Thursday, 9 September 2021
বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় হতাশার সময়!
বিংশ শতাব্দীতে, আগের শতকে শান্তি কি অসম্ভব ছিল?
#প্রথম_এপিসোড #১ম_অধ্যায় #বিশ্ব_পরিস্থিতি
দুটি পনেরো বছরের মধ্যে বিশ্বযুদ্ধ বিংশ শতাব্দীর হৃদয় কে একেবারে জীর্ণ করে তোলে, এককথায় ধ্বংসের দিকে নিয়ে ফেলে! এই ইতিহাসের যাত্রার সূত্রেই এবং এই যাত্রার কেন্দ্রে একটি যুদ্ধ থেকে আরেকটি যুদ্ধের মাঝে বিশ্বব্যাপী মানুষের চাওয়া, পাওয়া, হতাশা ও ভয়ংকর দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি এবং তার সামনে উঠে আসা নায়কদের নিয়ে একটি গল্প আপনাদের সামনে তুলে ধরছি সিরিজ রুপে! ভালো লাগলে পাশে থাকবেন আর না লাগলে এড়িয়ে যাবেন 🙏🏼
আপনি যদি ১৯২০ সালের দিকে একটু ফিরে তাকান, আপনি মনে করতে পারেন যে সেসময় কিছু ভাল নেতাও ছিলেন, যেমন ফ্রান্সে (Lebrun)লেব্রুন ছিলেন, জার্মানিতে (Strazimon)স্ট্রাজিমন ছিলেন ইত্যাদি। আপনি হয়তো জানেন বা নাও জানতে পারেন যে ইউরোপের স্বাভাবিকতায় ফিরে আসার একটা সম্ভাবনা ছিল এবং আপনি যদি সেই দিকে তাকান যে দৃশ্যপটের থেকে সেই সমস্ত লোকেরা কিভাবে হারিয়েও গেলেন, আপনি কিছু বুঝতেই পারবেন না! শুধু তাই নয় এবং দেখবেন যে প্রকৃত ক্ষমতায় কে কে আছেন যখন একটি বাস্তব এবং আসল সংকট বিশ্বকে আঘাত করে। এই সময়ের মধ্যে একটি দুর্দান্ত বিষণ্নতা সমগ্র মানবজাতির জন্য এসে পড়ে এবং এটি বেশ কয়েকটি দেশকে খুব কঠিনভাবে আঘাত করে। প্রকৃতপক্ষে, আমার কথাগুলো উড়িয়ে দিতে পারেন, তবু বলে রাখা ভালো যে প্রতিটি কথা আমার নিজের মনোভাবের হলেও যা কিনা সমর্থিত অধ্যাপক (Prof. Margaret Macmillan) মার্গারেট ম্যাকমিলানের দ্বারা, যিনি টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ইতিহাসের অধ্যাপক। তা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৩২ সালে বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন যা একেবারে তলানিতে নেমে আসে এটা সবারই জানা। উৎপাদন ২৫ শতাংশ কমে গিয়েছিল, বিনিয়োগ ৫০ শতাংশ, দাম বা মুনাফা ১০ শতাংশ। এই সময় একটাই জিনিসের বৃদ্ধি হয়, তা হল কেবল বেকারত্ব, যা ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছিল। ১৯২৯ সালে আমেরিকান কর্পোরেশনগুলি ১০ বিলিয়ন ডলার মুনাফা বুক বা রেজিস্টার করেছিল, এবং ১৯৩২ সালে এটি ৩ বিলিয়ন ডলার লোকসান করেছিল।
"আমাদের সমগ্র ব্যাংকিং ব্যবস্থা", প্রাক্তন ট্রেজারি সেক্রেটারি (Mcadoo)ম্যাকাদু ঘোষনা করেন, "একটি সংগ্রহ কে কৃতিত্ব বা মর্যাদা দেয়, যা হল একটি বোকার স্বর্গে!"
এক্সেটার ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক (Prof. Richard Overy)রিচার্ড ওভারির মতে, উন্নত রাজ্যে ৪০ মিলিয়ন মানুষ বেকার, লাখ লাখ মানুষ অভুক্ত, বেশির ভাগ পরিস্থিতিতে বিশ্ব বাণিজ্য অর্ধেকেরও কম হয়ে যায়। সেই সময়কালে, আপনি আজকের দিনে কল্পনাও করতে পারবেন না যা ঘটেছে এবং এর পরিণতি ছিল গভীর দারিদ্র্যতা, সর্বত্র শক্তিশালী সামাজিক বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি, পুঁজিবাদের একটি শক্তিশালী অনুভূতি যা কাজ করে নি এবং সম্ভবত কমিউনিজম যা কিনা হটাৎ করে ডানা মেলে বেরিয়ে আসবে বলে আশঙ্কা বাড়ছিল। হঠাৎ করে এই সব জিনিস পশ্চিম বিশ্বকে হুমকি দেওয়া শুরু করে..।
এটি কেবলমাত্র শিল্পের জন্য হতাশাগ্রস্ত অবস্থা ছিল না, এটি ছিল দুর্দান্ত বা চরম হতাশা এবং এটি সবারই জন্য ছিল। ১৫০০০০ আমেরিকান বাড়ির মালিকরা ১৯৩০ সালে তাদের সম্পত্তি হারিয়েছে, ২০০০০০ জনে ৩১ সালে এবং ২৫০০০০ জনে ৩২ সালে।
১৯২৯ সালে আমেরিকান অর্থনীতিতে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা ছিল প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলার, যা কিনা ১৯৩২ সালের মধ্যে সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছিল মাত্র এক তৃতীয়াংশে এবং মনে করা হয়েছিল যে এমন কিছুই নেই মানে কোনো সিস্টেম যা কেউ সঠিকভাবে বিশ্বাস করতে পারে। জুলাইয়ের শেষের দিকে সেই পরিস্থিতি যতটা ভয়ঙ্কর ভাবা যেতে পারে ততটাই কম, অ্যানাকোস্টিয়া ফ্ল্যাটের সংঘাতে, (Hoover)হুভারের রাষ্ট্রপতি পদের মৃত্যুর জন্য যেন গড়ে উঠেছিল, যখন তিনি বেশ কয়েকটি ব্যাটেলিয়নের সেনা পাঠিয়েছিলেন, কাদের বিরুদ্ধে? না, যারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের হাজার হাজার অভিজ্ঞ সৈন্য, তাদের ওয়াশিংটনে একত্রিত হওয়ার থেকে হটাতে, যুদ্ধ পরিষেবার নামে বোনাসের অর্থ তাড়াতাড়ি প্রদানের দাবিতে, যা তাদের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল। এটা অন্যায় যুদ্ধ, ১৮৬৫ সাল থেকে ওয়াশিংটনে যুদ্ধরত সৈন্যদের সর্বাধিক ঘনত্ব ঘটেছিল তত্কালীন। তাদের কর্তৃপক্ষকে মানে অ্যানাকোস্টিয়া ফ্ল্যাটে বিক্ষোভকারীদের, তাদের ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড থেকে বিপথে চালাতে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয় ঘোড়ার পিঠে চড়ে, ট্যাঙ্কের সাহায্যে, টিয়ার গ্যাসের আশ্রয়ে। তাদের আশ্রয়স্থল জ্বালানো হয়, যার জন্য হুভারকে সম্পূর্ণ রুপে দায়ী করা হয় না, এই বাড়াবাড়ির জন্য নিন্দা করা হয়েছিল সেই ঘটনার কমান্ডারের, যিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে মাঝখান থেকে বহুচর্চিত জাতীয় নায়ক হয়েছিলেন, তার নাম ছিলো (Douglas Macarthur)ডগলাস ম্যাকার্থার। এই সময়ে একটি খুব বিখ্যাত চলচ্চিত্র ছিল যার নাম 'আই অ্যাম এ ফিউজিটিভ ফ্রম আ চেইন গ্যাং' মানে একটি চেইন গ্যাং থেকে একজন পলাতক - যেখানে নায়ক হিসাবে যে অভিনয় করেছেন, দেখানো হয়েছে যে তিনি আমেরিকান স্বপ্নকে সরাসরি অনুসরণ করেছিলেন, কিন্তু আমেরিকান রাষ্ট্র দ্বারা সে প্রবর্তিত, বঞ্চিত এবং বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছে তার সাথে, সে প্রতিটি সুযোগ হারিয়েছে ঘুরে দাঁড়ানোর এবং শেষে তার বান্ধবীর কাছে যখন ফিরে আসে এবং সে তাকে খুব সংক্ষিপ্তভাবে আলিঙ্গনে বলে 'তুমি এক বছর আগে পালিয়ে গেছিলে, কেন তুমি যোগাযোগ করোনি'। উত্তরে সে বলে 'আমি পারি নি, তারা আমাকে অনুসরণ করেছে, তারা সবখানেই আছে, সর্বত্র' এবং মেয়েটি বলে, 'তুমি কি থাকবে?' উত্তরে ছেলেটি বলে 'না, আমি থাকতে পারব না, আমাকে যেতে হবে'। 'কিন্তু তুমি কিভাবে থাকো, জীবন অতিবাহিত করো কিভাবে? তুমি কেমন আছো .. তুমি কি খাবে'? এবং সে বলে, 'আমি চুরি করি... আমি চুরি করি এবং সেই লাইনটি ফিসফিস করে বলে, আমি চুরি করি .. এটা .. সে সময় ভীষণ জনপ্রিয়, মেলোড্রামাটিক এবং আইকনিক একটা মুভি, ওদের ব্যাপার-ই আলাদা, ওটা হলিউড বলে কথা!
যাই হোক, বাস্তবে ফিরি! যেহেতু ১৯৩২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোট গণনা করা হয়েছিল, সেই সময়ে গ্রামীণ আমেরিকা একটি হতাশাজনক অবস্থার মধ্যে যাচ্ছিল, তখন গবাদি পশু মারা যাচ্ছে হাজারে হাজারে, মানুষ ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা থেকে বীতশ্রদ্ধ। একটি সত্যিকারের প্লেগ একটি দেশের বিভাগের একসময়ের সমৃদ্ধ খামার যা ভালো ফলাফল করেছে, তাকেও জর্জরিত করেছে। এরূপ সময়ে, "আমাদের মধ্যে একটি বিপ্লব হবে, ১২ মাসেরও কম সময়ে, প্রতিটি গ্রামাঞ্চলে" রক্ষণশীল সংযুক্ত খামার বা কনসারভেটিভ ফার্ম ব্যুরো ফেডারেশনের (Ward Ed O'Neal)ওয়ার্ড এড ও'নিল বলেন, তিনি গণতান্ত্রিক মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নিউইয়র্কের গভর্নর পদে নির্বাচিত হন। ১৯৩২ সালের রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের ক্যাম্পেনের জন্য তার কমন কথা যেটা পরবর্তী সময়ে চর্চার বিষয় ছিল বা আছে, তা হল,'হ্যাপি ডেজ আর হেয়ার এগেইন' মানে সুখের দিন আবার এখানে, মানে পাতি কথায় 'আচ্ছে দিন'। সেই সময় এক ব্যক্তি উঠে এসেছিলেন, তার নাম ছিল (Franklin Delano Roosevelt)ফ্রাঙ্কলিন ডেলানো রুজভেল্ট। তিনি ১৮৬৪ সালে আব্রাহাম লিঙ্কনের বিজয়ের পর থেকে একতরফা নির্বাচনে বর্তমান প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে দিয়েছিলেন, একেবার প্রকৃত ভূমিধসের মতো। তিনি স্বভাবতই একজন পরীক্ষক, একজন বাস্তববাদী ছিলেন, মানে তার কথার ধরনই ছিল যে, 'আসুন চেষ্টা করি', 'দেখা যাক কিছু কাজ না করলে আমরা অন্য কি কাজ করতে পারি', 'নিরুৎসাহিত হবেন না, আমরা অন্য কিছু চেষ্টা করবো'... ইত্যাদি ইত্যাদি। যে আশাবাদ, উৎফুল্লতা, সহানুভূতি, পরীক্ষামূলকতা এবং প্রজাতান্ত্রিক আমেরিকানদের প্রতি সুগভীর বিশ্বাস জাগিয়ে তুলেছিলেন যা তিনি কখনো হারাননি এবং যা তাকে রাজনৈতিকভাবে অপরিহার্য এক ব্যক্তি বানায়।
এইসময়ে একদা অর্থনৈতিক ভাবে সর্বশক্তিমান (Al Capone)আল ক্যাপোন কর ফাঁকির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন, কম উত্তেজিত মেজাজের আলফনসো ক্যাপোনের চেয়ে বড় কিছু এই সময়ে আসে না যা ১৯৩২এর সালে শূন্যতা থেকে উঠে আসা একটি ছোট খাটো একজন বাউন্সার (স্কারফেস) মুখে কাটা দাগ সমেত আলফনসো, নিয়ন্ত্রণের উচ্চ শিখরে উঠে এসেছে এবং একটি অপরাধমূলক সিন্ডিকেটের যা বছরে একশ মিলিয়ন ডলার আয় করে, সেটির পরিচালনায় ব্যস্ত। আটলান্টা, জর্জিয়া রাজ্যের পেনিটেন্টিয়ারিতে তাঁর পরিচয়পত্রে নিম্নলিখিত বিবরণ রেকর্ড করে;
• শাস্তি শুরু হয় ৪ঠা মে ১৯৩২,
• জন্ম তারিখ ১৭ই জানুয়ারি ১৮৯৯,
• পেশা জুয়াড়ি এবং তার মুখের তিনটি দাগ, স্কারফেসের সাবধানে ও সুবিস্তৃত বর্ণনা আছে।
এবার আসি ব্রিটেনের কথায়, ব্রিটেনে রাজনৈতিকভাবে ও ব্যক্তিগতভাবে বিচ্ছিন্ন রাজনীতিবিদ (Oswald Moseley)ওসওয়াল্ড মোসলে ১৯৩২ সালে একটি ফ্যাসিবাদী দল গঠন করেছিলেন। তিনি রোম ঘুরে আসার পর তার অবিকল নকল করতে যাচ্ছিলেন এবং মুসোলিনি তাকে যা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাই তিনি অনুকরণ করেছিলেন। কালো শার্টের ইউনিফর্ম যার জন্য অনুসারীরা অর্থ প্রদান করেছিলেন, পাঁচটি শিলিং প্রতিটি শক্ত বাহু, অনেকটা হাত খাড়া করে স্যালুট করা, ইত্যাদি। ইটালি তার আন্দোলনের তহবিল পাঠানোর জন্য যে পরিমাণ অর্থ পাঠাচ্ছিল তার জন্য এটির হিসাব ঠিক করা ছিল, পুনরায় তার কথায় ফিরব।
ভক্তদের কাছে প্রশংসার বিশ্বের রাজধানী ছিল, শুধু ছিল কেনো, এখনো আছে সোভিয়েত রাশিয়ায়, যেখানে কেবল মানবতার দিগন্ত ছাড়িয়ে ছিল স্ট্যালিনের অর্কেস্ট্রেটেড উচ্চতা, হয়তো একটু বেশীই বললাম, তবু স্যাটায়ার রুপে হলেও চালিয়ে নেবেন। ১৯৩২ সালে যখন (Pravda)প্রভদা, যা ছিল অফিসিয়ালি পার্টির সংবাদপত্র, তার পাঠকদের একটি বিস্ময়কর আবিষ্কারের কথা বলেছিল। এটিতে প্রকাশিত সমস্ত নিবন্ধ (Lenin)লেনিনের নামের অধীনে যা লেখা হত, তা সম্প্রতি শেখা যাচ্ছিল যে কমরেড (Stalin)স্ট্যালিন দ্বারা নাম লুকিয়ে লেখা হয়েছে, যাকে বলে 'ঘোস্ট রাইটিং'। আপনাকে মিথ্যা কথা বলতে হত, পার্টির স্লোগানগুলি পুনরাবৃত্তি করতে হত, অন্যথায় এমন মনোভাব ছিল যে স্ট্যালিন আপনাকে হত্যা করবে। রাশিয়ান ম্যাক্সিমের মতে আপনি একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মতো মিথ্যা বলতে বাধ্য ছিলেন। স্ট্যালিনের ভাবমূর্তি সর্বত্র ছিল এবং সাম্যবাদ আর রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না, এটি একটি ধর্মে বা আচারে রূপান্তরিত হয়েছিল। এবং এতদ্বারা উত্পাদিত সবচেয়ে বেছে নেওয়া সুগন্ধি, যা কিনা ছিল সরকারি সুগন্ধি, সেই সুগন্ধি কে বলা হত 'ব্রেথ অফ স্ট্যালিন বা স্ট্যালিনের নিঃশ্বাস'। প্রপোগান্ডাই ছিল সব বা এর কি যে বিশাল এক প্রয়োজন, রাশিয়াতে এই সাক্ষ্য ১৯৩০ -এর দশকের মানুষ যে শ্বাস-প্রশ্বাস নিত তার থেকেই আপনি দেখতে পেতেন।
(ক্রমশ)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment