Tuesday, 24 August 2021
প্রিয়া ...
---প্রিয়া
প্রিয়া। হ্যাঁ, প্রিয়া আমার স্ত্রী। এক ঘন্টা পঁচিশ মিনিট আগে মারা গিয়েছে। আমার সাথে একটি কথা না বলেই মরে গেল। আমাকে একটি বার বলে দিয়ে গেল না এই ফুটফুটে সুন্দর এতটুকু একটা মেয়েকে আমি কেমন করে সামলে রাখব।
আমি গিয়েছিলাম শান্তি বাজারে। প্রিয়ার জন্যই যেতে হলো। প্রিয়া বলে রেখেছিল, মেয়ে হওয়ার খবর শুনলেই তুমি মার্কেট থেকে আমার মেয়ের জন্য গোলাপি রঙের খুব সুন্দর একটা জামা কিনে নিয়ে আসবে। ওখানে ছোট ছোট বাচ্চার খুব সুন্দর সুন্দর জামা পাওয়া যায়। আমার গোলাপি রঙ পছন্দ। প্রথমেই আমি এই গোলাপি জামা পরা একটা পরীর মতো সুন্দর মেয়ে দেখতে চাই। আমি দেখতে চাই, তুমি হাসি হাসি মুখ করে আমার গোলাপি মেয়েটাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো।
আমি জামা নিয়ে আসলাম বিয়াল্লিশ মিনিটের মধ্যে। বি এন বোস মহকুমা হাসপাতাল থেকে চিড়িয়ামোড়ের শান্তি বাজার বিয়াল্লিশ মিনিট খুব কম সময়। আমি বিয়াল্লিশ মিনিটের মধ্যে গেলাম আর আসলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে গেলাম। লোকজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দুপুরবেলা তপ্ত রোদে একটা মানুষ দৌড়াচ্ছে, পাগল টাগল নাকি, ভর দুপুরে বেলা রাস্তায় দৌড়াচ্ছে। কলকাতা শহরে তবু মানা যায়, কিন্তু শহরতলি তে এই দৃশ্য বেশ বেমানান। তারপরও আমি দৌড়ে গেলাম চিড়িয়ামোড়। জামাটা নিয়ে এসে শুনি প্রিয়া মারা গেছে, সাথে পেটের বাচ্চা টা ও!
আমি এখনো মেয়েটাকে দেখতে যাই নি। আমার সবকিছু কেমন উল্টো-পাল্টা লাগছে। মনে হচ্ছে আমি একটা টিভির সামনে বসে আছি। বসে বসে সিনেমা দেখছি। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় থাকতেই ছুটির দিন দুপুরবেলা খুব সিনেমা দেখতাম। বাংলা, হিন্দি, তেলেগু, ইংরেজি সব ভাষার! সিনেমার করুণ দৃশ্যগুলোতে আমি অনেকবার কেঁদেছি। মাঝে মাঝে হাউমাউ করে কাঁদতাম। কিন্তু আজ আমার একটুও কান্না পাচ্ছে না। হাসপাতালের লোকজনগুলো কী করুণভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে তারা বাংলা সিনেমার করুণ কোনো দৃশ্য দেখছে।
না, এটা সিনেমা হচ্ছে না। ডাক্তার এসে আমাকে প্রিয়ার মৃত্যু নিয়ে বিস্তারিত বললেন। প্রিয়ার প্রেগনেন্সিটা একটু জটিল ছিল এটা ঠিক, কিন্তু শেষে এসে এমনটা হবে তা আমি কল্পনাও করিনি। এই সেই প্রিয়া, যে আমায় সাহস জুগিয়েছে, আফগানিস্তান থেকে একরত্তি একটা মেয়েকে নিয়ে আসার! সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও সে হাল ছাড়েনি, যেকোনো উপায়ে তার ঐ শিশুটিকে চাই-ই চাই! সে যে এইভাবে আমার সঙ্গ ছেড়ে দেবে, তা আমি ভাবিনি!
আমি তখন আফগানিস্তানে ফরেন ডিপার্টমেন্ট কর্মরত, দেশে তালিবানি শাসকরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, মার্কিন সেনাদের সদ্য প্রস্থানে। দেশে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়, সবাই বাঁচতে চায়, আমারও মাথার মধ্যে একইরকম অবস্থা। এমতাবস্থায় খবর ছড়িয়ে পড়ে যে কোনো এক মা-বাবা, নিজেদের ঐটুকু সন্তান কে ছেড়ে, বিমানে করে পালিয়েছে! এসেছিল সেও তার মা-বাবার সাথে পালাবে বলে, কিন্তু পারেনি। বাবারা না হয় অতটা জড়ায় না, কিন্তু মা টাই বা কি?
যাই হোক, প্রিয়ার ঐকান্তিক ইচ্ছায় শিশুটিকে আমাদের সাথে ছাড়তে রাজি হল সে দেশের আইনী ব্যবস্থা, যথেষ্ট কাগজ পত্তরের মাধ্যমে, এবং আমার সরকারি জানাশোনা, সুযোগ সুবিধার কারণে একটু হলেও সুবিধা যে হয়নি তা নয়! তবু, বহু চেষ্টার ফলে আমাদের মিতু আমাদের কোলে এসেছিল! প্রিয়া হয় তো বা বুঝতে পেরেছিল যে তার যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছিল, তাই হয়তো এতটা উঠেপড়ে লেগেছিল সে ঐ বাচ্চাটিকে আঁকড়ে ধরতে। দেশে ফিরতে না ফিরতেই হসপিটালে আসতে হল ওর কমপ্লিকেশনের জন্য, আর তার সাথে সেই ছোট্ট একরত্তি শিশুটিকেও। হসপিটালের তরফ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিল, আর জানালো যে শিশুটিকে আমরা এনেছি, সে মোটামুটি সুস্থ, খালি নজর দিতে হবে কোনোরকম আতঙ্কের পরিবেশ থেকে তাকে যত দুরে রাখা যেতে পারে!
যখন আমার মেয়েটাকে কোলে দিল তখন আমি ঠিক বুঝতে পারলাম। হ্যাঁ, আমি কোন সিনেমা দেখছি না। আস্তে আস্তে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার হচ্ছে। আমার পালিয়ে যেতে খুব ইচ্ছে করছে। হাসপাতাল থেকে দুরে কোথাও পালিয়ে যাই। আমি বার বার ইচ্ছে করেই ভাবতে চেষ্টা করছি আমার কেউ নেই। প্রিয়া নামের কোন মানুষকে আমি চিনি না। আমি একা। আমি একা ছিলাম। আমি একা ছিলাম। আমি বার বার সবকিছু ভুলে যেতে চেষ্টা করছি।
ফুটফুটে পরীর মত মেয়েটা আমার দিকে চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে। মেয়েটার দিকে তাকালেই আমার কান্না আসছে। ভীষণ কান্না। এই মেয়েকে নিয়ে আমি কী করব? আমি কোথায় যাব? আমি ভয়ে কাঁদি না। নিজের ভেতর সব কান্না চেপে রাখি। আমার মনে হচ্ছে আমি কাঁদলে এই মেয়েটা তার খুব ছোট্ট চোখ দুটি দিয়ে আমার কান্না দেখে ফেলবে।
দুই বছর আগে এপ্রিল মাসের পনেরো তারিখে প্রিয়ার সাথে আমার বিয়ে হয়। পরিবারের পছন্দেই বিয়ে। বিয়ের পর পরই নিরাকে আফগানিস্তানে নিয়ে যাই। বেশ ভালই চলছিল আমাদের সংসার। সেখানে আমার আর প্রিয়ার আত্নীয় স্বজন বলতে কেউই নেই। প্রিয়ার এক মামা থাকেন ইরানে, তেলের খনিতে সিস্টেম ইন্জিনিয়ার। আমার চোদ্দ গুষ্টির কেউ সেখানে থাকেন না। আফগানিস্তানে শুক্রবার ছুটি, তাই শুক্রবার বন্ধের দিন আমি আর প্রিয়া নিজের মত করে ঘুরি। বেশির ভাগই ঐ শিশু পার্কে। কেনো জানি না, প্রিয়া শিশুপার্কে যেতেই বেশি ভালোবাসতো। তার নাকি বাচ্চাদের দৌড়াদৌড়ি দেখতে বেশ ভালো লাগতো। আমার আর কী করার। প্রিয়ার পছন্দেই শিশু পার্কে গিয়ে বসে থাকি। এই রাইড সেই রাইডের পাশে গিয়ে প্রিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের খেলা দেখতো। মাঝে মাঝে-তো বেশ অস্থির হয়ে পড়ত ও। আমাকে বলে দেখেছো দেখেছো বাচ্চাটা কেমন করে দাঁড়িয়ে আছে। ও পড়ে যাবে তো, পড়ে গিয়ে ব্যথা পাবে।
প্রিয়ার কান্ড দেখে আমি হাসতাম। হাসতে হাসতে বলতাম। ধুর, তুমি এত চিন্তা কর না। পাশে বাচ্চাটার মা দাঁড়িয়ে আছে, উনি শক্ত করে ধরে আছেন।
মুসুর ডালের পিঁয়াজি আমার খুব পছন্দের। অফিস থেকে ফেরার পর প্রিয়া প্রত্যেকটা দিনই আমার জন্য এই মুসুর ডালের পিঁয়াজি ভাজতো। মুসুর ডাল শিল-নোড়াতে পিষতে হয়, মিক্সিতে পেস্ট করলে তার হতো না। একসাথে বেশ কিছু ডাল শিল-নোড়ায় পিষে ফ্রিজে রাখতো। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমি অফিস থেকে ফিরলে পিঁয়াজি ভাজা হত। মাঝে মাঝে বেগুনীও ভাজত প্রিয়া। বেগুনী ও বেশ স্বাদের। এত স্বাদের বেগুনী আমি আগে কখনো খাই নি।
আমার আর প্রিয়ার খুব শখ আমাদের প্রথম সন্তান একটা মেয়ে হবে। এই নিয়ে প্রিয়া আর আমি নানান পরিকল্পনা করতাম। মেয়েকে কোন স্কুলে ভর্তি করবো তাই নিয়ে আমাদের মাঝে তুমুল তর্ক। সেই রাতে আমার উপর রাগ করে প্রিয়া ভাত খায় নি। আমি অনেক জোর করলাম। তারপরও প্রিয়ার রাগ ভাঙ্গেনি। শেষে আমি মেনে নিলাম, প্রিয়ার যেমনটা ইচ্ছে তাই হবে। আমার কথা শুনে প্রিয়া কেঁদে দিল। খুশিতে কাঁদল। আমি সেদিন সেখানকার ফজরের নামাজের পর উপরওয়ালার কাছে দোয়া করেছিলাম, যেন আমাদের একটা মেয়ে সন্তানই দেন। সব ধর্ম ই তো এক, কে জানে! ওপরে হয়তো আকাশে তাদের কথোপকথন আছে, নীচেই খালি মারামারি!
প্রেগনেন্সির প্রথমদিকে ডাক্তার আল্ট্রা সোনোগ্রাফি করে বলেছিল, এখনও ঠিক নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আরও কিছুদিন পর আল্ট্রা করলে সঠিক বলা যাবে। তবে এখন মনে হলো, বোধহয় ছেলে হবে।
ডাক্তারের কথা শুনে প্রথমে আমি আর প্রিয়া একটু মন খারাপ করেছিলাম। তারপর দুজনেই খুশি মনে মেনে নিলাম ভগবান যা দেবেন তাতেই আমরা খুশি। এরপর আমরা আর আল্ট্রা করিনি। ইচ্ছে করেই করিনি।
বাচ্চা ডেলিভারির দিকে এসে প্রিয়ার শরীরটা একটু বেশি খারাপ হয়ে গেল, ধকলের কারণে। প্রিয়ার প্রেশার নামতে লাগল। ডাক্তার বলল, সিজার ছাড়া উপায় নেই।
সিজারটাও একটু জটিল হয়েছিল। সবকিছুর শেষে, ডাক্তার আমাকে বলল, 'আপনি তো ভাগ্যবান মশাই, এক সন্তান হারিয়েও আপনি মেয়ের বাবা হয়েছেন, এই হল ভগবানের আশীর্বাদ। জটিলতা তো ছিলই, আর কয়েকটা দিন হাতে পেলে ভালো হত। বাচ্চার আর তার মায়ের শরীরটা বাঁচানো গেল না, আই অ্যাম সরি।'
প্রিয়া আমাকে ছেড়ে চলে যাবে এই বিষয়টা আমার মাথায় ভুলেও আসেনি, কারণ এই ভাবনাটা আমি স্বপ্নেও ভাবতে চাইতাম না। ওদের হারাবার খবর শুনে আমি কেঁদে ফেললাম, আর মনে মনে আশ্বস্ত হলাম আমার মিতুকে কোলে পেয়ে। আমি আর প্রিয়া জানতাম আমাদের ছেলে হচ্ছে, কিন্তু উপরওয়ালার অন্য প্ল্যান ছিল। আমার বার বার প্রিয়ার চেহারাটা মনে পড়ছে। ভাবছি, এই খবরটা শুনে প্রিয়া নিশ্চয় হাউমাউ করে কাঁদতো। মেয়েটা একটু খুশি হলেই কাঁদতো। প্রিয়া এই রোগটা আমার মধ্যেও ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। এখন আমারও অল্পতেই কান্না চলে আসে।
আমার মনে পড়ে গেল প্রিয়ার সেই বায়নার কথা। মেয়ে হলে যেন গোলাপি জামা কেনা হয়। সেই গোলাপি জামাও কেনা হলো আর আমাদের মেয়েও হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তাকে কোলে নেওয়া গেল না। বদলে আমার কোলে থাকা গোলাপি জামা পরা, তার পছন্দকরে সাথে নিয়ে আসা ফুটফুটে পরীটাকে প্রিয়া দেখতে পারল না। প্রিয়ার ওপর আমার খুব রাগ হচ্ছে, খুব রাগ। প্রিয়ার ওপর আমার রাগ আগেও হয়েছে। রাগ হলে আমি বারান্দায় প্রিয়ার লাগানো সাদা গোলাপ গাছটার তিন চারটে পাতা ছিঁড়ে দিতাম। এতেই প্রিয়ার শিক্ষা হয়ে যেত। আমি পাতা ছিঁড়ব বললেই আর উল্টো-পাল্টা কাজ করতো না। এখন আমি কি করি। আমার যে এখন কিছুই করার নেই। আমি বুকের সাথে আমার মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছি। মেয়েটা ঘুমাচ্ছে।
আজ দেখতে দেখতে চার বছর পেরিয়ে গেছে। হ্যাঁ, আমি চার বছর পরের কথা বলছি।
কি ভাবলেন, আমি বিয়ে করেছি?
একেবারেই না। ঐ বিয়ের চিন্তা আমার মাথাতেও আসেনি। কতশত মানুষ একটা বিয়ে না করেও জীবন পার করছে। আমি-তো একবার বিয়ে করেছি। আমার পরীর মত একটা মেয়ে আছে। পরীটার নাম মিতু, সেও আমাকে বাবা বলে মেনেছে। এই নাম প্রিয়ার পছন্দের। প্রিয়া মারা যাওয়ার পর মিতুর নানী আমাদের সাথেই থাকে, তিনিও সব কিছু মেনে ও মানিয়ে নিয়েছেন। আমাদের বাপ মেয়ের জ্বালায় তিনি মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে পড়েন। রাগারাগি করে মাঝে মধ্যে তার ভাইয়ের বাড়িতে চলে যান, তবে এই চলে যাওয়াটা তিনি বেশির ভাগ আমার অফিস ছুটির দিনই করেন। আমি বুঝি, খুব বুঝি। তিনি কখনও মিতুকে একা রেখে যাবেন না। এই মানুষটা আমাদের বাপ-বেটির বিশাল এক মায়ায় জড়িয়ে গেছেন।
প্রিয়ার মত মিতুরও প্রিয় জায়গা শিশুপার্ক। ছুটির দিনে আমরা বাপ মেয়ে এই শিশু পার্কে গিয়ে বসে থাকি। আমি একটা জিনিস দেখে বেশ অবাক হই, বেশ অবাক। মিতু দেখি তার মায়ের মত পার্কে রাইডে চড়ার চেয়ে বসে বসে দেখতে বেশি ভালোবাসে। মাঝে মাঝে দুই একটা চড়লেও বাচ্চাদের দেখেই সে বেশি আনন্দ পায়।
সেদিন আমি বেশ অবাক হলাম, ভীষণ অবাক। দোলনায় একটা বাচ্চাকে চড়তে দেখে মিতু অস্থির হয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, বাবা দেখ, দেখ ঐ বাবুটা পড়ে যাচ্ছে। ঐ বাবুটা পড়ে যাচ্ছে। তুমি দোলনা বন্ধ করতে বলো না।
হ্যাঁ, এমনই করত প্রিয়া। কোনো বাচ্চাকে একটু অসর্তক হতে দেখলেই প্রিয়া অস্থির হয়ে পড়তো। মিতুর কথা শুনে আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন সবকিছু ওলটপালট করা শুরু করল। মিতুর সামনে আমি কখনও কাঁদতে চাই না। তারপরও আমার চোখের কোণায় জল জমতে শুরু করল।
ছুটির দিন আমার আর মিতুর যাওয়ার আরেকটা ভীষণ প্রিয় জায়গা আছে, তালপুকুর। হ্যাঁ, এই তালপুকুরের রাসমণি শ্মশানই আমাদের প্রিয় জায়গা, পাশেই গঙ্গার ঘাট। প্রিয়াকে এই শ্মশানেই পোড়ানো হয়েছে। আমরা শ্মশানে যাই খুব ভোরে। তখন সবে মাত্র ভোরের আলো ফুটতে শুরু করে। অন্যদিন মিতুকে এত সকাল সকাল ঘুম থেকে জাগাতে বেশ বেগ পেতে হলেও ছুটির দিনে তালপুকুর শ্মশান যাওয়ার নামেই মিতু লাফিয়ে উঠে পড়ে। ঐ জায়গাটা তারও বেশ প্রিয়। মিতু এখন একটু একটু লিখতে পারে। তার মায়ের নাম লেখাটা সে আগে শিখেছে। শ্মশানে যাওয়ার সময় সাদা কাগজে তার মায়ের নামটা লিখে নিয়ে গেল। মায়ের সাথে তার কী সব কথা হয়, আমাকে বলতে চায় না। আমি জানতে চাইলে রাগ দেখিয়ে বলে. তোমার এত সব শুনে কাজ কী? এইটুকু আফগান মেয়ের মুখে বাংলা শুনেও ভালো লাগে, পুরো পরিস্কার! একদম 'আফগান জলেবি'...
তালপুকুর শ্মশানের ঠিক পশ্চিমে বিশাল এক আম গাছ। এই গাছের কাছেই প্রিয়াকে পোড়ানো হয়ে। এখানে আমাদের বাপ বেটির খুব প্রিয় একটা জায়গা আছে। আমরা গেলে ওখানেই বসি। মিতু আজ নতুন একটা মন্ত্র শিখেছে, আদ্যাস্তোত্র। তার মায়ের শ্মশানের কাছাকাছি গিয়ে এই মন্ত্র, সুর করে পড়ার আগে দুই তিনবার আমাকে বলে শোনাবে। বার বার জানতে চাইবে ভুল হচ্ছে কি না। মিতু চায় না তার মায়ের কাছে গিয়ে ভুল সুরে স্তোত্র পড়ুক। তালপুকুরের শ্মশানে মিতুর আরেকজন প্রিয় মানুষ আছে সেটা হল বিজন কাকা। এই মানুষটাকে মিতু দাদুভাই বলেই ডাকে। বিজন কাকা শ্মশানের পাশেই থাকেন, শ্মশানে মরা মানুষ পোড়ান। পরিবার পরিজন আছে বলে মনে হয় না। মিতু নানীর কাছে নতুন নতুন সুরে স্তোত্র শিখে তার মাকে অবাক করে দিতে চায়। এই বয়সে তার অনেক গুলো স্তোত্র মুখস্ত, আমিও জানি না অনেকগুলো। যেগুলো আমি জানি না সেগুলো মিতু বিজন কাকার কাছে গিয়ে বলে। মিতুর স্তোত্র বলা শুনে বিজন কাকা লুকিয়ে চোখের জল মোছেন। তিনি অনেকক্ষণ আমার পরীর মতো মেয়েটাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে রাখেন। আমি কিছু বলি না। শুধু দুর থেকে তাকিয়ে থাকি।
আজ আমার পরী মেয়েটা সুর করে আদ্যাস্তোত্র বলা শিখেছে। পুরোটা শিখেছে। মাঝে মাঝে কয়েকবার ভুল বলেছিল। সেটা গতকাল রাতেই ঠিক করে নিয়েছে। মিতু তার মায়ের শ্মশানের পাশে দাঁড়িয়ে সেটাকে পড়ছে। আমি আর বিজন কাকা দাঁড়িয়ে আছি একটু দুরে। বিজন কাকা কাঁদছেন। অন্যদিন বিজন কাকা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন। আজ তিনি কান্না লুকাচ্ছেন না। তিনি বাচ্চাদের মত করে কাঁদছেন।
পৃথিবীতে সুখ পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। সৃষ্টিকর্তা সুখটাকে নির্ধারণ করে রেখেছেন। আমার সুখ গ্রহনের সময় হলেই তিনি তা আমাকে বিরামহীনভাবে দিতে থাকবেন। আজ আমার সুখ গ্রহনের সময়। এই সময়টা প্রকৃতি আমার জন্য নির্ধারণ করে রেখেছে, অনেক আগে থেকে।
আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। প্রিয়ার সেই রোগটা আমার এখনো আছে। বেশি খুশি আর সুখ পেলে আমার এখনো কান্না চলে আসে। মিতুর ভয়ে আমি অনেকদিন কান্না চেপে রেখেছি। কান্না আসলেও কাঁদতাম না। মেয়েটা কান্না একটুও পছন্দ করে না। আজ আর কান্না চেপে রাখতে ইচ্ছে করছে না।
আমার পরী মেয়েটা দুর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলো। আমি বুঝতে পারলাম মেয়েটা আমার পুরো স্তোত্রটা পড়তে পেরেছে, মুখস্ত। পড়তে পেরেছে বলেই খুশিতে হাসছে।
দুর থেকে মেয়েটার হাসি হাসি মুখ দেখে আমি আর কান্না চেপে রাখতে পারলাম না। প্রিয়ার উপর এতদিন বিশাল একটা অভিমান আমি পুষে রেখেছি নিজের ভেতর, বিশাল অভিমান। এই অভিমান ঠিক সমুদ্রের মত বড় ছিলো। আমাকে একা রেখে এভাবে পালিয়ে যাওয়া তার কিছুতেই ঠিক হয় নি। আজ আমার সব অভিমান শ্মশানের মাটিতে মিশে গেল।
আমি কাঁদছি, হ্যাঁ আমি কাঁদছি নিজের ভেতর বিশাল একটা সুখ নিয়ে। বিশাল সুখ। হাজার বছর বাঁচলেও এমন সুখ অর্জন করা যায় না।
সুখের জন্য প্রহর গুনতে হয়...
-©উshaস চttopaধ্যায়~-----
Labels:
Literature,
Short Story
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment