Saturday 30 September 2023

'সুইসাইডাল বক্স' (পর্ব:৬)


 

'সুইসাইডাল বক্স'

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ৬

_____________________


ব্যালকনি তে বসে ফেসবুক স্ক্রলিং করছিলো রিমা৷ আবার ঐ গ্রুপটা চোখের সামনে পড়ে তার৷ রিমা মোবাইলটা বন্ধ করে রাখে৷ এই গ্রুপটা দেখলেই তার অস্বস্তি হয়, মনে হয় সবাই ওর মনের কথা বুঝে ফেলেছে! সবাই বোধহয় সবটা জানে! 


রকিং চেয়ারে বসে দোল খেতে খেতে রিমা চোখ বন্ধ করে ফেলল; তারপর মনে মনে ভাবতে থাকে সে আসলে ঠিক কী কারনে সুইসাইড করতে চায়! সে ভীষণ একা, বাবার স্নেহবর্জিত ... এটাই কি একমাত্র কারন? না, এর সবচেয়ে বড় কারন অপরাধবোধ৷ একটা গোপন পাপে পাপী রিমা৷ নিজেকে তাই নিজেই ক্ষমা করতে পারে না সে ...যতবার ঐ দূর্ঘটনার কথা মনে পড়ে, ততবার রিমার নিজেকে সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে এই পৃথিবী থেকে৷ ব্যাপারটা কি ভোলার চেষ্টা রিমা করেনি! করেছে...বহুবার করেছে... কিন্তু আজ অবধি পারেনি, আজকাল রিমার মনে হয় পারবেও না৷


শৌভনিক .... ফর্সা, গোলগাল মুখ, বড় বড় কবিতা বলা চোখ ..কোঁকড়া চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ .. আচ্ছা এমন একটা ছেলের প্রেমে পড়া কি খুব অন্যায় ছিলো! শৌভনিকের প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছিলো রিমা .. আর শৌভনিক! সে ছিলো সমাপ্তির প্রেমে অন্ধ৷ দুজন ছিলো কলেজের সবচেয়ে পরিচিত জুটি৷ বেশ মানাতো দুজনকে৷ সবার প্রিয় ছিলো ওরা, শুধু রিমা বাদে! রিমা সহ্য করতে পারতো না ওদের .. অসহ্য লাগতো রিমার! তারপরেও সহ্য করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো৷ 


কিন্তু, সেদিন যখন লাইব্রেরির পেছন দিকটাতে শৌভনিকের বুকের মধ্যে লতার মতো করে লেপ্টে থাকতে দেখলো সমাপ্তি কে, সেদিন নিজেকে আর কনট্রোল করতে পারেনি রিমা! যে গল্পটায় তার হবার কথা সে ভেবে আসছে শয়নে-স্বপনে, সেই গল্পের নায়িকা যখন অন্য কেউ হয় তা ঠিক কতক্ষন সহ্য করতে পারা যায়? যারা সহ্য করতে পারে তারা বোধহয় মহান মানুষ, রিমা সাধারন মানুষ, সে মহান হতে চায়না৷ রিমা পারেনি ...


অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে রিমার৷ ভয়াবহ সেই গোপন পাপের স্মৃতি রিমাকে বাঁচতে দিচ্ছে না৷ নিজেকে নোংরা মনে হয় ওর .. আচ্ছা তার কি ঐ সুইসাইডাল বক্সটা দরকার? এর আগেও সে চেষ্টা করেছে কয়েকবার, সফল হতে পারেনি, এই সুইসাইডাল বক্স কি তাকে নিশ্চিত মৃত্যু দিতে পারবে! সেখান থেকেও তাকে ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসতে হবে না তো?


******


ছোট্ট একটা ফুলের মতো ফুটফুটে মেয়েকে নিয়ে মিতালী গোস্বামী দেখা করতে এসেছেন৷ এ বয়সের মেয়েরা হবে ছটফটে ফড়িং এর মতো, অথচ মিতালী-র কন্যাটি বড্ড বেশিই চুপচাপ৷ 


আমাকে দেখে মিতালী বললেন 


—আপনিই কি আঁধার?


—আজ্ঞে হ্যাঁ 


—ও.. আপনার আসল নামটাকি বলা যাবে? 


—আমার ডাক নাম রণি৷ আপনি আমাকে রণি বলে ডাকতে পারেন .. 


—আচ্ছা৷ আমার বক্সটি কি এনেছেন? আমি টাকা নিয়ে এসেছি.. 


—আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই ৷ আপনি যদি আমাকে ভাই ভাবেন, আমি কি কথাগুলো আপনাকে বলতে পারি.. যদি আপনি অভয় দেন তবেই..!


—ভাই ভাবলে আর আপনি বলছো কেন? তুমি বলো৷ আর তুমি আমার বেশ ছোটই হবে৷ আমি বেশিক্ষন কাউকে আপনি আজ্ঞে করতে পারিনা৷


—বেশ দিদি, আমি আসলে কোন সুইসাইড বক্স বিক্রি করি না৷ আমি চেষ্টা করি মানুষদের সুইসাইড থেকে ফেরাতে৷ টাকার কথাটা বলি যাতে মানুষ কিছুদিন সুইসাইডের চিন্তা বাদ দিয়ে টাকার চিন্তায় থাকে৷ তুমি বলো ..এই কটাদিন তোমার মাথায় কোন চিন্তাটা ছিলো?


—টাকা জোগাড়ের চিন্তা.. কিন্তু রণি, আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম! তুমি এভাবে আমাকে ঠকালে?


—দিদি, আমার কথাটা শেষ করতে দাও প্লিজ৷ তারপর যা বলবে আমি মাথা পেতে নেবো ..


—বলো, কত মানুষের কত কথাই তো শুনলাম! তুমিও বলো না হয়..


—আমি সাধারণত কোন কেস সল্ভ করার জন্য তার আপনজনদের সাহায্য নিই, কিন্তু এইবার আমি আমার সেই পুরোনো পদ্ধতিতে কাজ করতে পারিনি৷ দিদি, আমি খুঁজে পেতেও তোমার কোনও আপনজন খুঁজে পাইনি৷ কিন্তু দিদি, তোমার এই ছোট্ট শান্তু টুনটুনিটার আপনজন খুঁজে পেয়েছি, যে ওকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে, যে ওর পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে পারে ..


— ক.. কে, কে!


—দিদি, তুমি!


—হা হা হা ! রণি, হাসালে তুমি আমাকে .. ঠাট্টা করছো তুমি আমার সাথে?


—না মিতালী দি, ঠাট্টা আমি করি না .. যা বলছি ভেবেই বলছি৷ দিদি, মেয়ের জন্য ঢাল হয়ে তোমাকেই দাঁড়াতে হবে৷ একটাবার চিন্তা করে দেখো ... এই নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে তুমি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে? একটাবার যুদ্ধের চেষ্টাও করবে না? 


—আমার কী করার আছে রণি!?


—আমি ভেবে রেখেছি৷ বলছি .. শোনো, তোমার হাতে আছে দশহাজার টাকা৷ প্রথমে তুমি মামনিকে নিয়ে ঐ বাড়িটা ছাড়বে৷ একটা ভাড়া বাড়ি আমি দেখে রেখেছি৷ একটা বয়স্ক দম্পতি থাকে৷ একটা রুম ভাড়া দেয়৷ সুন্দর রুম, রুমের সাথে বাথরুম আর বারান্দা আছে৷ ভাড়া তিনহাজার টাকা প্রতিমাসে৷ ওনারা এক মাসের ভাড়া এডভান্স রাখেন৷ কিন্তু আমি ওনাদের বুঝিয়ে দু'হাজার এডভান্সে দেবো বলেছি৷ এরপর তোমার কাছে থাকলো আট হাজার টাকা৷ এর ভেতর থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তুমি কাপড়ের ব্যবসা শুরু করবে৷ কিছু কাপড় এনে তাঁতীদের থেকে আরো ছবি নিয়ে আসবে৷ অনলাইন প্লাস অফলাইনে বিভিন্ন স্কুলের সামনে গিয়ে গার্জিয়ানদের কাছে বিক্রির চেষ্টা করবে৷ আমরা প্রথমেই নেবো একদম কমের মধ্যে বাটিক, ব্লক, স্ক্রিন প্রিন্টের থ্রিপিস৷ লাভও রাখবো খুব সীমিত৷ এগুলো এখন বেশ ভালো চলে৷ আমি সব খোঁজ খবর করে এনেছি৷ ছ'টা মাস তুমি শুধু আমাকে বিশ্বাস করো, দেখো ...তারপরও কিছু না হলে তুমি যা বলবে মাথা পেতে নেবো৷ 


—যত সহজে বললে, এত সহজে কী সম্ভব!


—নিশ্চয় সম্ভব৷ এখন ওঠো, তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো৷


—কোথায়?


—আমাদের বাড়িতে৷ আমার মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে৷


আমার মা মিতালী গোস্বামী-র জন্য অপেক্ষা করে আছেন৷ মা এতকিছু জানেন না৷ মা কে শুধু বলেছি, "একজন বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করছি মা, তুমি পাশে থেকো৷" 


মিতালী দির মেয়ের নাম মৌলি, ডাকনাম তোতন! আমার মায়ের সাথে তোতনের বেশ ভাব হয়ে গেলো৷ আমাদের বাড়ির কাছেই মিতালী দিদির জন্য বাড়ি দেখেছি৷ তাকে সেই বাড়িও দেখিয়ে আনলাম ... তারপর দিদি একসময় চলে গেলেন ... যাবার সময় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন "বসার ঘরের ছবিটা কি কম্পিউটারে ফটোশপ করেছো? একই মুখ খালি ছেলে আর মেয়ের তফাৎ.. দারুণ হয়েছে... মনে হচ্ছে পাশাপাশি দুটো জেন্ডারে তুমি!"


আমি বললাম "দিদি, ওটা আমার জমজ বোনের ছবি৷ ও দু'বছর আগে সুইসাইড করেছে৷ ওর জন্যই আমি আঁধার! ওর মৃত্যু ঠেকাতে পারিনি, তাই চেষ্টা করে যাই যতটা সম্ভব মানুষের সমস্যার সমাধান করতে ..."


মিতালী দি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, "রণি, তুমি পারবে ..নিশ্চয় পারবে ... আগামীকাল আমি চলে আসবো৷ সকাল সকালই চলে আসবো৷ পাশেই থেকো আমার৷ তুমি থাকলে তোতনের ভার আমি নিতে পারবো, তোতনের ঢাল আমিই হতে পারবো...ভগবান চাইলে ঠিক পারবো .."


আমাকে জড়িয়ে ধরলেন মিতালী দি৷ আমার আবার মনে হলো আমাকে জড়িয়ে ধরেছে তিতলী! 


আচ্ছা ওপারে বসে কী তিতলী দেখতে পায়, আমি, মা, আমরা যে সারাটাক্ষন ওকে মিস করি! পাগলের মত মিস করি! 


*******


রিমার বাবা গেছেন দেশের বাইরে৷ তার কি নাকি জাহাজে কোন সমস্যা হয়েছে, সেই জাহাজের পেছনেই ছুটেছেন তিনি৷ রিমা আজ এসব চিন্তা বাদ দিয়ে একটু মন ভালো করার চেষ্টা করছে৷ 


মায়ের আলমারি খুলে একটা লাল শাড়ি বের করে রিমা৷ তারপর রান্নাঘরে গিয়ে রাঁধুনি কে বলে আসে ভালো করে কষিয়ে মাংস, মুগের ডাল আর ভাত রান্না করতে৷ সাথে টমেটোর চাটনি৷ বলে এসে নিজের ঘরে না গিয়ে মায়ের ঘরেই ঢোকে৷ মায়ের ঘরটা এখনও আগের মতই আছে৷ মায়ের ড্রেসিং টেবিল, তার সাজ-গোজের জিনিসপত্র .. অবশ্য সাজগোজের জিনিস বলতে শুধু কয়েকটা কাজল, আর একটা হালকা কালারের লিপস্টিক৷ এসবের এক্সপায়ারি থাকার কথা না, তবু.. রিমা জানে, আনোয়ারা তার আশেপাশেই আছে, তাই আনোয়ারা কে ডেকে তার ঘর থেকে তার কাজল আর লিপস্টিকটা আনতে বলে৷ আজ সে মায়ের মত করেই সাজবে ..


সময় নিয়ে সাজে রিমা৷ সুন্দর করে শাড়ি পড়ে, চোখে কাজল দেয়, ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক দেয় ...তারপর মুগ্ধ হয়ে নিজেকে দেখে সে৷ ওর বেশ ভালো লাগতে থাকে৷ এভাবে সেজেগুজেই দীর্ঘদিন পর সে ডাইনিং টেবিলে বসে নিজের সব পছন্দের খাবার তৃপ্তি করে খায়৷


তারপর ঘরে এসে নিজেকে এলিয়ে দেয় বিছানায় ....

ঠিক তখন ওর মনে হয় শাড়িটা জঞ্জাল লাগছে ...শাড়ি খুলে একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার পরে ফেলে সে৷ তারপর আবার ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে ... এই রিমা একটু আগে আনন্দে থাকা রিমা না..বরং এ সেই পুরোনো ডিপ্রেসড রিমা..


সাজ-গোজ বা খাওয়া-দাওয়া ডিপ্রেশন কমায় না৷ যখন কাউকে বলা হয় খুব মন খারাপ হলে আপনি কি করেন? বেশিরভাগ মেয়েই উত্তর দেয়, আমি তখন সাজি, বা আমি তখন খাই ... এসবই আসলে নিজেই নিজেকে বোকা বানানো, ধোঁকা দেওয়া৷ সাময়িকভাবে নিজেকে ডাইভার্ট করা৷ কিন্তু পরিপূর্ন সমাধান এটা নয়৷ আসলে আমরা ক'জনই সমস্যার পরিপূর্ন সমাধান চাই! আমরা বোধহয় দুঃখবিলাস করতেই বেশি ভালোবাসি ....


চলবে..


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #ষষ্ঠ_পর্ব

Saturday 23 September 2023

'সুইসাইডাল বক্স' (পর্ব: ৫)


 

'সুইসাইডাল বক্স'

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ৫

_____________________

.."আমার আইডি দেখে আপনি হয়তো ভাবছেন আমি হয়তো একটা মেয়ে৷ আসলে এটা আমার ছোটবোনের আইডি৷ ওর-ই নাম জোনাকি, ওর আবার ফেসবুকের নেশা নেই৷ আমিই মাঝে মধ্যে ওর আইডিতে ঢুকি৷ সমস্যাটা শুরু হয় এই আইডি নিয়েই৷ আসলে সমস্যা ঠিক তার নয়... ব্যাপারটা হচ্ছে, সমস্যাটা আমি নিজে নিজেই তৈরি করেছি৷ 


আমার নাম সৌম্য; ভালো নাম, শেখ সামসুল হক। অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তির অপেক্ষায় আছি৷ যাই হোক, আপনার বেশি সময় নেবো না, প্রসঙ্গে আসি৷ আমার বোন নিজের ছবি প্রোফাইলে দিতে খুব-একটা পছন্দ করে না৷ ইন্টারনেট থেকেই ডাউনলোড করে একজন নায়িকার ছবি দিয়েছিলো প্রোফাইলে৷ সাউথ ইন্ডিয়ান মুভির নায়িকা৷ ও যেহেতু ফেসবুকে সেরকম ঢোকে না, আর আমিই মেনলি ওর আইডি চালাই, তাই খেলাচ্ছ্বলেই সমস্যার শুরুটা আমি করে ফেললাম.. 


মেয়েদের আইডিতে বিভিন্ন ছেলেরা নানান সময়ে নানা রকম নোংরা ম্যাসেজ করে থাকে.. আদার ম্যাসেজবক্স ওপেন করলে বোঝা যায় যে মানুষের মনের নোংরামির কোন সীমা-পরিসীমা নেই৷ আমার বোনের আইডিতেও এমনই ছেলেদের ম্যাসেজ আসতো৷ নিজেদের বিশেষ অঙ্গের ছবি পাঠাতো ইনবক্সে৷ আমি খুব কড়া ভাষায় রিপ্লাই দিয়ে সেই আইডিগুলোকে ব্লক করে দিতাম৷ এসবেও কোন সমস্যা ছিলো না৷ 


একদিন একটা ম্যাসেজ আসলো তরুন কুমার নামের একটা আইডি থেকে৷ খুব সুন্দর করে ভদ্রভাষার ম্যাসেজ৷ আমি নোংরা ম্যাসেজ দেখে দেখে এতটাই বিরক্ত ছিলাম, আমার ওনার করা ম্যাসেজ খুব ভালো লাগলো৷ আমি খুব স্বাভাবিকভাবে রিপ্লাই দিলাম৷ তবে ফোনের ওপারের মানুষটা জানতে পারলো না আমি একজন ছেলে ....


তরুন প্রতিদিন ম্যাসেজ পাঠাতো- দারুণ সব কবিতা লিখে লিখে.. ওর কবিতা আমার বেশ ভালো লাগতো৷ আমি নিয়মিত কথা বলে যেতে লাগলাম৷ একসময় অবাক হয়ে দেখলাম আমি তরুনের সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছি.. আমি ভীষণ ভালো লাগা নিয়ে অপেক্ষা করছি ...


আস্তে আস্তে আমাদের কথা বলার সময় বাড়লো, সারারাত আমরা কথা বলতাম৷ আমার পরীক্ষা থাকলে ও আমার সাথে জাগতো৷ আমি অসুস্থ হলে ও আমাকে ওষুধ খাবার কথা মনে করিয়ে দিতো৷ আমি দিনে দিনে ওর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে লাগলাম৷ 


আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন আঁধার? অবশ্য বিরক্ত হবার মতোই কথা বলছি আমি! আর বেশিক্ষন নেব না আপনার ..."


"না..না, বিরক্ত হওয়ার কোন কারণ নেই, আমি অভ্যস্থ! তারপর কী হলো?"


"তারপর যা হবার সেটাই হলো৷ তরুন আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো৷ ও যেহেতু হিন্দু আর আমি মুসলিম ও নিজ থেকেই বললো ও ধর্ম পরিবর্তন করবে৷ প্রেম না, সরাসরি বিয়েই করতে চায় আমাকে..."


"আমি দ্বিধায় পরে গেলাম ! আমি তরুনকে কি বলবো! হিন্দু-মুসলিম এটা সমস্যা না, সমস্যা তো অন্যখানে৷ আমি একজন পুরুষ ... ঠিক একই ভাবে তরুনও একজন পুরুষ৷ তরুনের কাছে আমি নারী হলেও আসলে আমি তো নারী নই!


প্রচন্ড দ্বিধা নিয়ে দিন কাটাতে লাগলাম৷ আমি তরুনের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম... ও আমাকে পাগলের মতো নক করতো৷ আমার সাথে কথা বলার জন্য ও পাগল হয়ে ছিলো৷ আমার অসহায় লাগতো৷" 


"নিজের সাথে যুদ্ধ করে আর পারলাম না৷ সত্যিটা বলে দিলাম অবশেষে৷ বললাম, 'তরুন আমি একজন ছেলে...' ও বিশ্বাস করতে চাইলো না৷ ও ভাবলো আমি ওকে বিয়ে না করার জন্য মিথ্যে কথা বলছি ..."


"আমি অবশেষে ওর সাথে দেখা করতে চাইলাম৷ ওর কান্না আমার সহ্য হচ্ছিলো না৷ আমিও কাঁদছিলাম, কেন কাঁদছিলাম জানি না..আমিও বোধহয় ভালোবেসে ফেলেছিলাম তরুনকে! বোধহয় না, আমি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলাম তরুনকে৷ একটা ছেলে হয়েও আমি আরেকটা ছেলেকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম ... হয়তো এখনও বাসি .."


"আমি তরুনের সাথে দেখা করলাম৷ ও অবাক হয়ে দেখলো আমাকে .. ঘৃনাভরে দেখলো আমাকে ...কোন কথাই বললো না! শুধু যাবার আগে একদলা থুথু ফেলে দিয়ে গেলো আমার গায়ে .."


"এই ঘটণার ছয়মাস হয়ে গেছে৷ এই ছয়মাসে আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি পুরো ঘটণাটা ভুলে যেতে, পারিনি৷ আমি এখনও ফেক আইডি দিয়ে তরুনের আইডি ফলো করি, ওকে দেখি৷" 


"আমি চেষ্টা করেছিলাম কোন মেয়ের সাথে যেন সম্পর্কে জড়াতে পারি৷ সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক ... আমি পারিনি ... কোন মেয়ের প্রতি আমার সেই অনুভূতিটা জন্মায় না .."


"তরুন কিন্তু আমাকে মনে রাখেনি৷ ও বিয়ে করেছে গত তিনদিন আগে৷ একদম হিন্দুরীতি তে, খুব ধুমধাম করে এক রূপসী মেয়েকে বিয়ে করেছে .. বিয়ের ছবিতে তরুনের হাসিমুখ আমার বুকে শূলের মতো বিঁধেছে আঁধার .." 


"আমি জানি, ভুলটা আমার৷ আমিই প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাবার চেষ্টা করেছি, মিথ্যা বলেছি .. আমি শাস্তি পাবো এটাই স্বাভাবিক! কিন্তু শাস্তির এই বোঝাটা আমি আর টানতে পারছি না৷ তরুনের বিয়ের আগে পর্যন্ত কষ্টটা অন্যরকম ছিল, কিন্তু এখন কষ্টটা আলাদা৷ আমি চোখ বন্ধ করতে পারি না, চোখ বন্ধ করলেই দেখি তরুন ওর বউয়ের সাথে ......." 


"আমি আর পারছি না আঁধার! মৃত্যু মনে হয় সবচেয়ে সহজ সমাধান ... আমাকে ঘৃনা করবেন না আঁধার, খুব সাহস সঞ্চয় করে প্রথমবার এই কথাগুলো আমি কাউকে বললাম ...."


সামসুলের ম্যাসেজ পড়ে আমি খানিকক্ষন চুপ করে থাকলাম৷ ঠিক কী বলা উচিত আসলে বুঝতে পারছি না .. একটা ছেলে আরেকটা ছেলেকে কীভাবে ভালোবাসে এটা আমার মাথায় ঢুকছে না৷ আমি রিপ্লাই দেওয়ার আগে একটু প্রস্তুতি নিলাম৷ আমি লিখলাম "আপনি যে সমস্যায় পড়েছেন সে সমস্যার সাথে আমি পরিচিত নই৷ তবে এটুকু বলতে পারি, আমার মনে হয় আপনার কোন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার৷ এটাও এক ধরনের মানসিক সমস্যা মনে হচ্ছে৷ আমার পরিচিত একজন 

সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন৷ আপনি চাইলে আমি তার সাথে কথা বলে আপনার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে কথা বলে নেবো৷ একটাবার চেষ্টা করে দেখুন৷ ভুল তো মানুষেই করে, তবে ভুল শোধরাবার চেষ্টা তো করা দরকার, তাই না, কি বলেন?"


সামসুল চুপ করে থেকে উত্তর দিলো "আমি আমার পরিবারের একমাত্র ছেলে৷ একটা শেষ চেষ্টা আমি করতে চাই ... আপনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে দেখুন ..." 


আমি আচ্ছা বলে কথা শেষ করলাম৷ কথা শেষ করতেই দেখি মিতালী গোস্বামী-র ম্যাসেজ করেছে৷ তার টাকার জোগাড় হয়ে গেছে৷ আমি তাকে কাল দেখা করার সময় দিলাম৷ অন্য কেস আর মিতালী গোস্বামী-র কেস এক নয়৷ আমার আরো কিছু কাজ আছে, কাজগুলো শেষ করতে হবে অতি দ্রুত...


ইনবক্সে থাকা দ্বিতীয় ম্যাসেজটা ওপেন করলাম৷ ভদ্রমহিলা তার পুরো গল্পটা বলেই রেখেছেন৷ 


"আমার নাম অতসি, বয়স পয়তাল্লিশ৷ তিন সন্তানের জননী৷ বড় মেয়ের বিয়েও দিয়েছি৷ ছোট মেয়েটা টুয়েলভ দিলো এবার৷ আর সবচেয়ে ছোটটা ছেলে, ক্লাস নাইনে পড়ে৷ আমার স্বামীর বয়স সাতান্ন, বারো বছরের বড় আমার থেকে.."


"বছর দুয়েক আগে আমার জরায়ুতে টিউমার ধরা পড়ে৷ টিউমারটার জন্য অপারেশন করে আমার পুরো জরায়ু ফেলে দিতে হয়৷ এরপর থেকে নানান ধরনের সমস্যা হচ্ছে আমার৷ তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা, বয়সের কারনেই হোক আর অপারেশনের কারনেই হোক, স্বামী-স্ত্রী র নিজস্ব সম্পর্কে আমি আর কোন আগ্রহ পাচ্ছি না৷" 


"এটা নিয়ে অনেক অশান্তি৷ আমার স্বামী, এ বিষয়টি বুঝতে চাইছেন না৷ আর বিষয়টি এতটাই লজ্জার আমি আমার সন্তানদের সাথেও শেয়ার করতে পারছি না .. এটা কি ওদের বলার মতো কথা! বাবা-মা মারা গেছেন আমার৷ শ্বশুর মারা গেছেন৷ আছেন এক শ্বাশুড়ি, বৃদ্ধা ... জাগতিক বোধ-বুদ্ধিশূন্য! আমি আমার এ যাতনা কাকে বলবো! আমি ডাক্তার দেখিয়েছি, এ সমস্যার নাকি সমাধান আসলেই নেই!


আমার স্বামী গত পাঁচমাস আগে বিয়ে করেছে৷ ইচ্ছে করলে আমি কেস করতে পারি৷ কিন্তু, আমার নিজেকে এতটাই ক্লান্ত লাগে আমার আর কোন ঝামেলা করতে ইচ্ছে হয় না৷ আমার ছেলে মেয়েরা এখনও জানে না তাদের বাবার এই বিয়ে করার কথা৷ টাকা রেডি আছে আঁধার, আমি কি 'সুইসাইডাল বক্স' টি পেতে পারি? এত কষ্ট করেছি, মৃত্যুটা অন্তত আমার সহজ হোক..."


আমি পড়লাম৷ পড়তে পড়তে আমার দুচোখ দিয়ে জল চলে আসছিলো৷ আমি আজকাল দ্রুতই ভেঙে পড়ছি৷ এভাবে আমার ভেঙে পড়লে তো চলবে না ..


আমি নিজেকে শক্ত করলাম৷ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে রিপ্লাই দিলাম ..


"একটা বয়সের পর সন্তানেরা মায়ের বন্ধু হয়ে যায়৷ আপনার সন্তানেরা সেই বয়সে পৌঁছেছে৷ তাদের কাছে লজ্জার কিছু নেই৷ আপনি আপনার সন্তানদের সাথে কথা বলুন, মন খুলে৷ ওদের আপনি জন্ম দিয়েছেন৷ ওদের মতো ভালো করে আপনাকে কেউ বুঝবে না৷ আর একটা কথা, এই খবরটা এক সময় না এক সময় আপনার সন্তানদের কানে ঠিকই যাবে৷ অন্য কারও থেকে শোনার আগে আপনিই বলুন, এটাই ভালো৷ আপনার কোন ভুল নেই৷ আপনি কেন মরবেন? আর একবার আপনার সন্তানদের কথা ভাবুন ...ওদের কি হবে আপনি না থাকলে...?


আপনার সমস্যার সমাধান আছে৷ আমি খুবই দুঃখিত আপনার কাছে আমি বক্সটি বিক্রি করতে পারবো না.."


উনি উত্তরে বললেন, "আমি কি পারবো, লড়াই করতে..?"


আমি অভয় দিয়ে বললাম, "নিশ্চয় পারবেন..."


চলবে..


***


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #৫ম_পর্ব

Saturday 16 September 2023

সুইসাইডাল বক্স (পর্ব: ৪)

 


'সুইসাইডাল বক্স'

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ৪

_____________________


আনোয়ারা মেয়েটা রিমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে৷ ভয়ার্ত গলায় সে রিমাকে বললো- 


—দিদি, চলো ঘরে যাই.. 


—তুই কীভাবে বুঝিস আমার সবকিছু বলতো? 


—দিদি, ঘরে গিয়ে কতা বলবো, চলো!


—ভয় পাচ্ছিস কেন ? আরে আমি লাফ দেবো না 


—তা বেশ, চলো ঘরে যাই...


—ঠিক আছে বাবা, চল ..


রিমা আনোয়ারার সাথে ঘরে চলে যায়৷ রিমা বিছানায় হ্যালান দিয়ে শুয়ে পড়লো, চোখটা বন্ধ করে রিমা৷ ওর আজ খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে৷ আনোয়ারার সাথে কথা বলা খানিকটা দেওয়ালের সাথে বলার মতো; চুপচাপ শুনবে, কিন্তু সচরাচর কোন উত্তরই সে পাবে না! সে শুধু একটা কাজই ভালোমতো করতে পারে, তা হলো ছায়ার মতো রিমাকে ফলো করতে৷ রিমা চোখ মেলে তাকালো, আনোয়ারা সেখানে নেই৷ সে আনোয়ারা বলে ডাক দিতেই সে চলে এলো সাথে সাথেই- হাতে তার এক কাপ কড়া লিকারের চা....


রিমা চা হাতে নিলো৷ হাতে নিয়ে বললো; 


—আনোয়ারা, বাবা তোকে বলেছে না, সারাক্ষন আমাকে ফলো করতে?


আনোয়ারা চুপ করে রইলো৷ রিমার বাবা তাকে এই দায়িত্ব দেয়নি; কিছুই বলেনি, কিন্তু গতবারের ঘটনার পর আনোয়ারা নিজেই এ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে৷ সেবার আনোয়ারা যদি একটু সচেতন হতো তাহলে বোধহয় এমনটা হতো না!


—কি রে আনোয়ারা, চুপ করে আছিস কেন? বল! বাবা কি বলেছে তোকে.. আমাকে ফলো করতে?


—না তো দিদি..! 


—সত্যি করে বল! বাবা যদি এমনটা বলে আমার কিন্তু ভালোই লাগবে, মনে হবে মানুষটা অন্তত আমার কথা ভাবছে ..


—বাপের কাছে বেটির চাইতে আপন কেউ হয় না গো দিদি..বড়দাদাবাবু আপনাকে অনেক ভালোবাসে, কিন্তু দেখায় না..


—হা হা হা! আনোয়ারা, তোকে যে বিক্রি করে দিয়েছিলো বারো বছর বয়সে সে তোর বাবাই ছিলো, তাই না..? বাবা হলেই ভালো হবে, মেয়েকে ভালোবাসবে.. এ ধরনের চিন্তা করাটা হচ্ছে বুলশিট, বুঝেছিস! মানে একদম বাজে কথা...


—অভাবের জন্যে এমুন করেছিলো৷ আমার আরো ভাই-বোন ছিলো, নদী ভেঙ্যে ক্ষেত-ফসল সব গেছিলো গাঙের জলে ... এতগুলো মানুষের বাঁচবার আশায় আমাকে বেচেছিলো.. 


—তার উপর তোর রাগ নেই? এভাবে বলছিস অভাবের জন্য বিক্রি করেছে .. সত্যিই কি রাগ নেই ?


—না দিদি ... আমি তো ভালোই আছি৷ খাওয়ার কষ্ট নেই, গায়ের কাপড়ের কষ্ট নেই ... রাগ রেখ্যে কি করবো, নিজেরটা খালি বুঝলে হব্যে! ওদের কষ্টও বোঝা লাগে দিদি ...


—তুই ভালো আছিস, কারন তোকে যে কিনেছিলো সে তোকে ব্রোথেলে বিক্রি না করে আমার বাবার কাছে বিক্রি করেছে! ব্রোথেল বুঝিস? নষ্ট মেয়ে মানুষদের আখড়া .. তোর কপাল ভালো বুঝেছিস! আর কিচ্ছু না ..


—কপাল যদি ভালোই হয় তাইলে আর রাগ রেখ্যে লাভ কি কও!


—যাক গে, তোর সাথে এসব কথা বলা অর্থহীন.. তারপরও বুঝলি আনোয়ারা, তোর বাবা আমার বাবার চেয়ে ভালো৷ তোর বাবা তোকে বিক্রি করে দিয়েছে টাকার কাছে, আর আমার বাবা আমাকে বিক্রি করেছে সময়ের কাছে ...


মা মারা যাবার পর আমার কথা বলার মানুষটাও আর কেউ থাকলো না৷ কখনো কোন বন্ধু বানাতে পারিনি, সবসময় নিজেকে সংকীর্ণ লাগতো! আমি তো শুধু বাবার কাছে সময়ই চেয়েছি, বাবা কি এতোটুকুও আমাকে কখনো দিয়েছে..!


তুই আর আমি তো একসাথেই বেড়ে উঠলাম এই বাড়িতে! কখনো দেখেছিস বাবাকে আমার মাথায় একটু হাত রাখতে..! আমার যখন জ্বর হতো, আমি জ্বরের ঘোরে কাঁপতাম৷ সুমিতা আন্টিকে জড়িয়ে ধরে আমি বাবাকে খুঁজতাম .. বাবা হয় বিদেশে থাকতো না হয় অফিসে! আমার পাশে ছিলো না কখনো .. সুমিতা আন্টি আমাকে মায়ের মতো ভালোবাসতো জানিস, তোকেও অনেক ভালোবাসতো তোর মনে নেই? সেই আন্টিও একদিন আসা বন্ধ করে দিলো, দিনের দিনের দিন আমি আন্টির জন্য অপেক্ষা করেছি .. অনেকদিন পর জানলাম আমাদের বাড়ির চাকরিটা আন্টি ছেড়ে দিয়েছে৷ কেন ছেড়ে দিলো চাকরিটা বলতে পারিস?


আজ আমি বাবার কাছে গিয়ে বসলাম৷ বাবা যদি শুধু একবার জিজ্ঞেস করতো, "রিমা মা ভালো আছো?" আমি কতটা খুশি হতাম তোকে বোঝাতে পারবো না ... কিন্তু বাবা একবারও বললো নারে আনোয়ারা! আমার বাবা একটাবারের জন্যেও বললো না..


—দিদি, মেয়্যা মানুষের ধৈয্য ধরতে লাগে অনেক.. বড়দাদাবাবু মানুষ খারাপ না৷ শুধু কাজকামের চাপ বেশি.. এর জন্যি তোমার সাথে গফসফ করতে পারে না৷ এইগুলো মনে নিয়্যা মন ভারি করে রাখল্যে চলব্যে? এরচে বিরাট বিরাট কষ্ট নিয়্যা মানুষে হাসি মুখে বেঁচ্যা থাকে গো.. ধৈয্যের গুণ বড় গুণ


—ধৈর্য্য, হা হা হা! হুম ভালো বলছিস ... হা হা হা!


******


একটা কেস সল্ভ করার আগে আমি অন্য কেস নিতে চাই না৷ মনোযোগ ডাইভার্ট হয়ে যায়৷ কিন্তু মিতালী গোস্বামী আমার সাথে আর যোগাযোগ করছে না! হয়তো টাকাটা এখনো জোগাড় করতে পারেনি৷ তাকে অনলাইনে দেখি, কিন্তু সে আমাকে নক করে না ... চিন্তা হচ্ছিলো, ভাবলাম সব ঠিক আছে তো! নিজে থেকেই তাই 'হ্যালো' বললাম ৷ আমার হ্যালোর জবাবে তিনি লিখলেন, 'আর কটা দিন সময় লাগবে ..' আমি আর কথা বাড়ালাম না, উনিও আর কোন কিছু বললেন না৷ যাক, আমি নিশ্চিন্ত হলাম কিছুটা৷ উনি ভালো আছেন, এটুকুই যথেষ্ট, টাকা জোগাড়ের চেষ্টায় আছে, থাকুক!


আজ আমি পেন্ডিং ম্যাসেজগুলো চেক করতে বসলাম৷ তিনটে নতুন ম্যাসেজ! এত মানুষ মরতে চায়.. কেন! মৃত্যুই কি তবে জগতের সব সমস্যার সমাধান? এই যে আমার তিতলী এই মৃত্যুকে সমাধান ভেবে যে চলে গেলো, ও কি জানে যে ওর চলে যাবার পর আমরা কেমন আছি? আমার মা তিতলী চলে যাবার পর থেকে একবারও হাসেনি৷ মায়ের কথা ভাবলে বড্ড অবাক হই৷ আট বছর বয়সী দুটো জমজ ছেলে-মেয়ে রেখে বাবা মারা গেলেন৷ এরপর মা ঐ স্কুলে চাকরি করেই আমাদের ভাই-বোনদুটোকে বড় করলেন৷ বাবা যখন মারা যায় তখন মায়ের আর কতই বা বয়স ছিলো! কিন্তু তারপরও উনি একটাবারও নিজের কথা ভাবেনি৷ দ্বিতীয়বার সংসার করেননি৷ শুধু আমাদের জন্য নিজের জীবনটা উৎসর্গ করে দিয়ে গেলো৷ অথচ বিনিময়ে তার একটা সন্তান তার মুখ থেকে হাসি কেড়ে নিয়ে চলে গেলো সারাজীবনের জন্য৷ মানুষটা বেঁচে আছে ঠিকই, কিন্তু এই বেঁচে থাকাকে ঠিক বেঁচে থাকা বলে কি না, আমার জানা নেই .. বাবার মৃত্যুটাও মা কে এতটা ভেঙে চুরমার করে দেয়নি যতটা দিয়েছে তিতলীর মৃত্যু৷ বাবার মৃত্যুটা ছিলো সহজ, স্বাভাবিক৷ অসুস্থ হয়েছিলেন, দীর্ঘদিন রোগে ভুগেছেন, তারপর মারা গেছেন.. কিন্তু তিতলীর মৃত্যুটা অস্বাভাবিক৷ তিতলীর বয়স ছিলো একুশ ... রোগ ছিলো না, জরা ছিলো না .. শুধু ছিলো হয়তো বুক ভর্তি গোপন অভিমান৷ আমি জানি না সে অভিমানের কারন, জানে না মা-ও ..


বসার ঘরের ছবিটা এখনো আগের মতোই টাঙানো আছে৷ মা ঐ ছবি খুলতে দেয় না৷ ছবিতে আমার দাড়ি ধরে টানছে তিতলী .. আমি চিৎকার করছি আর ও খিলখিল করে হাসছে .. আমাদের দুজনেরই বয়স তখন পনেরো-ষোলো হবে.. 


আমাদের দুই ভাই-বোনের সম্পর্ক ছিলো বন্ধুর মতো৷ আমরা কত রাত গল্প করে পার করেছি, অথচ এত গল্পের পরেও আঁচ করতে পারিনি কি চলছে আমার বোনের বুকের গহীনে .. 


মানুষ কষ্ট লুকোনোর অভিনয় করতে সবচেয়ে ভালো পারে৷ একজন মানুষ সহজ স্বাভাবিক ভাবে আপনার সামনে হেঁটে বেড়াবে, আপনি বুঝতেও পারবেন না সেই মানুষটার হৃদয়ে কোন ঝড় চলছে ... অভিনয়! সবই অভিনয়! এই অভিনয় না জানলে যে সমাজে মান থাকে না, পরিবারে মুখ থাকে না৷ যে যত ভালো অভিনয় করতে পারবে, মানুষ তাকে তত বেশি সুখী ভাববে৷ আচ্ছা, কেউ যদি কষ্টে থাকে তাহলে তা প্রকাশ করতে দোষ কি! কেন করতে হবে এই লোক দেখানো মিথ্যা অভিনয়! অন্য কারো কাছে না হোক আপন মানুষগুলোকে তো বলাই যায়! আমি কি তিতলীর আপন ছিলাম না? কেন ও আমাকে ওর কষ্টের কথা বলেনি? ভালোবাসা আর বন্ধনের চেয়েও কি তবে দ্বিধার শক্তি বেশি?


প্রথম ম্যাসেজটা ওপেন করলাম৷ আইডির নাম 'জোনাকির আলো'.. ফেক আইডি বোঝাই যাচ্ছে৷ ফেক আইডি থেকে আসা কেস এর আগেও সল্ভ করেছি৷ এটা আমার জন্য কোনো বড় ব্যাপার না৷ আইডির নাম যাই হোক, হোক সে পুরুষ অথবা নারী, আমার কাছে সবারই একটাই পরিচয় ..তারা সবাই তিতলী .. আমার বোন..


জোনাকির আলো লিখেছে, "সুইসাইডাল বক্স কেনা হয়তো আমার হয়ে উঠবে না আঁধার৷ তবে আপনাকে আমার গল্পটা শোনাতে ইচ্ছে হলো৷ আপনি শুনে শুধু বলবেন আমি যদি আত্মহত্যা করি কারনটা কি যৌক্তিক হবে নাকি অযৌক্তিক! এর কি কোন সমাধান সম্ভব নাকি সম্ভব নয়! ... বক্স না কিনে যদি আমি গল্পটা বলতে চাই আপনি কি শুনবেন..?"


আমি লিখলাম, "অবশ্যই শুনবো, আপনি বলুন.."


চলবে.. 


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #চতুর্থ_পর্ব

Sunday 10 September 2023

'সুইসাইডাল বক্স' (৩য় পর্ব)


সুইসাইডাল বক্স 

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ৩

_____________________


ছ'ফুট লম্বা, ভীষণ সুদর্শন অলির সেই স্বামী লোকটির মানসিক বিকারের নাম sexual sadism disorder.. যে মুহূর্তটি আনন্দের হওয়ার কথা ছিলো লোকটি তা অলির জন্য চরম ভীতিকর মুহূর্তে পরিনত করেছিলো৷ অলি যখন আমাকে কথাগুলো বলছিলো আমি ভেতর ভেতর শিউরে উঠেছি! লোকটি রাতে ব্লেড নিয়ে শুতে যেতো৷ শারীরিক মিলনে অলিকে বাধ্য করতো.. সেই সময়ে ব্লেড দিয়ে আঁচড় দিতো ওর গায়ে৷ অলি যত যন্ত্রনায় চিৎকার করতো লোকটা তত বেশি আনন্দ পেতো, অনেকটা ব্রেন অরগাজমের মতো ব্যাপারটা৷ প্রথমবার যখন অলির সাথে দেখা করলাম, আমাকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে৷ আমি একটা অনলাইন গেমের অপারেটর, যার উদ্দেশ্য সুইসাইডাল বক্স বিক্রি করা এটা একজন শিক্ষিত, বুদ্ধিমতী, ডাক্তার মেয়েকে বিশ্বাস করাতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়েছে, কিন্তু বিশ্বাস না করাতে পারলে আমার সাথে ওর দেখা করাটা সম্ভব হয়ে উঠছিলো না৷ আর যে কথাগুলো চোখে চোখ মিলিয়ে সহজে বোঝানো যায় তা কিন্তু ম্যাসেঞ্জারে বা গেমের চ্যাটবক্সে টাইপ করে বোঝানোটা সম্ভব না৷ আর সুইসাইডাল বক্সের এই নাটকটা আমি কেন করি সেটাও বলি৷ "..ধরে নিন কাউকে কিছু একটা আমি করতে বারন করবো, তাতে কি হবে জানেন? তাতে তার ঐ জিনিসের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাবে৷ নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষন আমাদের সব্বারই থাকে৷" 


আমার ধারনা, সুইসাইড যে করতে চায় তাকে যত ভাবেই বোঝানো হোক ওটা মহাপাপ, ওটা ভালো না, ওটা কোন সমাধান নয়.....দিনের শেষে এসব কোন কথাই তাদের কানে ঢুকবে না৷ কষ্টগুলো এতটাই লাগাম ছাড়া হয় যে এসব নীতিকথা, জ্ঞানের কথা, সেই কষ্টের কাছে ভীষণ তুচ্ছ মনে হয়৷ তাই যখন এমন কাউকে আমি বলি যে, আমি তোমাদের কাছে এমন একটা কিছু বিক্রি করবো যা তোমাদের মৃত্যু সহজ করে দেবে, তখন ঐ হতাশায় ভোগা মানুষগুলো উৎসাহ পায়৷ দামটাও খুব-একটা কম রাখিনি, দশ হাজার খুব ছোট অ্যামাউন্ট নয়৷ দশ হাজার টাকা জোগাড়ের জন্য বেশিরভাগ মানুষকেই ভাবতে হয়৷ অনেক বড়লোক মানুষ যারা তাদের ব্যাপার আলাদা; কিন্তু মধ্যবিত্ত মানুষগুলো তখন মৃত্যুর চিন্তা একপাশে সরিয়ে টাকার জন্য চিন্তা শুরু করে৷ টাকার জন্য চিন্তা, টাকা জোগাড়ের উপায় খুঁজে বের করা মৃত্যুর চিন্তার চেয়েও কঠিন৷ আমি এই সময়টাকেই কাজে লাগাই৷ মরতে চাওয়া মানুষটার ঠিকুজি-কুষ্ঠি, এককথায় আদ্যপান্ত খুঁজে বের করি৷ খুঁজে বের করি মানুষগুলোর আপনজন কারা... ভালোবাসার মানুষ কারা... কে দিতে পারবে একটুখানি মমতার পরশ৷ একটুখানি মমতার পরশ আর মাথার উপর রাখা ভরসার হাত যে এমন কু-চিন্তা মুহূর্তেই উড়িয়ে দিতে পারে, আর কোনোকিছুই এ ব্যথার মলম নয়, জগতের সকল ব্যথার মলম একটুখানি ভালোবাসা ...


অলি আমার সাথে দেখা করতে এলো৷ প্রথমেই অবাক হয়ে বললো  "আপনি একজন ছেলে..? আমি আশা করেছিলাম মহিলা!" আমি শুধু হেসেছিলাম, আর বলেছিলাম, "আমার নাম আঁধার.." আর কিছু বলিনি৷ সবাই এমন কেন ভাবে আমি জানি না, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম সাক্ষাতে আমাকে এই কথাটিই বলে৷ প্রথমে ইতস্তত বোধ করছিল বোধহয়, কিছুক্ষন কথা বলার পর ও খানিকটা সহজ হলো৷ ফুলস্লিভ হাতার জামা পরে এসেছিলো অলি৷ আমাকে জামার হাতা তুলে দেখালো দগদগে নতুন ঘা..! আমি ওর ফর্সা হাতে ব্লেডের ক্ষতগুলো দেখে রীতিমতো কেঁপে উঠেছিলাম৷ আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠেছিলো সে সময়৷ আমি প্রসঙ্গ বদলে ওর বাবা-মায়ের কথা জানতে চাইলে অলি নির্বিকার গলায় বললো "তারা আমাকে ত্যাগ করেছে আঁধার, তাদের সামনে দাঁড়াবার সাহস আমার নেই!" এই একটা ভুল সন্তানেরা সবসময় করে৷ তারা জানে না বাবা-মা এমন মানুষ, তারা সন্তানের পাহাড়সম অপরাধ এক নিমেষে ক্ষমা করে দিতে পারে... অলি দশহাজার টাকা বের করে আমার কাছে সুইসাইড বক্সটা চাইলো৷ আমি আমার পুরোনো ট্রিকটা খাটালাম৷ পুরোদস্তুর ব্যবসায়িকের মতো গলায় বললাম, "শিপমেন্টে আটকে আছে.. আসলে এটা তো লিগ্যালি আনার উপায় নেই, চায়না-তে তৈরি হয়৷ ওখান থেকে অনেক কায়দা করে আনতে হয়, তবে সামনের সপ্তাহেই চলে আসবে৷ আপনি অর্ধেক অ্যাডভান্স করে যান৷ আমার ডিলারকেও দিতে হবে তো, এই মুহূর্তে আমার একদম হাতখালি নাহলে অ্যাডভান্স নিতাম না ..." 


এই অ্যাডভান্সটা আমি নিই মানুষদেরকে আরো একটু দ্বিধায় ফেলতে৷ অপরিচিত একজন মানুষকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে নিশ্চয়ই কেউ নিশ্চিন্তে থাকবে না৷ তার মাথায় তখন সুইসাইডের চিন্তার পাশাপাশি ঘুরবে আরেকটা চিন্তা ...টাকার চিন্তা .... এতগুলো টাকা একজন অপরিচিত মানুষকে দিলো, টাকাটা মার যাবে না তো! জিনিসটা পাবে তো! 


আমি অলির হসপিটাল থেকে খুঁজে বের করলাম ওর আরেকজন কাছের মানুষ ডাঃ ঋতু কে৷ ডাক্তার ঋতু-র সাহায্য নিয়ে খুঁজে বের করলাম অলির বাবা-মায়ের ঠিকানা ... 


আন্টি আঙ্কেলের সামনে গিয়ে অলির কথা বলতেই আঙ্কেল দৃঢ় গলায় জানালো, "এই বাড়িতে ঐ মেয়ের নাম নেওয়া নিষেধ ...তুমি চলে যাও ..." আমি আঙ্কেলের হাত ধরে ফেললাম৷ আঙ্কেলের হাত ধরে বললাম, "আঙ্কেল, আপনাদের মেয়েটা ভীষণ কষ্টে আছে... ওর স্বামী ওকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছে.. আপনাদের মেয়েটা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছে, সুইসাইড করবে যেকোন সময়!" পাশে দাঁড়িয়ে আন্টিও কাঁদছিলেন! এবার আঙ্কেলও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন৷ তারপর তাদের বুঝিয়ে বললাম পুরো ব্যাপারটা... তাদের রাজী করালাম আমার সাথে গিয়ে অলির সাথে দেখা করতে ..


অলিকে খবর দিলাম 'সুইসাইডাল বক্স' চলে এসেছে বলে৷ অলি চলে এলো নির্দিষ্ট সময়ে৷ আমি আর এবার সামনে গেলাম না, আন্টি-আঙ্কেলকে পাঠালাম ... তাদের দেখে অলি প্রথমে খানিকটা ঘাবড়ে গেলো৷ তারপর আঙ্কেল যখন জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন এক মুহূর্তের মধ্যেই যেন বরফ গলে গেলো৷ তখন আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম অলির৷ তারপর অলির হাতে সেই অ্যাডভান্স হিসেবে নেওয়া পাঁচহাজার টাকা দিয়ে বললাম, "অলি, জীবনটা যতই জঘন্য হোক.. নিজের জন্য বাঁচো, বাবা-মায়ের জন্য বাঁচো ... গ্রুপ থেকে লিভ নিও৷ ঐ গ্রুপ আর তোমার দরকার নেই ... এ ব্যাপারে আর কারও সাথে, কোনও কথা বলবে না প্লিজ..." 


আমি চলে আসছিলাম, এমন সময় অলি দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো "আঁধার, আমি মা-বাবার একমাত্র সন্তান, কিন্তু তোমার মধ্যে আজ আমার দাদা বা ভাইকে পেলাম, ভালো থেকো..." আমার তখন মনে হলো আমার তিতলী আমাকে জড়িয়ে ধরেছে, আমার ভীষণ কান্না পেয়ে গেলো.. কিন্তু আমি কাঁদলাম না, কাঁদলে দুঃখ কমে যায়৷ আমি তো এই দুঃখ, এই শোক কখনোই কমাতে চাই না৷ এই শোক থাকুক, না হলে আমি অন্ধকারে থাকা তিতলী দের আঁধার থেকে বের করার শক্তি কোথায় পাবো! 


মিতালী গোস্বামী-র খোঁজ নিলাম৷ ভদ্রমহিলার সত্যিই কেউ নেই৷ নেই নিজের বলতে কেউ, কোন আপনজন৷ কেউ নেই অলির বাবা-মায়ের মতো তার হাত ধরার ... আমি এবার চিন্তায় পড়ে গেছি৷ কি করবো! 


অনেক ভেবে দেখলাম, যতই তার কেউ না-ই থাক, কিন্তু তার বাচ্চাটার তো মা আছে! এই মাকেই হতে হবে এতটা শক্তিশালী যেন সন্তানের ভার সে-ই নিতে পারে৷ শুধু অন্ন-বস্ত্রের জন্য যেন কারো লালসার স্বীকার হতে না হয় ঐ নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে ...


আচ্ছা, দশ হাজার টাকায় কি কোনো ব্যবসা দাঁড় করানো যায় না? নিশ্চয় যায়৷ সেটাই বরং খুঁজি৷ আত্মনির্ভরশীল হতে হবে মিতালী কে৷ হতেই হবে, হতেই হবে !


****-****


রিমার বাবা আজ বাড়িতে আছে, তার আজ ভালো লাগছে৷ একবার বাবার ঘরে ঢুঁ মারলো রিমা৷ মানুষটার সাথে কথা বললে ভীষণ শান্তি পায় রিমা, যদিও কথা হয় না বেশি৷ রিমার বাবা খুবই সল্পভাষী মানুষ; আজও রিমা বাবার কাছে গেলো ৷ 


রিমার বাবা সম্প্রতি দুটো জাহাজ কিনেছেন৷ জাহাজদুটোতে তার ইনভেষ্ট করতে হয়ে বেশ মোটা অংকের একটা টাকা৷ এ দুটো জাহাজের একটা এখন আটকা পড়েছে আটলান্টিক মহাসাগরে৷ ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে অনেক৷ রিমার বাবার প্রেসার বেড়ে গেছে৷ টাকার টেনশন বড় টেনশন! তা সে যত কোটিপতি মানুষই হোক না কেন, টাকার শোক সামলানোর মতো মানসিক শক্তি সবার থাকে না ....


রিমা এসে বসলো বাবার পাশে৷ ভদ্রলোক একটু বিরক্ত হলেন৷ এই মুহূর্তে আটকে পরা জাহাজের চিন্তা ছাড়া তার মাথায় অন্য কোন চিন্তা নেই .. তার কথা বলতেও ইচ্ছা করছে না, আর সবচেয়ে বড় কথা মেয়ের সাথে বলার মতো কোন কথাই খুঁজে পান না .. মেয়েটা বড় হয়ে গেছে৷ মেয়ের সাথে তার মানসিক দুরত্ব বেড়েছে ... এখন হঠাৎ কোন কথা বলতে গেলেই কেন যেন তার মনে হয় কথাটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে৷ বেশ গুছিয়ে তিনি অপ্রয়োজনীয় এলোমেলো কথাগুলো বলছেন৷


রিমার বাবা তাই খানিকটা বিরক্ত গলায় রিমাকে বললেন "মামনি, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি একটু একলা থাকতে চাই এখন..."


রিমা কথা না বাড়িয়ে বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো .... তারপর সোজা চলে গেলো ছাদে৷ ছাদে গিয়ে একদম কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রিমার মনে হলো "আচ্ছা, এখান থেকে লাফ দিলে কেমন হবে? বাবা জানার পর ঠিক কি কি করবে...."


কল্পনায় রিমা স্পষ্ট দেখছে, রাস্তায় উপুর হয়ে পরে আছে তার লাশ ... রক্তাক্ত.... রিমার বাবা বিরক্ত মুখে তার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে আছে...


চলবে..


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #৩য়_পর্ব

Saturday 2 September 2023

'সুইসাইডাল বক্স' (২)


'সুইসাইডাল বক্স'

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ২

_____________________


গেমের একটা পর্যায় এসে নিজে থেকে চ্যাটরুম অন হয়ে যায়.. সেই সুত্রে একটা ম্যাসেজের আংশিক ছবি!


— হ্যালো, আমি কি 'অন্ধকারের যাত্রি'র সাথে কথা বলছি! আমি সুইসাইডাল বক্সটি কিনতে আগ্রহী ৷


—আপনার নাম?


— প্রোফাইলে যেই নামটা দেওয়া আছে, মিতালী গোস্বামী৷


—প্রোফাইলে তো সবার সঠিক নাম দেওয়া থাকে না, যেমন আমার নিজেরও নেই ৷ যাই হোক, আপনি অ্যানাউন্সমেন্ট পোস্টটি পড়েছেন মন দিয়ে?


— আজ্ঞে হ্যাঁ, পড়েছি .. 


—তাহলে তো আপনি সবটাই জানেন, কি করতে হবে, আর কি করা বারণ, তাই না? 

আচ্ছা বলুন তো, কি কারনে সুইসাইড করতে চান?


— কারনটা কি বলতেই হবে? দেখুন আমার কাছে যেটা যৌক্তিক কারন, আপনার কাছে নাও হতে পারে৷ আর কারন বললেই যে আমি জিনিসটা পাবো তার গ্যারান্টি কি?


—কোন গ্যারান্টি নেই, কারনটা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হতে হবে৷ দেখুন, এটা আমার বিজনেস৷ সবার বিজনেসেরই কিছু রুলস থাকে, আমার রুলস এটাই৷ আপনি বলতে না চাইলে সেটা একান্তই আপনার ব্যাপার, তবে কারন না বললে আমি আপনার সাথে লেনদেন-এ যাবো না৷


— হুম , বুঝতে পারছি..


—বেশ, তাহলে কী ঠিক করলেন? বলতে চান নাকি চান না ..


— আমার বিয়ে হয়েছে বারো বছর আগে, আমার একটা মেয়ে আছে দশ বছর বয়সের৷ 


—তারপর..


— থাক গে, আর বলবো না! আপনাকে বিরক্ত করার জন্য সরি৷


—সরির কিছু নেই দিদি৷ তবে, বলতে না চাইলে বলতে হবে না৷


— আচ্ছা সুইসাইডাল বক্সে কি একসাথে দুজন ঢোকা যাবে? না মানে.. স্পেস কতটা?


—আজ্ঞে... যাবে বলে মনে হয়৷ 


— আমার মেয়েটাকে ওর নিজের কাকা অ্যাবিউজ করছে ... দিনের পর দিন... বাচ্চাটা আমার কেঁদে কেঁদে বলে "মা, আমার ব্যথা করে, আমার খুব কষ্ট হয় .." 


—আপনি এই সত্যিটা জানার পরেও চুপ করে আছেন? ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না!


— আমি বিধবা..  আমার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই৷ এক ভাই আছে, সেও আমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে আমাদের দায়ভার সে নিতে পারবে না৷ তাই আমাকে এ বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে৷ আমি যে কি পরিমান নিঃস্ব, সেটা আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না৷ এই বক্স কেনার টাকা কোথায় পাবো আমি তাও জানি না, তবে কোনো-না-কোনো উপায়ে জোগাড় করে ফেলবো৷ এই কষ্ট সহ্য করে বেঁচে থাকার চেয়ে, মা-মেয়ে মিলে মরে যাওয়াটাই সহজ৷ আমি একা হলে এই ঝামেলায় আসতাম না ... আমার মেয়েটা অলরেডি অনেক কষ্ট পেয়েছে, অন্তত মৃত্যুটা সহজ হোক ওর জন্য!


—কিছু মনে না করলে আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি, মানে আপনি লেখাপড়া কতদূর করেছেন?


— বি.এ. অনার্স পাশ করেছি, রেজাল্ট ভালো ছিলো না, থার্ড ক্লাস পেয়েছিলাম ৷


—রেজাল্ট টা মূখ্য বিষয় না দিদি... আচ্ছা বাদ দিন, আপনি টাকাটা কিভাবে জোগাড় করবেন বল্লেন নাতো, আমি কিন্তু দাম কমাবো না.. ফিক্সড প্রাইস৷


— এখনও ঠিক জানি না, দেখি! কিছু যদি না হয় তো স্বামীর শেষ চিহ্ন হিসেবে একটা চেন আছে সোনার, ওটাই বিক্রি করে দেবো না হয়.. 


—ঠিক আছে৷ আপনি টাকা জোগাড় করে আমাকে নক দেবেন, আজ রাখছি৷ 


— আমি তাহলে সুইসাইডাল বক্সটা পাচ্ছি তো?


—এখনই কনফার্ম বলতে পারবো না, আগে ভেরিফিকেশন করতে হবে, তারপর৷ 


— ঠিক আছে, আমি টাকা জোগাড় করেই আবার নক দেবো না হয়! 


মিতালী গোস্বামী! আমার নতুন তিতলী৷ এটাও কি সম্ভব? দশ বছরের বাচ্চাকে শারিরীকভাবে নোংরা করছে তার আপন কাকা! আর কত কষ্টকর গল্প শুনতে হবে আমাকে... আমার যে ভীষণ কষ্ট হয়, বারবারই মনে হয় আমার তিতলী-র বোধহয় এরকমই কোনও এক কষ্ট ছিলো, যা আমার জানা হয়ে ওঠেনি৷ 


আমার হাতে সময় বেশি নেই৷ আমি জানি মিতালী গোস্বামী খুব তাড়াতাড়ি টাকার ব্যবস্থা করে ফেলবে৷ মরার জন্য টাকার জোগার করতে দেরি হবার কথা নয়৷ অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে৷ যদিও দশ হাজার টাকা খুব ছোট অ্যামাউন্ট ও নয়, তবু মন বলছে দু-তিন দিন লাগবে বড়ো জোর! এর মধ্যেই আমাকে আমার কাজ করতে হবে৷ 


******


রিমার ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যেবেলার দিকে, আকাশটাতে লালচে রঙ ধরতে শুরু করেছে৷ ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দাঁড়াতেই রিমা দেখলো আনোয়ারা দাঁড়িয়ে আছে, চায়ের ট্রে হাতে করে৷ এই মেয়েটাকে মাঝে মাঝে অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা সম্পন্ন মনে হয় রিমা-র৷ রিমার ঘুম ভাঙার পর কখনোই অপেক্ষা করতে হয় না, মেয়েটা গরম-গরম চা নিয়ে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকে৷ 


চা খেতে খেতে রিমা ফোনটা অন করলো, একগাদা নোটিফিকেশন এসেছে তাতে৷ একটা নোটিফিকেশনে চোখ আটকে গেলো রিমার৷ অলি পোস্টেড ইন দি গ্রুপ "সুইসাইডাল বক্স" .. এই অলি কে রিমা জানে না৷ তবে তার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে৷ এই মেয়েটিই তাকে ঐ গ্রুপে ইনভিটেশন পাঠিয়েছিলো৷ ওখানে বলা ছিলো, যাদের দেখে মনে হয় সুইসাইড করতে চায় শুধু তাদেরই ইনভাইট করতে! কিন্তু রিমা অবাক হয় এই ভেবে, যে তার সোশ্যাল লাইফ দেখে তো এটা বোঝার উপায় নেই, যে সে সুইসাইড করতে চায়, এমনকি ও যে অ্যাটেম্পট নিয়েছিলো সেটাও তো পাবলিক করেনি! ফেসবুকে তো রিমা ভীষণভাবে সুখী৷ রিমা অলির পোস্ট চেক করে৷ তিন লাইনে অলি লিখেছে—


"অন্ধকারের যাত্রি-কে চিনেছি বলেই আজ আলোকে চিনতে পারলাম৷ তোমাকে ধন্যবাদ বলে আসলে আমার মনের কৃতজ্ঞতাবোধ প্রকাশ করতে পারবো না, তাই সে চেষ্টাও করলাম না৷ নিয়মানুযায়ী গ্রুপ থেকে চলে যাচ্ছি, ভালো থাকবেন, নমস্কার৷"


রিমা এবার একটু ঝটকা খেলো৷ 'অন্ধকারের যাত্রি' নামের ছেলে বা মেয়েটা আসলে কি এমন করেছে অলির জন্য যে অলি এতটা কৃতজ্ঞ! রিমা নিজে থেকে কখনো কাউকে নক দেয় না ইনবক্সে, এতে তার সেলিব্রিটি ইমেজটা একটু কেমন কেমন দেখায়! তবে, আজ সে নিজে থেকেই নক দিলো অলিকে.. অলি যেন জানতো রিমা নক করবে, সাথে সাথেই রিপ্লাই পেলো রিমা ওপার থেকে৷


—হ্যালো, ভালো আছেন অলি?


—আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন?


—ভালো, আচ্ছা.. আপনি আমাকে একটা গ্রুপে ইনভাইট করেছেন, 'সুইসাইডাল বক্স' নামের!


—আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি জানি আপনার সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি আছে৷ আপনি বোধহয় আমার কথা ভুলে গেছেন৷ আপনার সাথে কিন্তু আমার কথা হয়েছিলো..


—আসলে কিছু মনে করবেন না, আমি মনে করতে পারছি না! আর প্রোফাইলে ও কোনো ছবি নেই তো, ছবি থাকলে হয়তো চিনতে পারতাম৷ 


—কিছুদিন আগে আপনি ট্যাবলেট খেয়েছিলেন, তখন আপনাকে যে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছিলো আমি সেখানকারই ডাক্তার৷ হসপিটালে সাত দিন আমিই আপনাকে অ্যাটেন্ড করেছি৷ মনে পড়েছে এবার?


—ও.. আচ্ছা আচ্ছা, মনে পড়েছে৷ সরি..সরি আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম৷ আচ্ছা আমাকে বলো তো গ্রুপটার ব্যাপার কী! 


—মাফ করবেন, গ্রুপের ব্যাপারে আলোচনা করা তো একদমই নিষেধ৷ বিশেষ করে যারা গ্রুপ থেকে বেরিয়ে চলে আসবে তাদের জন্য একেবারেই নিষেধ৷


—আরে না না, কোন সমস্যা নেই, তুমি বলতে পারো, আমি কি কাউকে বলতে যাবো নাকি!


—দেখো, তুমি বরং 'অন্ধকারের যাত্রি' আইডিতে ম্যাসেজ করো, যা বলার বা করার ওনারাই করে নেবেন!


—ওসব পাগল ছাগলের সাথে কি আর কথা বলবো! থাক বাদ দাও, এই ইস্যু নিয়ে যথেস্ট ভেবে ফেলেছি৷ তুমি বলতে না চাইলে ইটস ওকে৷


—তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে, যদি কখনো আবার এমনটা হয় যে তোমার মনে হচ্ছে পৃথিবীটা বড্ড অর্থহীন, তাহলে প্লিজ ঐ আই ডি টাকে নক দিও! এটা রিকুয়েস্ট৷


—তুমিও কি সুইসাইড করতে চেয়েছিলে নাকি? 


—এসব বলা বারণ আছে রিমা! 


—ঠিক আছে, করুনাময় তার মঙ্গলময় হাত তোমার দিকে বাড়িয়ে দিক, ভালো থেকো অলি..


—তুমিও ভালো থেকো রিমা ..


রিমা-র আবার বিরক্তি লাগা শুরু হয়, অযথাই মেয়েটাকে নক করতে গেছে সে! 


**********


মিতালী গোস্বামী-র খোঁজ খবর বের করা খুব একটা কঠিন হলো না৷ আমি বরং এর চেয়েও ঝামেলা করে এর আগের ক'য়েকটা কেসের খোঁজ বের করেছি৷ যেমন আমার লাস্ট কেস অলি, কম হয়রানি হয়নি ওর ডিটেলস বের করতে৷ অলিকে যে শেষ পর্যন্ত ফেরাতে পারবো এটা আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিলো না! এর চাইতে মিতালী-র কেস সহজ হবার কথা!


অলির কথা মনে হলে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে৷ মেয়েটার সর্বনাশ করেছিলো তাকে ভালোবাসি বলা মানুষটাই৷ বাবা ছেড়ে যার হাত ধরে ঘর ছেড়েছিলো, সেই মানুষটি পেশায় একজন ডাক্তার অলির মতোই৷ একই হসপিটালে কর্মরত ছিলো দুজনে৷ অলির সেই ডাক্তার স্বামীটি এর আগেও বিবাহিত ছিলো৷ ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিলো দুজনের৷ এরপরই অলি আসে তার জীবনে৷ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে অলি৷ তার ডাক্তার হবার পথ অতোটা মসৃন ছিলো না, শুধুমাত্র বাবা-মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে অর্জিত অর্থ আর নিজের অসম্ভব রকমের মেধা অলিকে ডাক্তার বানিয়েছিলো৷ সেই অলি বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে, ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিলো সেই আরেক ডাক্তারের সাথে৷ ঘর ছাড়বার আগে অলির মা শুধু একটা কথাই অলিকে বলেছিলো "যার বউ ছেড়ে গেছে, কোন না কোন কারনেই তো গেছে! ভালোমতো খোঁজ না নিয়ে তুমি তার জন্য পাগল হয়ো না..." 


অলির তখন পাগল হবার সময়ই ছিলো৷ আমি অন্ধকারের যাত্রি হয়ে যখন শুনেছি অলির গোপনগাথা, তখন শিউরে উঠেছি ভিতরে ভিতরে ... কী নিদারুণ, কী ভয়ানক! আবার নতুন করে বুঝেছি,  বাবা-মা যা বলে ভালোর জন্যই বলে, পৃথিবীতে বাবা-মার চেয়ে আপন আর কেউ নয়৷ 


অলির স্বামীটি ছিলো একজন অসুস্থ মানসিকতার এক রোগী! ডাক্তারের সাদা অ্যাপ্রনের তলায় তার ছিলো একটা কুৎসিত, কালো, কলুষিত মন... মাথায় ছিলো বিকার! ভয়ানক! ভয়ানক সেই বিকার ...


চলবে...


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #২য়_পর্ব