মাঝে মাঝে আমার সাথে বিথী গেলেও বেশির ভাগ শাড়ি বা সালোয়ার কামিজ আমি নিজে কিনতাম। বিথীই বলতো, আমার পছন্দই তার পছন্দ।

কেনাকাটা যেহেতু আমিই করি তাই বিথীর কিছু লাগলে আমাকে বলতো। আমি চাঁদনী চক, এসপ্ল্যানেড, নিউ মার্কেট ঘুরে এটা-সেটা কিনে আনতাম। চেষ্টা করতাম অল্প খরচের মধ্যে ভালো জিনিস কিনতে। সেই জিনিস পেয়ে বিথী কি যে খুশি হতো। মাঝে মাঝে শনিবার আমি আর বিথী একসাথে গিয়ে এটা সেটা কিনে অনেক রাতে বাড়িতে ফিরতাম। এই কেনাকাটার ওছিলায় আমাদের একটু ঘোরাঘুরিও হতো।

আমার ছেলে আর্য জন্মের পর চাকরিটা পাল্টালাম। ভালো একটা চাকরি পেলাম। চাকরির পাশাপাশি আস্তে আস্তে টুকটাক ব্যবসাপাতি শুরু করলাম। দিন দিন আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। কেনাকাটাগুলোকে আমি কেমন করে জানি দিন দিন এড়িয়ে যাচ্ছি। চাইলেও সংসারের অনেককিছুতে আমার আর সময় দেওয়া হচ্ছে না। বিথীও বিষয়টা খুব স্বাভাবিকভাবে নিল। আমি চাকরি করছি, ব্যবসাপাতি করছি। দিনদিন আর্থিক উন্নতি হচ্ছে, সংসারের উন্নতি হচ্ছে। এই কারণে সংসারের আমার অনেক কাজ বিথী নিজের কাঁধে নিয়েছে। এই নিয়ে বিথীরও কোন অভিযোগ নেই। বিথী খুব ভালো করেই দেখছে আমি দিনদিন কতটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। মাঝে মাঝে বিথী ইচ্ছে করেই সংসারের অনেক ঝামেলার কাজ আমাকে না জানিয়ে সমাধান করছে। সংসার, ছেলেমেয়েদের স্কুল, লেখাপড়া, আত্নীয় স্বজনদের দেওয়া-নেওয়ার সব বিষয়গুলোতে বিথী একটু একটু করে জড়িয়ে গেল। এমন হয়েছে, যে আমার জামা কাপড়ও দেখি বিথী কেনাকাটা করছে। সংসারের কাজ নিয়ে বিথী বেশ ব্যস্ত। আমি কী করলাম, কী কিনলাম এসব নিয়ে তার তেমন কোন অভিযোগ নেই। এতগুলো বছর এভাবে চলে গেল।

শাড়ির প্যাকেটা নিয়ে আমি হাঁটছি। আমি ইচ্ছে করেই আজ হেঁটে বাড়ি ফিরছি। শাড়িটা কেনার পর থেকে আমার ভেতর ভীষণ একটা ভালো লাগা কাজ করছে। এই ভালোলাগাটা এগারো বছর আগে আমি প্রায়ই পেতাম। একটা শাড়ি, জামা বা কিছু একটা কিনে কি এক আগ্রহ আর উদগ্রীবতা নিয়ে বাড়ি ফিরতাম তা আজ খুব মনে পড়ছে। মনে মনে ভাবতাম এই জিনিস কি বিথী পছন্দ করবে? বিথী কি খুশি হবে? আরো কত কত চিন্তা মাথায় নিয়ে বাড়িতে ফিরতাম।

যখন দেখতাম বিথীর খুব পছন্দ হয়েছে তখন কি যে ভালো লাগতো। সেই সুখ বা অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না। অথচ আমি এই এগারো বছর বিথীর জন্য একটা জিনিসও কিনিনি। আচ্ছা এই এগারো বছরে বিথী কি এই সুখগুলো ভুলে গেল। বিথীর কি একটিবারও অভিমান হয়নি? একটিবার আমার কাছ থেকে একটা শাড়ি, একটা জামা বা একটা উপহার আশা করেনি? প্রতীক্ষায় থাকেনি সে?

আমি ভাবছি আর বাড়ির দিকে হাঁটছি। আমি জানি এখন আমাদের আর্থিক কোন অভাব নেই। চাইলেই অনেককিছু কেনা যায়। পাওয়া যায়। তাই বলে আমরা আমাদের সেই সুখ ভুলে গেলাম!

শাড়িটা নিয়ে বাড়ি ঢুকলাম রাত দশটায়। অন্যদিন হয়তো আরো রাত করে বাড়িতে ফেরা হয়। আজ একটু তাড়াতাড়ি। শাড়ির প্যাকেট বিথী খেয়াল করেনি। প্রত্যেক দিনইতো কাগজ পত্রের কত প্যাকেট নিয়ে বাড়িতে ঢুকি। এই নিয়ে বিথীর কোন আগ্রহ দেখায় ও না, থাকেও না। শোবার ঘরে এক কোণায় প্যাকেটটা রেখে দিলাম। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করেছি। ছেলে মেয়েরাও ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি আর বিথী নিজেদের রুমে এটা ওটা নিয়ে গল্প করছি।

সত্যি, হ্যাঁ সত্যি আমার কেন জানিনা লজ্জা লাগছে বিথীকে শাড়ির প্যাকেটটা দিতে। এই লজ্জা আমাকে ভয়ানক শংকা আর অপরাধবোধের মাঝে ফেলে দিল। যে আমি, একটা সময় একটি কানের দুল কিনে উদগ্রীব থাকতাম কখন বাড়ি ফিরে বিথীর হাতে দেবো, কখন বিথীর খুশি খুশি মুখটা দেখবো, এখন সেই আমি কিনা লজ্জা বা দ্বিধায় ইতস্ততঃ বোধ করছি!

শেষ পর্যন্ত বিথীর হাতে আমি প্যাকেটটা দিলাম। বিথী খুব অবাক হয়ে শাড়ির প্যাকেটটা আমার হাত থেকে নিয়েছে। প্যাকেট খুলে শাড়িটার দিকে কতক্ষণ সে তাকিয়ে ছিলো আমি জানিনা, তবে অনেকক্ষণ।

বিথীর চোখ দুটি জলেতে টলমল করছে। একসময় আমার দিক থেকে মুখটা ঘুরিয়ে নিল। আমি বুঝলাম বিথী কাঁদছে। আমি বিথীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বিথী আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইলো। আমি বিথীকে শক্ত করে ধরে আছি। হঠাৎ বিথী হাউমাউ করে বাচ্চাদের মত কেঁদে উঠলো। হ্যাঁ, বিথী হাউমাউ করে কাঁদছে। এমন করে বিথীকে আমি কখনো কাঁদতে দেখিনি। না কোন অভিযোগ করে বিথী কাঁদছে না। বিথী কাঁদছে স্বল্প দামের সামান্য একটা শাড়ি বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে। কী এক মমতা আর ভালোবাসা নিয়ে বুকের কাছে জড়িয়ে রেখেছে শাড়িটা। আমি ইচ্ছে করেই জানতে চাইলাম কী হয়েছে বিথী?

বিথী কান্নার মধ্যেও হাসতে হাসতে বললো, কিছু না।

বিথীর যে শাড়ি, গয়না বা অন্যান্য জিনিস কম আছে তা কিন্তু না। এখন অনেককিছুই বেশি বেশি আছে। আলমারি ভর্তি করা জামা কাপড়। থরে থরে সাজানো আলমারি। সেই আলমারির একটা জায়গায় পরম মমতা আর যত্ন নিয়ে এগারো বছর আগের শাড়িগুলোও আছে। আমি জানিনা বিথীর কতটা আবেগ বা মমতা এখানে লুকিয়ে আছে।

বিথী আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে এখনো। আমি বুঝতে পারি। বুঝতে পারি বলেই অনেকক্ষণ চুপ করে থাকি। আমাদের এতদিনের সংসারে একটু-আধটু মান অভিমান ছিলো না যে তা নয় কিন্তু সংসারে অশান্তি, অবিশ্বাস বা কঠিন কোন সময় আমরা নিজেদের নিয়ে পার করিনি। তারপরও কেমন করে, কি করে, সময়ের প্রয়োজনে আমরা কিছু সুখ আর সময় থেকে সরে গিয়েছি। আমি ভাবছি আর খুব খুব অবাক হচ্ছি।

বিথী দুচোখ ভরা জল নিয়ে হাসতে হাসতে বললো, জানো আমি এত সুখ বোধহয় অনেকদিন পাইনি। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি আমার জন্য কিছু একটা আনতে পারো, শুধু আমার জন্য আলাদা করে কিছু কিনতে পারো। আমার ভীষণ মনে পড়ে গেল আমাদের সেই দিনগুলির কথা। জীবনের প্রয়োজনে আমরা দিন দিন কতটা পাল্টে নিয়েছি।

বিথীর সাথে আমিও হাসছি। বুকের ভেতর পাহাড়সম কষ্ট নিয়ে হাসছি। প্রিয় মানুষগুলো চাইলেই নিজেদের কত চাওয়া পাওয়ার সুখগুলো সহজে এড়িয়ে যায়। এটা ভীষণ অন্যায়। হয়তো প্রিয় মানুষ বলে, আস্থার মানুষ বলে, নির্ভরতার মানুষ বলে আমরা নিজেদের বঞ্চিত করি, তাদের বঞ্চিত করি। নিজেদের সুখগুলোকে অবহেলা করি। এটা যে ভীষণ অন্যায়। অজস্র ব্যস্ততা, জীবন সংগ্রাম আর টানাপোড়নের মাঝেও কিছু প্রিয় মানুষের সুখ যত্ন করে রাখাটা ভীষণ জরুরী...


-©উshaস চttopaধ্যায়~-----

No comments:

Post a Comment