Saturday, 9 December 2023

মাঝরাতের আতঙ্ক!..

 


কর্মসূত্রে প্রত্যেক ছ'মাস অন্তর বদলি অর্থাৎ জায়গার পরিবর্তন করতে হয়। দেশের নতুন নতুন স্থানে গিয়ে অফিসের অ্যাকোমোডেশন নয়তো ভাড়া বাড়িতেই উঠতে হয়, এবার অনেকের মতে কোনো বাড়ি দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে থাকলে নাকি সেখানে খারাপ কিছু এসে থাকা আরম্ভ করে। আজকাল এসব বিশ্বাস করার সময় আর হয়ে ওঠে না। আমিও এসব বিশ্বাস করতাম না, যদি না আমার সাথে সেরকম কিছু ঘটত; 

অফিসের কাছাকাছি হওয়ায় সেই পরিত্যক্ত বাড়িটা আমাকে ভাড়া নিতে না হতো। 


আমার বাড়িটা বেশ পছন্দ হয়েছিল স্বল্প বসতির এলাকায় হওয়ার জন্য; খালি ছোট ছোট ঘর-বাড়ি, পাহাড় আর বিভিন্ন জংলা গাছপালা আর খোলা আকাশের সমাবেশ, আমায় সেই ছোটবেলার মতো টেনে নিয়ে যায় হিমালয়ের কোলে। তবে পাহাড় বলতে অতো উঁচু উঁচু পাহাড় না হলেও ছোট টিলা বা ডুংগার বলা ভালো..

যাই হোক, ঘরে ওঠার কয়েক দিনের ভেতরেই সব গোছগাছ করে নিলাম। একা থাকি, নির্ঝঞ্ঝাট সব কিছু। সারাদিন অফিসে কাটিয়ে রাতটা খালি কাটাতে বাড়িতে আসা.. সপ্তাহ খানিক স্বাভাবিক ভাবেই কাটলো। এরপর এক রাতে রোজকার মতো অফিস থেকে ফিরে সব কাজ শেষ করে দরজা-জানলা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, এবার রাতে জানলায় আচমকা টোকা পড়ার শব্দে আমার ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল।


পাহাড়ের অঞ্চলে রাত ১০টা মানেই শুনশান, সেখানে ঘড়িতে দেখলাম রাত ১২ টা ২০। ঘরের একমাত্র জানলাটা আমার খাটের সঙ্গে প্রায় লাগোয়া, ঘরের দরজার মুখোমুখি উল্টো পাশে। কে যেন ডাকছে ঘরের পেছন থেকে! যদ্দুর দেখেছি, জানলার ওপাশে মানুষহীন পরিত্যক্ত বাড়িটা ছাড়া আর কোনো ঘর নেই। একরাশ বিরক্তি নিয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে রইলাম। টোকার শব্দ বদলে এবার কারো জোরে জোরে ধাক্কা দেওয়ার কারণে জানলাটা ঝনঝন করে কেঁপে উঠল। অতি প্রয়োজনের তাগিদে কেউ যেন জানলা খুলতে আবেদন করছে। আচমকা, অপ্রত্যাশিত এই ঝনঝন শব্দে বুকটা কেঁপে উঠল। ওপাশে যেই থাকুক না কেন, বেশ অধৈর্য পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, ক্রমাগত ঝনঝন করে কেঁপেই চলেছে জানলাটা। জানলা খোলার আগে আমি গলার আওয়াজ কিছুটা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কে ভাই?' সঙ্গে সঙ্গে জানলার কম্পন থেমে গেল। ক'য়েক মুহূর্ত কেটে গেল। কোনো সাড়া-শব্দও নেই। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, 'হ্যালো.. কে ওখানে, কী চাই?' আমি জানলা খুলবো কি খুলবো না ভাবছি এমন সময় আমার বুক কাঁপিয়ে দিয়ে আবার ঝনঝন করে কাঁপতে লাগলো জানলাটা। খুব জরুরী প্রয়োজন ছাড়া এমন করে এত রাতে কেউ ডাকবে না! আমি বিছানা থেকেই জানলার তিনটে পার্টের মাঝখানেরটা ধিরে ধিরে খুলতে গেলাম, উৎসুক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকালাম।


কিন্তু..


কেউ নেই জানলার সামনে। আশ্চর্য্য! 

এর মানে কী! বালিশের পাশ থেকে টর্চটা তুলে হাত বাইরে বের করে আলো এদিক সেদিক ঘোরালাম, সত্যিই কেউ নেই! জানলাটা বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়লাম। বড়ো জোর দশ-পনেরো মিনিট কেটেছে বোধ হয়, চোখ পুরোপুরি লাগেনি। আবার জানলায় টোকার আওয়াজ পড়লো, পরের মুহূর্তেই ঝনঝন করে কাঁপতে লাগলো ওটা। এবার প্রচণ্ড রাগ হলো। জানলা খুলে বাইরে তাকালাম। সেই একই অবস্থা। কেউ নেই। এবার বিরক্তির পাশাপাশি রাগও অনুভব করলাম। এত রাতে কেউ রসিকতা করছে আমার সাথে! টর্চ হাতে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। মৃদু চাঁদের আলো, উঠোনের বাল্বের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে আছে চারপাশ। এই দুতলা ঘরের উল্টোমুখে বাড়িওয়ালাদের থাকার ঘর। ওদের ঘরের সব আলো বন্ধ। শুনশান একটা ভাব। আশেপাশের সব বাড়িগুলোর ও একই অবস্থা। সামনে একটা লাঠি পড়ে থাকতে দেখে কী মনে করে তা হাতে নিয়ে ঘরের পেছনের দিকে চলে এলাম। উৎসুক ভাবে এদিক-সেদিক আলো ফেলে খুঁজে দেখলাম, কিন্তু কারও অস্তিত্বই পেলাম না।


বিরক্তি নিয়ে ঘরে ফিরতে যাবো, হঠাৎ খেয়াল করলাম পাশের পরিত্যক্ত দু-তলা বাড়িটার বারান্দার লাগোয়া ঘরটায় আলো জ্বলছে। কিছুটা অবাক হলাম। কারণ যতটুকু জানি, এই বাড়িটা দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে আছে। তাছাড়া এতক্ষণের ভেতরে, বেশ কয়েকবার বাড়িটার দিকে চোখ পড়েছিল আমার; কিন্তু, আলোটা আমার চোখে পড়েনি। আমার ঘরের জানলা দিয়ে তাকালেও পুরো বাড়িটাই প্রায় দেখা যায়। তখন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ও আলোটা দেখিনি। বাড়িতে কেউ উঠেছে বোধ হয়! টর্চের আলো গেটের উপর ফেলতেই অবাক হলাম। সেই আগেকার মতোই বড় পিতলের তালাটা লাগানো আছে ছিটকিনি-তে বাইরে থেকে। ওই রুমে তালা না খুলে কেউ ঢুকতে পারবে না। কেমন যেন একটা সন্দেহ হলো।


আমি সন্তর্পণে বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলাম। বারান্দার ঘরটার একটা কাঠের জানলা বাইরের দেওয়ালের দিকে। ওটায় ধাক্কা দিয়ে জানতে চাইলাম, 'কে আছে ভেতরে?' কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম ভেতরে কারও নড়াচড়ার শব্দ শুনে। খানিক পরেই খটখট আওয়াজ করে ওটা খুলে গেল। একটা মেয়ে, উৎসুক মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার চাউনিতে কেমন অভিভূত হয়ে পড়লাম আমি। কম্পিত গলায় বললাম, 'ইয়ে মানে.. এই বাড়িতে কেউ থাকে বলে জানতাম না, আলো জ্বলছে দেখে অবাক হয়ে এখানে এলাম..!'


মেয়েটা হাসিমুখে বলল, 'আজই আমরা এলাম! কিছুক্ষণ আগে..'


'কিন্তু গেট বাইরে থেকে তালা দেওয়া যে!'


'কই?'


আমি ঘুরে বাড়ির গেটের দিকে আলো ফেলেই বিস্মিত হলাম। একটু আগেও দেখলাম বাইরে থেকে তালা দেওয়া কিন্তু এখন তালার কোনো চিহ্নই নেই! গেটটা সামান্য ফাঁক হয়েও আছে। মেয়েটার মুখ এখনো হাসি হাসি। বলল, 'এর আগের বার যখন এসেছিলাম আপনাকে তো দেখিনি! নতুন প্রতিবেশী নাকি আপনি?'


'ওই ইয়ে.. মানে ওই ঘরটায় সপ্তাহ খানেক হবে উঠেছি। আপনাকে এত রাতে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত!' অপ্রস্তুত ভাবে জবাব দিলাম।


'..জানলায় কারো ধাক্কার আওয়াজ পেয়ে বেরিয়েছিলেন বোধ হয়..!'


আমি সামান্য মানসিক ধাক্কা খেলাম। 'আপনি জানলেন কী করে?'


'আমিও যে ঝনঝন শব্দ শুনে জানলা খুলে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। আপনার জানলার পাশে একটা অদ্ভুত ছায়ার মতো কালো কিছু দেখে ভয় পেয়ে আবার জানলাটা বন্ধ করে দিয়েছি। তারপরে এই আপনি এলেন!'


অদ্ভুত এক ভয়ের শিহরণ অনুভব করলাম আমি। মেয়েটা বলল, 'এসেছেন যখন ভালোই করেছেন, একটা উপকার করে দিয়ে যাবেন, প্লিজ? একটু ভেতরে আসুন..'


এই বলে জানলাটা বন্ধ করে দিল হুট করে, আবার পরমুহূর্তেই বারান্দার আলো জ্বেলে উঠল। গেটটার অর্ধেক নিশ্ছিদ্র লোহা আর বাকি অংশ গ্রিলের হওয়ায়, বারান্দার আলো গেট ভেদ করে বাইরে আসছিল। আমি হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর প্রবেশ করলাম ভেতরে ওনার আমন্ত্রণে, ওনারই সঙ্গে..


পরিত্যাক্ত বাড়ি বলতে এটা খুব সাদা-মাটা একটা দু-তলা বাড়ি। দুটো বেডরুম পাশাপাশি। রুম থেকে বের হলেই ডান পাশে বাথরুম ঘর এবং বাম পাশে আরেকটা ছোট হল ঘর। যেই ঘরের জানলা খুলে মেয়েটা আমাকে আসতে আহ্বান করলো।


বারান্দার ঘরটিতে উঁকি মেরে দেখলাম মেয়েটি নেই। আশ্চর্য্য! ডান পাশের বেডরুমের ভেতর থেকে ডাক এলো মেয়েটির মিষ্টি আওয়াজে, 'ভেতরে আসুন!' আমি কিছুটা সংকোচ নিয়ে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। ঘরের বাল্ব বন্ধ। টর্চের আলোতে ঘরটা ভরে উঠল। আমার থেকে কয়েক হাত দূরেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা এগিয়ে এসে একটা চেয়ার ইঙ্গিত করে দেখিয়ে আমার হাতে একটা বাল্ব ধরিয়ে দিয়ে বলল, 'এটা একটু লাগিয়ে দিন না! এটার জন্যে খুবই জ্বালাতনে পড়েছি। পুরো বাড়িতে কোনো টর্চ নেই।' একুশ বাইশ বছরের একটা মেয়ে। শাড়ি পড়ে কেমন অপ্সরার মতো লাগছে তাকে। বুকের ধুকপুকানি সামান্য হলেও বেড়ে গেল।


আমি চেয়ারে উঠে বাল্বটা লাগানোর চেষ্টা করলাম। বেশ উপরে হোল্ডার হওয়াতে সামান্য বেগ পেতে হলো। কাজটা করতে করতে কৌতূহল বশত জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনি কী একা এসেছেন?' এবার আমার পুরো শরীর জমিয়ে দিয়ে একটা পুরুষালি গলা ঘর ভরে গমগম করে উঠল, 'আমরা একা কোথাও যাই না! তোরও একা অপরিচিত ঘরে ঢোকা উচিত হয়নি!' আমার হাত থেকে বাল্ব আর টর্চ দুটোই ফস্কে পড়ে গেল। আতঙ্কে শিউরে উঠে নিচে তাকালাম। টর্চটা বন্ধ হয়ে পুরো ঘর তিমিরে ডুবে গেল। তখনই মেয়েটা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখান থেকেই জ্বলজ্বলে আগুনের শিখার মতো দুটো চোখ জ্বলে উঠল। সেই শিখার আলোতে যে মুখটা দেখলাম এটা কোনো মানুষের মুখ হতে পারে না! ওটার কোনো নাক কিংবা মুখ নেই! গোল মুখটার মাঝামাঝি ফুঁড়ে বেরিয়ে আছে দুটো আগুনের শিখার চোখ। গলার সামান্য নিচে একটা ফাঁক। মনে হলো ওটাই ওর মুখ। চিৎকার করার জন্য আমার সমস্ত শরীর জুড়ে চেষ্টা করে উঠল। 


চিৎকার করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু গলা দিয়ে টুঁ শব্দটি বের হলো না। উল্টে পা ফস্কে চেয়ার থেকে মেঝেতে পড়ে গেলাম উপুড় হয়ে। অল্পের জন্য মাথাটা মেঝেতে ঠুকতে ঠুকতে ঠুকলো না। আমি ঘুরে মেয়েটার দিকে তাকালাম। ওটার চোখ থেকে বিচ্ছুরিত আলোই ওটার অবয়ব মেলে ধরলো আমার চোখের সামনে।


ওটার লোমশ সারা শরীর গিজগিজ করছে অদ্ভুত এক প্রকার সাদা পোকায়। অনেকটা কেঁচোর মতো দেখতে ওগুলো। ওগুলো এগিয়ে আসছে আমার দিকে। ভয়ে আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে, ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলাম দুটো পা-ই বেশ ভালো রকম মচকে গেছে। পালানোর কোনো উপায় নেই.. কিন্তু কী এটা! ভ্রম..!


এবার নিজের সব শক্তি খরচ করে একটা চিৎকার করলাম। নিজের মুখ থেকে বের হওয়া বিকট চিৎকার পুরো ঘরময় এমন ভাবে অনুরণন খেয়ে কেঁপে উঠল যে নিজেই চমকে উঠলাম। মেয়েটার হাত থেকে বাল্বটা নেওয়ার আগে হাতে করে আনা লাঠিটা মেঝেতে ফেলে ছিলাম। অন্ধকার হাঁতড়ে ওটার নাগাল পেলাম। অদ্ভুত প্রাণীটার শরীর ঝুঁকতে লাগলো আমার দিকে। লোমশ শরীরের আড়াল থেকে ওর দুটো হাত উন্মুক্ত হয়ে গেল আমার সামনে। লাঠিটা সজোরে এগিয়ে এনে আঘাত করলাম ওটার বুক বরাবর। ওটা অশরীরী নয়! সামান্য আর্তনাদ তুলে পিছিয়ে যেতে লাগলো ওটা পেছনে। আমি আবার চিৎকার করলাম। শরীরে সামান্য যে শক্তি ছিল তার সাথে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে হাতের উপর ভর দিয়ে মেঝে টেনে টেনে শরীরটাকে বারান্দায় এনে হাজির করলাম। বারান্দার বাল্বটাও বন্ধ হয়ে আছে। কয়েকজন মানুষের ছুটে আসার আওয়াজ পেলাম। আমার চিৎকার কাজে লেগেছে। আমার বাড়িওয়ালা সহ আশেপাশের অনেকেই গেটের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো। একসাথে কয়েকটা টর্চের আলো আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিল।


কিন্তু... 


তারা কেউ ভেতরে আসতে পারলো না। কারণ গেটটা বাইরে থেকে তালা দেওয়া। তারা বিস্মিত হয়ে বাইরে থেকে চেঁচাতে লাগলো, জানতে চাইলো কী করে আমি ভেতরে ঢুকলাম তালা না খুলে! আমাকে এমন কাহিল অবস্থায় দেখে তারাও ঘাবড়ে গেছে। অবশ্য, তারা বেশিক্ষণ লাগালো না তালাটি ভেঙে আমাকে উদ্বার করতে। কোনো জবাব দেওয়ার মতো অবস্থায় আমি ছিলাম না। চোখ দুটো বন্ধ করলাম। এক মৃত্যু আতঙ্ক আমার শরীরটাকে পুরোপুরি অবশ করে ফেলেছিল। 


পা দুটো সম্পূর্ণ ভালো হতে প্রায় মাস পেরিয়ে গেল। আমি অবশ্য ঘটনার পরের দিনই সেই ঘর, সেই এলাকা ছেড়ে ভয়েই এক প্রকার পালিয়ে এসেছিলাম। সেই বীভৎস, ভয়ঙ্কর চেহারা আর শরীরটা বা রাতের কথা যখনই মনে উদয় হতো, আমার গোটা শরীরটা কেঁপে উঠত। কত রাতে দুঃস্বপ্নে এসে যে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল ওই প্রাণীটা... কী বলব! এরপর থেকে আজ পর্যন্ত অন্ধকারের ভীতি দূর করতে পারিনি আমি, এখনো আলো জ্বেলে ঘুমাতে হয় আমাকে। 


যেই লোকগুলো সেইরাতে আমাকে উদ্ধার করেছিল তাদেরকে আমার কাহিনী বললে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেনি তখন, আবার আমিও যে কিভাবে বাড়িতে ঢুকেছিলাম সেই কিনারাও করতে পারেনি। অনেক বছর পর যখন সেই এলাকায় আবার ফিরে গিয়েছিলাম তখন জানতে পারি আমি চলে যাওয়ার পর থেকে ওই বাড়িটার উত্তরাধিকারীরা ওখানে ফিরে এসে পরিত্যক্ত বাড়িটা ভেঙে বহুতল বিল্ডিং করার আগে পর্যন্ত সেই বাড়ির আশেপাশের অনেক ঘরের লোকেরাই মাঝরাতে জানলায় টোকা বা ধাক্কানোর আওয়াজ পেয়েছিল। কেউ কেউ মাঝরাতে সেই পরিত্যক্ত বাড়ির ঘরে আলো জ্বালা অবস্থাতেও দেখেছে। কয়েকজন তো একটি রূপসী মেয়ের অবয়বও দেখেছিল খোলা জানালা দিয়ে। আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা জেনে অনেকেই আগের থেকে সতর্ক থাকায় বিপদে পড়েনি যদিও.. 


অবশ্য, আমি যা দেখেছিলাম সেরাতে, সেই দৃশ্যটা অন্য কেউই দেখেনি। আমি চাইও না ওটা আর কেউ দেখুক। চাই না, যেন কারও ঘরের জানলায় মাঝরাতে পড়ুক অন্য জগতের, অচেনা কারও টোকা..! 


(সমাপ্ত) 


#মাঝরাতের_আতঙ্ক 


লেখা: #উষস_চট্টোপাধ্যায়

Saturday, 2 December 2023

সুইসাইডাল বক্স (শেষ পর্ব)..

 


সুইসাইডাল বক্স

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ১০ / অন্তিম পর্ব

_____________________


সবকিছু রিমার চোখের সামনে ভাসছে৷ রিমার মাথাটা ভীষণ ঘোরাচ্ছে৷ ভীষণ ক্লান্তি লাগছে, মনে হচ্ছে এই ঘাসের মধ্যেই শুয়ে পড়লে আরাম পেতো সে ....


তারপরও সে সেখান থেকে উঠে দাঁড়ায়৷ ভালো লাগছে না এই খোলা হাওয়াও তার! মনের মধ্যে অশান্তি থাকলে কি আর খোলা হাওয়ায় মন জুড়ায়? 


কলেজ স্কোয়ারে-র কাছে সিগন্যালে গাড়িটা থেমে আছে৷ কিন্তু... এ..এ কীভাবে সম্ভব..?

গাড়ির জানালা দিয়ে রিমা স্পষ্ট দেখছে সমাপ্তি বই দামাদামি করছে৷ ফুটপাতের বইয়ের দোকানে দাঁড়ানো লাল শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা ছেলেটা পুরো সমাপ্তি-ই তো! এই মুখ চিনতে রিমার ভুল হবার কথা নয়৷ তারপরও নিজের চোখ আবার কচলে নেয় রিমা৷ ভুল দেখছে না তো সে! না না...! এই তো সমাপ্তি ... সমাপ্তি কি তাহলে বেঁচে আছে, লোকের চোখে ফাঁকি দিতে ছেলের রূপ ধারণ করেছে কি!?


রিমা দ্রুত গাড়ির দরজা খুলে ছেলেটির কাছে গিয়ে দাঁড়ায় ... 


তারপর গলায় একগাদা বিস্ময় নিয়ে বলে "সমাপ্তি না..."


ছেলেটি রিমার দিকে ঘুরে তাকাতেই জ্ঞান হারিয়ে ধপাস করে সেখানে পরে যায় রিমা ...


**********


হঠাৎ করে এমন সব ঘটণা আমার সাথেই কেন হয় কে জানে! মেয়েটার এখনো জ্ঞান ফেরেনি৷ খুব বড়লোকের মেয়ে বোঝা যাচ্ছে৷ মেয়েটির বাবা এসেছে, তারপর থেকে এখানে ডাক্তার-নার্সদের ছোটাছুটি বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে৷ 


আমি এখন এখানে বসে থাকবো না কি চলে যাবো সেটাও বুঝতে পারছি না; আমার আসলে কি করা উচিত? মেয়েটা বোধহয় তিতলী-র পরিচিত৷ আমাদের একই রকম চেহারা হওয়ায় ও আমাকেই তিতলী ভেবেছে৷ মৃত একজন মানুষকে চোখের সামনে জলজ্যান্ত দেখে বোধহয় মেয়েটা নিজেকে সামলাতে পারেনি৷ আমি ওকে এটুকুও বলার সুযোগ পেলাম না যে আমি সমাপ্তি নই বা ওর কোন রূপ ও ধারণ করিনি! আমি ওর-ই জমজ ভাই অমিত, সমাপ্তি নই..


আমার ভীষণ মন খারাপ লাগছে৷ তিতলী আর আমার কলেজ পর্যন্ত একসাথেই পড়াশোনা ছিলো৷ তারপর তিতলী চান্স পেয়ে গেলো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর আমি ভর্তি হলাম অ্যামিটি কলেজে৷ কলেজ পর্যন্ত আমাদের বন্ধুবান্ধব সেম থাকলেও হায়ার স্টাডিতে গিয়ে ওর অনেক নতুন নতুন বন্ধু হয়েছিলো৷ ও যে রকম প্রানবন্ত মেয়ে ছিলো, সবার সাথে বন্ধুত্ব করতে পারতো এক নিমেষেই, এতই মিশুকে ছিলো!


এই মেয়েটাও বোধহয় তিতলীর ফ্রেন্ড ই হবে৷ আমার বোধহয় ওর জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করাই উচিৎ!


***********


রিমার জ্ঞান ফিরলো দীর্ঘক্ষণ পর৷ রিমার বাবা ওর মাথার কাছেই বসে ছিলো৷ ভদ্রলোক কান্নাকাটি করেছেন চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে৷ চোখ মুখ কেমন ফুলে আছে! রিমা ধীরে ধীরে বললো "স..মা..প্তি.."


রিমার বাবা ডেকে পাঠালেন সেই ছেলেটিকে, যে ছেলেটা ড্রাইভারের সাহায্য নিয়ে রিমাকে হাসপাতাল পর্যন্ত এনেছে! 


রিমা আর ছেলেটি এখন মুখোমুখি ...


—কিন্তু.. এ কী করে সম্ভব, এ তো সমাপ্তির মুখ, পুরো সমাপ্তি!


—আপনি ভুল করছেন৷ আমি অমিত ওরফে রণি, ওর জমজ ভাই৷ সমাপ্তি আমদের ছেড়ে চলে গেছে দু'বছর আগে ..


এটুকু শুনতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে রিমা৷ তারপর প্রথমবারের মতো নিজ মুখে তার বাবা আর রণির সামনে স্বীকার করে সবটা ...


রণি যা স্বপ্নেও ভাবেনি, তাই হলো আজ! 


তার সামনে হাসপাতালের সাদা চাদরে ঢাকা দিয়ে শোয়ানো মেয়েটি আসলে তার বোন তিতলী-র খুনী! 


দুই হাত জোর করে ক্ষমাপ্রার্থনা করছে খুনী মেয়েটি! 


রিমার দিকে তাকিয়ে রণি বলে "তোমার কি মনে হয় না পুলিশের কাছে ব্যাপারটা বলা উচিত? নিজের ভাগের শাস্তিটা ভোগ না করলে শান্তি তে বাঁচতে পারবে তো..?" 


**********


রিমার বাবা কাঁদছে.. 


সময়ের ব্যবধানে পুলিশ হাসপাতালে এসে স্টেটমেন্ট নিচ্ছে রিমার, সে আকুল হয়ে কাঁদছে..


আরেকজন আজ উদাসীন হয়ে কাঁদছে, সে রণি, ওরফে আঁধার ...আজ সে জানে তার তিতলী কেন তাদের ছেড়ে চলে গেছে ..!


                                      (সমাপ্ত)


         #ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #শেষ_পর্ব

Saturday, 11 November 2023

সুইসাইডাল বক্স (পর্ব: ৯)

 


সুইসাইডাল বক্স

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ৯

_____________________



"..সন্তানেরা মাঝে মধ্যে ভীষণ স্বার্থপর হয়, আপনার সন্তানেরা ও স্বার্থপরতা-র পরিচয় দিচ্ছে! যাদের জন্য আপনি জীবন দিয়ে দিচ্ছেন, তারা আপনাকে বোঝেও না৷ সে যাই হোক, আমি আপনার জায়গায় হলে প্রথমেই ওদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা বন্ধ করে দিতাম৷ আমার ধারনা, আপনি প্রতিদিন একাধিকবার চেষ্টা করেন তাদের সাথে কথা বলার৷ আমি বলবো, আপনি ওদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা বন্ধ করে দিন৷


নিজের মতো করে বাঁচতে শিখুন, অনেক করেছেন অন্যদের জন্য; এবার নিজের জন্য কিছু করার সময়৷ সারাজীবন তো স্বামী-বাবা-সন্তানের হয়েই বাঁচলেন, জীবনের বাকী দিনগুলো না হয় স্বার্থপর মানুষ হয়ে বাঁচুন ... আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইলো "


ম্যাসেজ সেন্ড করে আমি সজল অধিকারী-র আইডি ঘেঁটে ঘেঁটে তার দুই ছেলেমেয়ের আইডি বের করে ফেললাম৷ তারপর তাদের ম্যাসেজে লিখে দিলাম; 


"আপনার বাবা, একজন বাবা হবার আগেও একজন মানুষ৷ আপনাদের মতো সব চাহিদাই তারও আছে৷ সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তাও আছে৷ মানসিক, শারীরিক দু'রকম চাহিদাই তার আছে৷ না কি বাবা বলে তার কোন চাহিদা থাকাটা অন্যায়? এভাবে দিনের পর দিন একজন বৃদ্ধ মানুষকে কষ্ট দিচ্ছেন, জানেন তো karma never loses an address! আজ যা আপনার বাবার সাথে করছেন ঠিক তাই আপনি ফেরত পাবেন না কে বলতে পারে? 


প্লিজ, আপনার বাবাকে বাবা না ভেবে একজন মানুষ হিসেবে ভাবুন আগে৷ মানুষটা কষ্ট পাচ্ছে, আপনি কি জানেন উনি ইদানীং আত্মহত্যার কথা ভাবছেন?"


সেম ম্যাসেজ কপি করে ওনার দুই সন্তানকেই পাঠালাম৷ হয়তো আমার ম্যাসেজ খুলেও দেখবে না, স্প্যাম ম্যাসেজে পরে থাকবে৷ তারপরেও করলাম৷ 


সন্ধ্যায় অবাক হয়ে দেখলাম ম্যাসেজ এসেছে সজল বাবুর মেয়ের আইডি থেকে৷ আমাকে লিখেছেন 


"আঁধার, আপনার গ্রুপ সম্পর্কে আমি জানি৷


আপনি যেভাবে বলছেন আমি আসলে ঠিক সেভাবে ভাবিনি, শুধু নিজের দিকটাই ভেবেছি৷ ভেবেছি, স্বামীর কাছে, শ্বশুড়বাড়ির কাছে ছোট হয়ে যাবো না তো? সবাই মন্দ বলবে ... আমি অধম সন্তান তাই বাবার কষ্টটা বুঝিনি৷ আমি অবশ্যই বাবার সাথে কথা বলবো৷ দাদাকেও বোঝাতে চেষ্টা করবো৷ 


আপনার গ্রুপটার জন্য খুব খারাপ লেগেছে৷ কেউ কিছু ভালো করতে চাইলে সবাই যেন তার পেছনেই লাগে৷ তবে আমার বিশ্বাস এমন একটা দুটো গ্রুপের চলে যাওয়া আপনার সদিচ্ছাকে শেষ করে দেবে না, আপনার জন্য শুভকামনা ..."


আমি কিছু বললাম না, শুধু একটা স্মাইলি পাঠিয়ে দিলাম রিপ্লাই তে৷ উনি নিজেই যখন বুঝতে পেরেছেন আমার আর কথা বলার দরকার কি!


পরদিন সকালে সজল বাবুর ম্যাসেজ পেলাম আবার৷ তিনি লিখেছেন- 


"আপনি বোধহয় এনজেল হয়ে এসেছেন আমার জীবনে.. আমার মেয়েটা একটু আগে আমাকে কল করেছিলো৷ খুব কাঁদলো, সরি বললো .. বললো ওর দাদাও আমার সাথে আবার যেন আগের মতো সহজ হয়ে যায় সেই ব্যবস্থা করবে৷ আপনি কি করেছেন জানি না, কিন্তু আমার মন বলছে এর পেছনে কলকাঠি আপনিই নেড়েছেন! নয়তো এত দিনেও যা পারিনি একদিনে তা কিভাবে হলো৷ আপনার জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা থাকলো৷ এখন থেকে আমার প্রত্যেক প্রার্থনাতে আপনি থাকবেন ..."


আমি এবার ও কিছু বললাম না৷ শুধু একটা স্মাইলি দিলাম৷ এবার আসলে আমার বলার কিছু ছিলোও না ..শুধু গলার কাছটায় কেমন যেন একটা দলা পাকানো অনুভূতি হলো৷ 


*********


রিমা আজ বেরিয়েছে অনেক দিন পর৷ দীর্ঘদিন ঘরে থাকতে থাকতে রিমার নিঃশ্বাস কেমন বন্ধ হয়ে আসছিলো৷ আজ তাই গাড়িটা নিয়ে বের হয়েছে৷ ড্রাইভারকে নেওয়ার ইচ্ছে ছিলো না, কিন্তু তার একা বের হওয়ার উপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা আছে তার বাবার.. 


কোথায় যাবে রিমা জানে না৷ ইউনিভার্সিটির দিকে যাওয়া যায়৷ সেকেন্ড ইয়ারের পর আর পড়াশোনা করেনি রিমা, আর কলেজেতে যায়নি৷ ওর কাছে ওই জায়গাটাই বিষাক্ত লাগতো ...


হঠাৎ করে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে রিমার বাবা খুব রাগ করেছিলো৷ কিন্তু রিমা নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলো৷ ও আর পড়বে না ...


ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে একটু খোলা জায়গা দেখে রিমা সেখানে ঘাসের উপর বসে পড়লো৷ ও যেখানে বসেছে সেখান থেকে সেই জায়গাটা দেখা যাচ্ছে যেখানে শৌভনিক আর সমাপ্তি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতো৷ রিমা যেন সব দেখতে পারছে ... চোখের সামনে সবটাই কেমন যেন দৃশ্যমান! 


সেদিন যখন শৌভনিকের বুকের মধ্যে বরফের মতো মিশে যেতে দেখেছিলো সে সমাপ্তিকে, সেদিন ওর মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিলো; ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ এ সবকিছুর উর্দ্ধে চলে গিয়েছিলো সে৷ মনের মধ্যে হিংসার দগদগে ঘা ... ভয়ঙ্কর সেই ঘায়ের যন্ত্রনা ... 


সেদিন বাড়ি ফিরে রিমা একটা সিদ্ধান্ত নেয়৷ যা হওয়ার হবে, এদের দুজনকে আলাদা সে করবেই ... সমাপ্তি-র একটা ছবি জোগাড় করে সে৷ তারপর সেই ছবিটাকে ফটোশপের নিপুন দক্ষতার সাথে জুড়ে দেয় আরেকটা ছেলের ছবি৷ তারপর একগাদা নোংরা কথা লেখে সমাপ্তির সম্পর্কে; প্রমান করতে সমাপ্তি চরিত্রহীন! সেই চিঠি সে টাইপ করে যাতে হাতের লেখা বোঝা না যায়৷ তারপর দু-কপি করে এক কপি পাঠায় শৌভনিকের কাছে আরেক কপি ওর বাড়িতে তার বাবার কাছে!


শৌভনিক হয় তো ব্যাপারটাকে ইগনোর করতো, কিন্তু পরিবারের চাপে সে সমাপ্তির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে৷ হাসিখুশি প্রাণোচ্ছ্বল সমাপ্তি এরপর থেকে একদম চুপচাপ হয়ে যায়! রিমা সেই নিষ্প্রাণ সমাপ্তি কে দেখে মনে মনে পুলকিত হয়ে যায়!


রিমার মনের ক্ষতটা যেন ওদের আলাদা করেও শুকায়নি৷ এবার সে সমাপ্তির আরো একটা ছবি এডিট করে, নোংরা একটা ছবিতে রূপান্তরিত করে সেই সাধাসিধে সাধারণ ছবিকে৷ তারপর ক্লাসের প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ের কাছে সেটা পৌঁছাবার ব্যবস্থা করে খুব যত্ন করে, যেন কেউ না বোঝে কাজটা কে করছে! 


রিমা ভেবেছিলো মেয়েটা এতে অপমানিত হবে! সবার কাছে ঘৃণার পাত্রী হবে, হলোও তাই ..


কিন্তু এরপর কি হতে পারে একুশ বছরের রিমার মাথায় সে পর্যন্ত চিন্তা যায়নি৷ প্রচন্ড রকম অপমানিত হওয়ার পর সেই ধিক্কার, সেই ঘৃণা সহ্য করতে পারেনি সমাপ্তি ... ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে নিজের জীবনটা শেষ করে দিয়েছে সে... 


এত কিছুর পর শৌভনিকও তার হয়নি৷ শৌভনিক কে তার বাবা মা বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে সমাপ্তির মৃত্যুর পর৷ রিমা না পেয়েছে শৌভনিক কে, না পেয়েছে সুখ! শুধু হিংসার আগুনে জ্বলে-পুড়ে একটা তরতাজা প্রানের খুনী হয়েছে সে ...


চলবে..


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #পর্ব_৯

Saturday, 4 November 2023

সুইসাইডাল বক্স (পর্ব: ৮)


 

সুইসাইডাল বক্স

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ৮

_____________________



..গ্রুপটা বন্ধ করলেও ইনবক্সে ম্যাসেজ আসা বন্ধ হলো না৷ ফেসবুকে এখন আমার গ্রুপটা নিয়েই তোলপাড় চলছে৷ অনেকেই সাপোর্ট করে পোস্ট দিচ্ছে, তারা গ্রুপটি আবার ফিরে পেতে চায়৷ নেগেটিভ পোস্টেরও অভাব নেই৷ তারা বলছেন সবটাই ব্যবসা .. আমি মিতালী দি-কে বললাম সবটা৷ দিদি বলেছিলেন দেখো, গ্রুপ থামলেও আঁধারের পথচলা থামবে না৷ হলোও তাই৷ আসলেই অভিজ্ঞতা একটা বড় জিনিস৷ মিতালী গোস্বামী জীবন যুদ্ধে অভিজ্ঞ৷ আসলে একটু দেরি হলেও, আমি নক পেলাম আবার ..


নক দিয়েছেন একজন মাঝ বয়সী ভদ্রলোক৷ নাম সজল অধিকারী৷ উনি লিখেছেন—


"আপনার কথা এক বন্ধুর থেকে শুনেছি, এও শুনেছি সুইসাইড বক্স আপনি কখনোই বিক্রি করেননি৷ বরং আপনি সবার ভালো চেয়েছেন, আত্মহত্যার থেকে ফেরাতে চেয়েছেন এবং কয়েকবার সফলও হয়েছেন৷ আপনার উদ্দেশ্য মহৎ হলেও আসলে আপনার উপস্থাপনটা খানিকটা দৃষ্টিকটু ছিলো.. অন্তত যারা প্রথমবার দেখবে তাদের জন্য৷ কিছু মনে করবেন না, আমি শুধু আমার মনের কথাটাই বললাম৷ 


আমি সজল অধিকারী, সরকারী চাকুরিজীবী৷ বয়স ৫৮ বছর৷ হয়তো ভাবছেন এত বয়সী একজন মানুষ আপনাকে কেন ম্যাসেজ করলো! তার আগে বলে নিই, আমি ফেসবুক ব্যাপারটা এত ভালো বুঝি না, ছেলে-মেয়েরাই শিখিয়েছে৷ তবে, বেশ কিছু বছর যাবৎ, আমার ছেলে-মেয়েরা দেশের বাইরে থাকে৷ এখন ওদের ছবি দেখাই আমার প্রধান উদ্দেশ্য৷ ইদানীং আপনার গ্রুপ নিয়ে এত বেশি সবাই লিখছে যে আমিও দেখলাম৷ সেখান থেকেই আপনাকে জানা আসলে৷ যাই হোক, যে সুইসাইড বক্সের অস্তিত্বই নেই আমি সেটা কিনতে চাই না৷ তবে, এটাও ঠিক আজকাল আর বাঁচবার ইচ্ছে হয় না৷ 


আমার স্ত্রী গত হয়েছে পনেরো বছর আগে৷ দুই ছেলেমেয়ে আমার, ও কারোই প্রতিষ্ঠা বা বিয়ে দেখে যেতে পারেনি৷ ছেলেটা বিদেশে পড়তে গিয়ে সেখানেই স্থায়ী হয়ে গেলো৷ মেয়েটার বিয়ে দিয়েছিলাম দেশেই৷ চেয়েছিলাম একটা সন্তান অন্তত কাছে থাক, সেও চলে গেলো ... 


এখন আমার দিন কাটে এই স্মার্টফোন নিয়েই৷ যতক্ষন অফিসে থাকি, ভালো থাকি৷ বাড়িতে ফিরলেই শূন্যতা আমাকে গ্রাস করে৷ এই নিস্তব্ধতা সহ্য করা আমার জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো৷ আমার এখন কথা বলার একজন সঙ্গী প্রয়োজন৷ অনেক ভেবে চিন্তে তাই দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবি৷ 


একটা বয়সে ছেলে-মেয়েরা বাবা মায়ের গার্জেন হয়ে যায়, আমার ছেলে মেয়েরাও তাই হয়েছে। আমি প্রথমেই কথাটা বললাম আমার মেয়েকে৷ ভাবলাম, ওই আমার সবচেয়ে বেশি আদরের, ও নিশ্চয় বুঝবে৷ কিন্তু ফলাফল হলো ভিন্ন৷ ও কেঁদে-কেঁটে একাকার অবস্থা করে ফেললো৷ জামাই আমাকে বললো "বাবা আপনার বয়স হয়েছে, এখন ধর্ম কর্মে মন দিন৷" সকাল-সন্ধ্যা দুবেলা আহ্নিক করি আমি, পৈতা হওয়ার পর সেই অভ্যাস বাদ দিইনি কখনো৷ আমি যুবক বয়সেও যেমন ধর্ম কর্ম করেছি এখনও তাই করি৷ আমি জানি কোথাও আমার দ্বিতীয় বিয়েতে মানা করবার কেউ নেই৷ তারপরও সবার আপত্তি... আমি আর কথা বাড়ালাম না৷ আমার দুই ছেলে-মেয়েকে বললাম৷ ওরা অবশ্য কাঁদলো না তবে চিল্লামেল্লি করলো অনেক৷ এমনকি এটাও বললো, আমার নাকি ভীমরতি হয়েছে৷ আমার চরিত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে, আরো অনেক কিছু, তাই, আমি আর এ বিষয়ে কথা বাড়ালাম না৷ 


আমার নিজেরও মনে হলো নাতি-নাতনি হয়ে গেছে এখন আর এসব মানায় না, কিন্তু আমার একাকীত্ব কমলো না৷ সারাজীবন রাত দশটার মধ্যে যে মানুষটা ঘুমাতাম, রাতের পর রাত তার বিনিদ্র রজনী কাটতে লাগলো৷ 


অফিসের কলিগদের সাথে ব্যাপারটা শেয়ার করলাম৷ তারা সবাই বললো আমার বিয়ে করাই উচিত৷ ছেলে মেয়ে তো আর কাছে এসে থাকছে না বা আমাকে ওদের কাছে নিয়ে যাচ্ছে না৷ তাই, ওদের কথা না ভেবে আমার বিয়ে করাটাই যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করলো সবাই৷ 


তারাই আমার জন্য মেয়েও দেখলো৷ একজনকে আমারও পছন্দ হলো৷ বিধবা, নিঃসন্তান৷ বয়স ৪০+ .. বলা যায় আমার অর্ধেক বয়সী, কিন্তু বয়সটা নিয়ে আমার একটু সংশয় ছিলো৷ বিয়ের কথা বলার আগেই তাই আমি মেয়ের সাথে সরাসরি কথা বললাম৷ তাকে বললাম, "আপনি কম বয়স্ক কাউকে বিয়ে করতে পারবেন৷ আমি যথেষ্ট বয়স্ক, আমার মৃত্যুর পর আপনাকে অনেটা জীবন একা থাকতে হতে পারে৷" উনি বললেন "সমবয়সী-কেই বিয়ে করেছিলাম, তারপরও সে তো চলে গেলো! কখন, কার মৃত্যু হবে কে বলতে পারে! আপনার আগে আমিও চলে যেতে পারি .." 


বুঝলাম তার আপত্তি নেই৷ আমার কলিগদের উপস্থিতিতে, একদম ঘরোয়াভাবে আমি বিয়ে করে ফেললাম৷ 


সমস্যাটা শুরু হলো তারপর থেকেই৷ চিরকাল শুনেছি পিতা-মাতা সন্তানকে ত্যাজ্য করে, আমার ক্ষেত্রে ঘটনা হলো উল্টো৷ আমার দুই সন্তান আমাকে ত্যাজ্য করলো৷ গত ছয়-সাতমাসে তারা আমার সাথে কোন যোগাযোগ করেনি, আমি করতে চেয়েও পারিনি৷ আমার বর্তমান স্ত্রী সঙ্গীতা-ও অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু আমার দ্বিতীয় বিয়ের অপরাধ ক্ষমা করছে না তারা৷ 


আমার আজকাল কিছুই ভালো লাগে না৷ আমার এখন সর্বক্ষনের কথা বলার মানুষ আছে, আমার অসুখে সেবা করার মানুষ আছে, আমার জন্য ঘরে অপেক্ষা করা মানুষ আছে .. তারপরেও আমার ঘুম হয় না রাতে! আমি সারা রাত জেগে বসে থাকি৷ ফেসবুকে আমার ছেলেমেয়েদের হাসিখুশি ছবি দেখি .. ওদের ছবিতে হাত বুলাই ..


আমি কি জীবনকে আরেকটা সুযোগ দিয়ে খুব বেশিই অন্যায় করে ফেলেছি, যে অন্যায় ক্ষমার ও অযোগ্য?"


আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম৷ আমার মায়ের কথা মনে হলো৷ মানুষটা তার সারাটা জীবন শুধু আমাদের কথাই ভাবলো৷ আমরা বিনিময়ে তাকে কি দিলাম? সন্তানেরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বড্ড বেশি স্বার্থপর হই৷ তিতলী তো চলেই গেলো, আমারও একসময় বিয়ে হবে৷ তখন আমাকে ও ব্যস্ত হতে হবে তাদের জন্য, হয়তো আলাদা সংসারে যেতে হবে না তবু আরেকটা সংসারের চাপ৷ তখন মায়ের কি হবে? কিভাবে থাকবে মা একা একা আমাকে ছাড়া৷ আজকে আমি বুঝলাম আমি মা কে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবো না, মা ও এই একাকীত্বের ভার সহ্য করতে পারবে না৷ তিনি তো আর সজল আঙ্কেলের মতো বিয়েও করবেন না .. কাজেই আমাকে সারাজীবন আমার মায়ের দেখভাল করতে হবে, কাছেই থাকতে হবে তার৷ যদি কোনদিন বিয়ে করি আমার শর্ত থাকবে একটাই, আমার মা আমার সাথেই থাকবে ... সবসময়!


আমি ম্যাসেজের রিপ্লাই দিলাম৷ আমি লিখলাম,


"..বয়সে আমি আপনার মেয়ের মতোই হবো হয়তো৷ আপনার লেখাটা আমি তাই আপনার সন্তান এবং আপনি দুটো দৃষ্টিকোন থেকেই দেখার চেষ্টা করলাম .. 


প্রথমেই একটা কথা বলে নিই, আপনি কোন অন্যায় করেননি৷ একজন একাকী মানুষের সঙ্গী পাওয়ার ইচ্ছেটা কোন অন্যায় কখনোই না৷ আপনার সন্তানেরা আপনাকে তাদের কাছে নেওয়ার কোন ব্যবস্থা করেনি৷ আমার ধারনা তারা দেশেও নিয়মিত আসে না৷ একাকীত্ব সহ্য করা সবার পক্ষে সম্ভবও না৷ আপনি যা করেছেন তাতে তাই কোন অন্যায় নেই ...


চলবে..


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #পর্ব_৮

Saturday, 7 October 2023

সুইসাইডাল বক্স - পর্ব: ৭


 

'সুইসাইডাল বক্স'

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ৭

_____________________

..ওই বাড়ি থেকে মিতালী দি-র বের হতে বেশ ঝামেলাই পোহাতে হলো, অনেক নোংরা নোংরা কথাও শুনতে হলো তাকে৷ তারপরও যখন দিদি দৃঢ় ভাবে জানালেন তিনি চলেই আসবেন, তখন তারা তোতনকে আটকে দিতে চাইলো৷ তোতন তাদের মেয়ে, তোতনকে ছেড়ে মিতালী দি যেন যেখানে খুশি চলে যায়!


জীবনে প্রথমবার মিতালী দি বোধহয় সাহসের কাজটা করলো৷ সপাটে চড় লাগালো তোতনের কাকার গালে, তারপর বললো "শয়তান, তোর ঐ নোংরা হাতে আমার মেয়েকে ছুঁবি না .. তোর কপাল ভালো যে আমি তোকে পুলিশে দিচ্ছি না ..." মেয়েমানুষ আর মা এ দুয়ে বিস্তর তফাৎ৷ ঈশ্বর যখন কোন মেয়েকে মা বানান, তার মধ্যে যেন শক্তির আধার ঢেলে দেন৷ সন্তানের জন্য মা পারে-না এমন কোনও কিছু নেই এই পৃথিবীতে..


মিতালী দি চলে এলেন সকাল দশটায়৷ একটা ব্যাগ হাতে, যার মধ্যে তাদের দুজনের জন্য কিছু কাপড়-চোপড়.. আর কিছুই নেই৷ মা আর সেই ভাড়া বাড়ির আন্টি-আঙ্কেল মিলে তাদের জন্য একটা তোষক, একটা হাড়ি, কড়াইয় খুন্তি ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দিলেন৷ মিতালী দির যেন নতুন যুদ্ধ শুরু হলো; বেঁচে থাকার যুদ্ধ, বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ.... মরে যেতে তো সবাই পারে, বেঁচে থাকতে পারে ক'জন? বাঁচার জন্য লড়াই করতেই হয়৷ একেকজনের লড়াইটা হয় একেক রকমের৷ কারোটা প্রকট আবার কারও টা প্রচ্ছন্ন .. কিন্তু কারও জীবনই সহজ সরল গল্পের মতো হয় না৷ বাস্তব জীবনে সিনেমার মতো তিন ঘণ্টার শেষে ভিলেন ধরা পড়ে না৷ ভিলেনরাই হয়তো জিতে যায় বারবার .. তারপরও যুদ্ধ করে করে নিজেকে আরো শক্তিশালী মানসিকতার করতে যে পারে সেই হলো মহানায়ক অথবা মহানায়িকা..


মিতালী দির বিজনেসও শুরু করা হলো৷ ফেসবুকে পেজও ওপেন করা হলো, "তোতন ও টুকিটাকি" নাম দিয়ে৷ এলাকাতেই একটা স্কুলে তোতনতে ভর্তি করানো হলো ক্লাস ফোরে৷ বছরের মাঝামাঝি সময়, তাই খুব ভালো স্কুলে ভর্তি করানো গেলো না৷ তাতে অবশ্য মিতালী দির কোন মন খারাপ নেই, বরং তিনি বেশ হাসিখুশিই আছেন৷ মায়ের সাথে সাথে বেশ ভাব হয়েছে তার৷ মায়ের জন্যেও ভালো হয়েছে, আমি সময় দিতে না পারলেও এখন তোতন আর মিতালী দি, মা-কে সময় দেয়৷ একদিন দেখলাম মা বেশ জমিয়ে আমাদের বাড়ির গল্প করছেন...


"জানো তো, সে এক বিরাট হট্টগোলের ব্যাপার.. আমার শ্বশুর ওদের নাম রাখবেন রণজয় আর সমাপ্তি আর ডাকনাম রণি আর তিতলী.. বাড়ির সবার-ই তাতেই মত৷ কিন্তু তোমার মেসোমশাই গোঁ ধরে বসেছে৷ সে তার ছেলে-মেয়েদের নাম রাখবে রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থের নামে... কবি মানুষ ছিলেন কিনা! তিনি ছেলে-মেয়েদের নাম রাখবেন অমিত আর অমৃতা .. আমার শ্বশুর রাগে সে কী চিল্লামেল্লি শুরু করে দিয়েছেন৷ সবচেয়ে বিপদে পড়েছে আমার শ্বাশুড়ি, না পারছেন ছেলের কথা রাখতে, না পারছেন স্বামীর কথা ফেলতে! শেষে আমাকে এসে বললেন, বৌমা ওরা দুজনই গোঁয়ার, তুমি বরং মাঝের একটা পথ বাতলে দাও ... আমি আর কি বলবো! অনেক ভাবলাম, অনেক ভাবলাম .. ভেবেচিন্তে আমার শ্বশুরের কাছে গিয়ে বললাম, "বাবা, আমার একটা কথা আছে .. আমি চাই আমার ছেলে-মেয়েরা তাদের ঠাকুর্দার দেওয়া নামও পাক আর বাবার দেওয়া নামটাও পাক, দুটো ই থাকুক৷ ওদের নাম হোক অমিত/রণি, আর সমাপ্তি/তিতলী... আমার শ্বশুর আমাকে খুব স্নেহ করতেন৷ আমার কথা ফেললেন না ... রবীন্দ্রনাথের 'শেষের কবিতা' আর 'তিনকন্যা'-র মূল চরিত্র অনুযায়ী আমার পুত্র-কন্যাদ্বয়ের নাম হলো.. হা হা হা .."


আমি মুগ্ধ হয়ে শুনলাম .. আমার মা হাসছে! কতদিন পর ঠাকুর আমাদেরকে একটুখানি দয়া করেছে .. আমি মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানালাম ঠাকুরের কাছে৷


এ সপ্তাহে নতুন কোনো কেস এলো না একটাও৷ এটাও আমার জন্য আনন্দের৷ ভাবলাম সামসুল হকের খোঁজ নেওয়া যাক৷ ছেলেটা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাচ্ছে তো..? 


সার্ফ করতে গিয়ে দেখলাম "জোনাকির আলো" আইডিটা ডিএক্টিভ করা৷ চিন্তায় পরে গেলাম একটু .. আমার সেই পরিচিত সাইকিয়াট্রিস্ট কে কল করলাম৷ উনি বললেন সৌম্য কাউন্সেলিং করাচ্ছে এখন, দুটো সেশন হয়েছে .. তার কথা শুনে ভালোই লাগলো, কিন্তু আরো একবার আমার সৌম্যর সাথে কথা বলা দরকার .. কিভাবে বলবো জানি না .. ওর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করিনি আমি মনের ভুলেই ..


এর মধ্যেই পড়লাম আরেক ঝামেলায়৷ পুলিশি ঝামেলা! কেউ একজন সাইবার ক্রাইমে মামলা করেছে আমার নামে৷ আমি নাকি সুইসাইডকে প্রোমোট করছি.. 

ব্যস, আমি পড়লাম অথৈ জলে! এই অবস্থায় কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না.. 


মনে পড়লো সুমনা রায়ের কথা, একজন স্বনামধন্যা উকিল৷ আমার 'সুইসাইডাল বক্স' গ্রুপের প্রথম দিককার কেস ছিলো ওনারটা.. উপায় না পেয়ে ওনাকেই কল করলাম৷ আমার কথা শুনেই ছুটে আসলেন তিনি আমার সাহায্য করতে৷ একদম বিপদের মুখ থেকে আমাকে বাঁচালেন৷ তবে গ্রুপটি বন্ধ করে দিতে হলো আমার৷ আগের সবকটা সল্ভ করা কেসের প্রমান দেখিয়েও গ্রুপটা বাঁচাতে পারলাম না আমি!


বলা যায় আমি ভেঙেই পড়লাম এবার৷ আমার জীবনের উদ্দেশ্য যেন হঠাৎ করেই হারিয়ে গেলো৷


*******


রিমার সেই দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ছে ..অনার্সের প্রথম বছর৷ শৌভনিক ছিলো এক ব্যাচ সিনিয়র৷ প্রথমে কথা হয়েছিলো নোটের জন্য৷ বেশ সাবলীলভাবে দুজনের কথা হতো..


রিমা প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো৷ একদিন শৌভনিক-ই ওকে বললো "রিমা, তোমাদের ক্লাসের সমাপ্তি নামের মেয়েটাকে আমার খুব পছন্দ, একটু খোঁজ নাও না, ওর কি কাউকে পছন্দ? বা ও কারো সাথে রিলেশন আছে না কি!"


রিমা শৌভনিকের সেই কথা শুনে ভেতরে ভেতরে গুমড়ে গুমড়ে কেঁদে উঠেছিলো৷ ক্লাসের কারো সাথেই তার বন্ধুত্ব নেই৷ সমাপ্তি মেয়েটাকে সে আগে কখনও খেয়ালও করেনি৷ এবার খেয়াল করলো ... ভীষণ দুরন্ত, ছটফটে একটা মেয়ে সমাপ্তি৷ সারাক্ষন হৈ চৈ করছে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে, গলা ছেড়ে গান গাইছে.. ক্লাসে তার বন্ধু-বান্ধবীর অভাব নেই৷ রিমা সবসময় খেয়াল করতো সমাপ্তি কে .. আর মনকে বোঝাতে চাইতো মেয়েটা সুন্দর, দুরন্ত, চটপটে, শৌভনিক তো ওকেই ভালোবাসবে, এটাই স্বাভাবিক!


মনকে বোঝাতে চাইলেই কি আর মন বুঝবে! মন বুঝতো না.. ওর প্রচন্ড হিংসা হতো৷ বাড়ি ফিরে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাঁদতো৷ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার মতো কেউ ছিলো না৷ তাকে সান্ত্বনা দেবারও কেউ ছিলো না, ছিল না তার কষ্টগুলোতে ভালোবাসার মলম লাগিয়ে দেবারও কেউ...


ধীরে ধীরে সময় গড়াল, সেকেন্ড সেমিষ্টারের শুরুতেই সবাই জেনে গেলো সমাপ্তি আর শৌভনিকের প্রেম কাহিনী৷ ক্যাম্পাসে তাদের সারাক্ষন একসাথে দেখা যেতো৷ ওরা আবার একসাথে আড্ডাও দিতো সবার সাথে৷ দূর থেকে ওদের দেখতো রিমা! নিজেকে সে আরো চুপচাপ করে ফেললো৷ 


নিয়মিত ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দিলো৷ পড়াশোনা ছেড়ে দিলো৷ শুধু পরীক্ষার আগে আগে ক্লাসে যেতো৷ রেজাল্ট খারাপ হয়ে গেলো৷ 


সেকেন্ড ইয়ার শুরু হলো এভাবেই৷ ইয়ার চেঞ্জের রেজাল্ট দেখে রিমার বাবা খুব রাগারাগি করলেন৷ রিমা তাই চেষ্টা করলো সব ভুলে পড়ায় মন দিতে ... পারলো না! এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করতো সে সমাপ্তি আর শৌভনিক কে, কিন্তু সম্ভব হয়ে উঠতো না! বারবার যেন ওরা দুজনই চোখের সামনে আসতো ঘুরে ফিরে! 


এক তরফা প্রেম বড্ড বেশি ভয়ঙ্কর হয়৷ এক তরফা প্রেমের আগুনের উত্তাপও থাকে অনেক বেশি৷ সেই উত্তাপ একজন মানুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেয়.. 


রিমাও জ্বলে-পুড়ে একদম শেষ হয়ে গেছিলো ..


চলবে..


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #পর্ব_৭

Saturday, 30 September 2023

'সুইসাইডাল বক্স' (পর্ব:৬)


 

'সুইসাইডাল বক্স'

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ৬

_____________________


ব্যালকনি তে বসে ফেসবুক স্ক্রলিং করছিলো রিমা৷ আবার ঐ গ্রুপটা চোখের সামনে পড়ে তার৷ রিমা মোবাইলটা বন্ধ করে রাখে৷ এই গ্রুপটা দেখলেই তার অস্বস্তি হয়, মনে হয় সবাই ওর মনের কথা বুঝে ফেলেছে! সবাই বোধহয় সবটা জানে! 


রকিং চেয়ারে বসে দোল খেতে খেতে রিমা চোখ বন্ধ করে ফেলল; তারপর মনে মনে ভাবতে থাকে সে আসলে ঠিক কী কারনে সুইসাইড করতে চায়! সে ভীষণ একা, বাবার স্নেহবর্জিত ... এটাই কি একমাত্র কারন? না, এর সবচেয়ে বড় কারন অপরাধবোধ৷ একটা গোপন পাপে পাপী রিমা৷ নিজেকে তাই নিজেই ক্ষমা করতে পারে না সে ...যতবার ঐ দূর্ঘটনার কথা মনে পড়ে, ততবার রিমার নিজেকে সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে এই পৃথিবী থেকে৷ ব্যাপারটা কি ভোলার চেষ্টা রিমা করেনি! করেছে...বহুবার করেছে... কিন্তু আজ অবধি পারেনি, আজকাল রিমার মনে হয় পারবেও না৷


শৌভনিক .... ফর্সা, গোলগাল মুখ, বড় বড় কবিতা বলা চোখ ..কোঁকড়া চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ .. আচ্ছা এমন একটা ছেলের প্রেমে পড়া কি খুব অন্যায় ছিলো! শৌভনিকের প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছিলো রিমা .. আর শৌভনিক! সে ছিলো সমাপ্তির প্রেমে অন্ধ৷ দুজন ছিলো কলেজের সবচেয়ে পরিচিত জুটি৷ বেশ মানাতো দুজনকে৷ সবার প্রিয় ছিলো ওরা, শুধু রিমা বাদে! রিমা সহ্য করতে পারতো না ওদের .. অসহ্য লাগতো রিমার! তারপরেও সহ্য করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো৷ 


কিন্তু, সেদিন যখন লাইব্রেরির পেছন দিকটাতে শৌভনিকের বুকের মধ্যে লতার মতো করে লেপ্টে থাকতে দেখলো সমাপ্তি কে, সেদিন নিজেকে আর কনট্রোল করতে পারেনি রিমা! যে গল্পটায় তার হবার কথা সে ভেবে আসছে শয়নে-স্বপনে, সেই গল্পের নায়িকা যখন অন্য কেউ হয় তা ঠিক কতক্ষন সহ্য করতে পারা যায়? যারা সহ্য করতে পারে তারা বোধহয় মহান মানুষ, রিমা সাধারন মানুষ, সে মহান হতে চায়না৷ রিমা পারেনি ...


অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে রিমার৷ ভয়াবহ সেই গোপন পাপের স্মৃতি রিমাকে বাঁচতে দিচ্ছে না৷ নিজেকে নোংরা মনে হয় ওর .. আচ্ছা তার কি ঐ সুইসাইডাল বক্সটা দরকার? এর আগেও সে চেষ্টা করেছে কয়েকবার, সফল হতে পারেনি, এই সুইসাইডাল বক্স কি তাকে নিশ্চিত মৃত্যু দিতে পারবে! সেখান থেকেও তাকে ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসতে হবে না তো?


******


ছোট্ট একটা ফুলের মতো ফুটফুটে মেয়েকে নিয়ে মিতালী গোস্বামী দেখা করতে এসেছেন৷ এ বয়সের মেয়েরা হবে ছটফটে ফড়িং এর মতো, অথচ মিতালী-র কন্যাটি বড্ড বেশিই চুপচাপ৷ 


আমাকে দেখে মিতালী বললেন 


—আপনিই কি আঁধার?


—আজ্ঞে হ্যাঁ 


—ও.. আপনার আসল নামটাকি বলা যাবে? 


—আমার ডাক নাম রণি৷ আপনি আমাকে রণি বলে ডাকতে পারেন .. 


—আচ্ছা৷ আমার বক্সটি কি এনেছেন? আমি টাকা নিয়ে এসেছি.. 


—আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই ৷ আপনি যদি আমাকে ভাই ভাবেন, আমি কি কথাগুলো আপনাকে বলতে পারি.. যদি আপনি অভয় দেন তবেই..!


—ভাই ভাবলে আর আপনি বলছো কেন? তুমি বলো৷ আর তুমি আমার বেশ ছোটই হবে৷ আমি বেশিক্ষন কাউকে আপনি আজ্ঞে করতে পারিনা৷


—বেশ দিদি, আমি আসলে কোন সুইসাইড বক্স বিক্রি করি না৷ আমি চেষ্টা করি মানুষদের সুইসাইড থেকে ফেরাতে৷ টাকার কথাটা বলি যাতে মানুষ কিছুদিন সুইসাইডের চিন্তা বাদ দিয়ে টাকার চিন্তায় থাকে৷ তুমি বলো ..এই কটাদিন তোমার মাথায় কোন চিন্তাটা ছিলো?


—টাকা জোগাড়ের চিন্তা.. কিন্তু রণি, আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম! তুমি এভাবে আমাকে ঠকালে?


—দিদি, আমার কথাটা শেষ করতে দাও প্লিজ৷ তারপর যা বলবে আমি মাথা পেতে নেবো ..


—বলো, কত মানুষের কত কথাই তো শুনলাম! তুমিও বলো না হয়..


—আমি সাধারণত কোন কেস সল্ভ করার জন্য তার আপনজনদের সাহায্য নিই, কিন্তু এইবার আমি আমার সেই পুরোনো পদ্ধতিতে কাজ করতে পারিনি৷ দিদি, আমি খুঁজে পেতেও তোমার কোনও আপনজন খুঁজে পাইনি৷ কিন্তু দিদি, তোমার এই ছোট্ট শান্তু টুনটুনিটার আপনজন খুঁজে পেয়েছি, যে ওকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে, যে ওর পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে পারে ..


— ক.. কে, কে!


—দিদি, তুমি!


—হা হা হা ! রণি, হাসালে তুমি আমাকে .. ঠাট্টা করছো তুমি আমার সাথে?


—না মিতালী দি, ঠাট্টা আমি করি না .. যা বলছি ভেবেই বলছি৷ দিদি, মেয়ের জন্য ঢাল হয়ে তোমাকেই দাঁড়াতে হবে৷ একটাবার চিন্তা করে দেখো ... এই নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে তুমি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে? একটাবার যুদ্ধের চেষ্টাও করবে না? 


—আমার কী করার আছে রণি!?


—আমি ভেবে রেখেছি৷ বলছি .. শোনো, তোমার হাতে আছে দশহাজার টাকা৷ প্রথমে তুমি মামনিকে নিয়ে ঐ বাড়িটা ছাড়বে৷ একটা ভাড়া বাড়ি আমি দেখে রেখেছি৷ একটা বয়স্ক দম্পতি থাকে৷ একটা রুম ভাড়া দেয়৷ সুন্দর রুম, রুমের সাথে বাথরুম আর বারান্দা আছে৷ ভাড়া তিনহাজার টাকা প্রতিমাসে৷ ওনারা এক মাসের ভাড়া এডভান্স রাখেন৷ কিন্তু আমি ওনাদের বুঝিয়ে দু'হাজার এডভান্সে দেবো বলেছি৷ এরপর তোমার কাছে থাকলো আট হাজার টাকা৷ এর ভেতর থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তুমি কাপড়ের ব্যবসা শুরু করবে৷ কিছু কাপড় এনে তাঁতীদের থেকে আরো ছবি নিয়ে আসবে৷ অনলাইন প্লাস অফলাইনে বিভিন্ন স্কুলের সামনে গিয়ে গার্জিয়ানদের কাছে বিক্রির চেষ্টা করবে৷ আমরা প্রথমেই নেবো একদম কমের মধ্যে বাটিক, ব্লক, স্ক্রিন প্রিন্টের থ্রিপিস৷ লাভও রাখবো খুব সীমিত৷ এগুলো এখন বেশ ভালো চলে৷ আমি সব খোঁজ খবর করে এনেছি৷ ছ'টা মাস তুমি শুধু আমাকে বিশ্বাস করো, দেখো ...তারপরও কিছু না হলে তুমি যা বলবে মাথা পেতে নেবো৷ 


—যত সহজে বললে, এত সহজে কী সম্ভব!


—নিশ্চয় সম্ভব৷ এখন ওঠো, তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো৷


—কোথায়?


—আমাদের বাড়িতে৷ আমার মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে৷


আমার মা মিতালী গোস্বামী-র জন্য অপেক্ষা করে আছেন৷ মা এতকিছু জানেন না৷ মা কে শুধু বলেছি, "একজন বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করছি মা, তুমি পাশে থেকো৷" 


মিতালী দির মেয়ের নাম মৌলি, ডাকনাম তোতন! আমার মায়ের সাথে তোতনের বেশ ভাব হয়ে গেলো৷ আমাদের বাড়ির কাছেই মিতালী দিদির জন্য বাড়ি দেখেছি৷ তাকে সেই বাড়িও দেখিয়ে আনলাম ... তারপর দিদি একসময় চলে গেলেন ... যাবার সময় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন "বসার ঘরের ছবিটা কি কম্পিউটারে ফটোশপ করেছো? একই মুখ খালি ছেলে আর মেয়ের তফাৎ.. দারুণ হয়েছে... মনে হচ্ছে পাশাপাশি দুটো জেন্ডারে তুমি!"


আমি বললাম "দিদি, ওটা আমার জমজ বোনের ছবি৷ ও দু'বছর আগে সুইসাইড করেছে৷ ওর জন্যই আমি আঁধার! ওর মৃত্যু ঠেকাতে পারিনি, তাই চেষ্টা করে যাই যতটা সম্ভব মানুষের সমস্যার সমাধান করতে ..."


মিতালী দি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, "রণি, তুমি পারবে ..নিশ্চয় পারবে ... আগামীকাল আমি চলে আসবো৷ সকাল সকালই চলে আসবো৷ পাশেই থেকো আমার৷ তুমি থাকলে তোতনের ভার আমি নিতে পারবো, তোতনের ঢাল আমিই হতে পারবো...ভগবান চাইলে ঠিক পারবো .."


আমাকে জড়িয়ে ধরলেন মিতালী দি৷ আমার আবার মনে হলো আমাকে জড়িয়ে ধরেছে তিতলী! 


আচ্ছা ওপারে বসে কী তিতলী দেখতে পায়, আমি, মা, আমরা যে সারাটাক্ষন ওকে মিস করি! পাগলের মত মিস করি! 


*******


রিমার বাবা গেছেন দেশের বাইরে৷ তার কি নাকি জাহাজে কোন সমস্যা হয়েছে, সেই জাহাজের পেছনেই ছুটেছেন তিনি৷ রিমা আজ এসব চিন্তা বাদ দিয়ে একটু মন ভালো করার চেষ্টা করছে৷ 


মায়ের আলমারি খুলে একটা লাল শাড়ি বের করে রিমা৷ তারপর রান্নাঘরে গিয়ে রাঁধুনি কে বলে আসে ভালো করে কষিয়ে মাংস, মুগের ডাল আর ভাত রান্না করতে৷ সাথে টমেটোর চাটনি৷ বলে এসে নিজের ঘরে না গিয়ে মায়ের ঘরেই ঢোকে৷ মায়ের ঘরটা এখনও আগের মতই আছে৷ মায়ের ড্রেসিং টেবিল, তার সাজ-গোজের জিনিসপত্র .. অবশ্য সাজগোজের জিনিস বলতে শুধু কয়েকটা কাজল, আর একটা হালকা কালারের লিপস্টিক৷ এসবের এক্সপায়ারি থাকার কথা না, তবু.. রিমা জানে, আনোয়ারা তার আশেপাশেই আছে, তাই আনোয়ারা কে ডেকে তার ঘর থেকে তার কাজল আর লিপস্টিকটা আনতে বলে৷ আজ সে মায়ের মত করেই সাজবে ..


সময় নিয়ে সাজে রিমা৷ সুন্দর করে শাড়ি পড়ে, চোখে কাজল দেয়, ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক দেয় ...তারপর মুগ্ধ হয়ে নিজেকে দেখে সে৷ ওর বেশ ভালো লাগতে থাকে৷ এভাবে সেজেগুজেই দীর্ঘদিন পর সে ডাইনিং টেবিলে বসে নিজের সব পছন্দের খাবার তৃপ্তি করে খায়৷


তারপর ঘরে এসে নিজেকে এলিয়ে দেয় বিছানায় ....

ঠিক তখন ওর মনে হয় শাড়িটা জঞ্জাল লাগছে ...শাড়ি খুলে একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার পরে ফেলে সে৷ তারপর আবার ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে ... এই রিমা একটু আগে আনন্দে থাকা রিমা না..বরং এ সেই পুরোনো ডিপ্রেসড রিমা..


সাজ-গোজ বা খাওয়া-দাওয়া ডিপ্রেশন কমায় না৷ যখন কাউকে বলা হয় খুব মন খারাপ হলে আপনি কি করেন? বেশিরভাগ মেয়েই উত্তর দেয়, আমি তখন সাজি, বা আমি তখন খাই ... এসবই আসলে নিজেই নিজেকে বোকা বানানো, ধোঁকা দেওয়া৷ সাময়িকভাবে নিজেকে ডাইভার্ট করা৷ কিন্তু পরিপূর্ন সমাধান এটা নয়৷ আসলে আমরা ক'জনই সমস্যার পরিপূর্ন সমাধান চাই! আমরা বোধহয় দুঃখবিলাস করতেই বেশি ভালোবাসি ....


চলবে..


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #ষষ্ঠ_পর্ব

Saturday, 23 September 2023

'সুইসাইডাল বক্স' (পর্ব: ৫)


 

'সুইসাইডাল বক্স'

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ৫

_____________________

.."আমার আইডি দেখে আপনি হয়তো ভাবছেন আমি হয়তো একটা মেয়ে৷ আসলে এটা আমার ছোটবোনের আইডি৷ ওর-ই নাম জোনাকি, ওর আবার ফেসবুকের নেশা নেই৷ আমিই মাঝে মধ্যে ওর আইডিতে ঢুকি৷ সমস্যাটা শুরু হয় এই আইডি নিয়েই৷ আসলে সমস্যা ঠিক তার নয়... ব্যাপারটা হচ্ছে, সমস্যাটা আমি নিজে নিজেই তৈরি করেছি৷ 


আমার নাম সৌম্য; ভালো নাম, শেখ সামসুল হক। অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তির অপেক্ষায় আছি৷ যাই হোক, আপনার বেশি সময় নেবো না, প্রসঙ্গে আসি৷ আমার বোন নিজের ছবি প্রোফাইলে দিতে খুব-একটা পছন্দ করে না৷ ইন্টারনেট থেকেই ডাউনলোড করে একজন নায়িকার ছবি দিয়েছিলো প্রোফাইলে৷ সাউথ ইন্ডিয়ান মুভির নায়িকা৷ ও যেহেতু ফেসবুকে সেরকম ঢোকে না, আর আমিই মেনলি ওর আইডি চালাই, তাই খেলাচ্ছ্বলেই সমস্যার শুরুটা আমি করে ফেললাম.. 


মেয়েদের আইডিতে বিভিন্ন ছেলেরা নানান সময়ে নানা রকম নোংরা ম্যাসেজ করে থাকে.. আদার ম্যাসেজবক্স ওপেন করলে বোঝা যায় যে মানুষের মনের নোংরামির কোন সীমা-পরিসীমা নেই৷ আমার বোনের আইডিতেও এমনই ছেলেদের ম্যাসেজ আসতো৷ নিজেদের বিশেষ অঙ্গের ছবি পাঠাতো ইনবক্সে৷ আমি খুব কড়া ভাষায় রিপ্লাই দিয়ে সেই আইডিগুলোকে ব্লক করে দিতাম৷ এসবেও কোন সমস্যা ছিলো না৷ 


একদিন একটা ম্যাসেজ আসলো তরুন কুমার নামের একটা আইডি থেকে৷ খুব সুন্দর করে ভদ্রভাষার ম্যাসেজ৷ আমি নোংরা ম্যাসেজ দেখে দেখে এতটাই বিরক্ত ছিলাম, আমার ওনার করা ম্যাসেজ খুব ভালো লাগলো৷ আমি খুব স্বাভাবিকভাবে রিপ্লাই দিলাম৷ তবে ফোনের ওপারের মানুষটা জানতে পারলো না আমি একজন ছেলে ....


তরুন প্রতিদিন ম্যাসেজ পাঠাতো- দারুণ সব কবিতা লিখে লিখে.. ওর কবিতা আমার বেশ ভালো লাগতো৷ আমি নিয়মিত কথা বলে যেতে লাগলাম৷ একসময় অবাক হয়ে দেখলাম আমি তরুনের সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছি.. আমি ভীষণ ভালো লাগা নিয়ে অপেক্ষা করছি ...


আস্তে আস্তে আমাদের কথা বলার সময় বাড়লো, সারারাত আমরা কথা বলতাম৷ আমার পরীক্ষা থাকলে ও আমার সাথে জাগতো৷ আমি অসুস্থ হলে ও আমাকে ওষুধ খাবার কথা মনে করিয়ে দিতো৷ আমি দিনে দিনে ওর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে লাগলাম৷ 


আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন আঁধার? অবশ্য বিরক্ত হবার মতোই কথা বলছি আমি! আর বেশিক্ষন নেব না আপনার ..."


"না..না, বিরক্ত হওয়ার কোন কারণ নেই, আমি অভ্যস্থ! তারপর কী হলো?"


"তারপর যা হবার সেটাই হলো৷ তরুন আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো৷ ও যেহেতু হিন্দু আর আমি মুসলিম ও নিজ থেকেই বললো ও ধর্ম পরিবর্তন করবে৷ প্রেম না, সরাসরি বিয়েই করতে চায় আমাকে..."


"আমি দ্বিধায় পরে গেলাম ! আমি তরুনকে কি বলবো! হিন্দু-মুসলিম এটা সমস্যা না, সমস্যা তো অন্যখানে৷ আমি একজন পুরুষ ... ঠিক একই ভাবে তরুনও একজন পুরুষ৷ তরুনের কাছে আমি নারী হলেও আসলে আমি তো নারী নই!


প্রচন্ড দ্বিধা নিয়ে দিন কাটাতে লাগলাম৷ আমি তরুনের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম... ও আমাকে পাগলের মতো নক করতো৷ আমার সাথে কথা বলার জন্য ও পাগল হয়ে ছিলো৷ আমার অসহায় লাগতো৷" 


"নিজের সাথে যুদ্ধ করে আর পারলাম না৷ সত্যিটা বলে দিলাম অবশেষে৷ বললাম, 'তরুন আমি একজন ছেলে...' ও বিশ্বাস করতে চাইলো না৷ ও ভাবলো আমি ওকে বিয়ে না করার জন্য মিথ্যে কথা বলছি ..."


"আমি অবশেষে ওর সাথে দেখা করতে চাইলাম৷ ওর কান্না আমার সহ্য হচ্ছিলো না৷ আমিও কাঁদছিলাম, কেন কাঁদছিলাম জানি না..আমিও বোধহয় ভালোবেসে ফেলেছিলাম তরুনকে! বোধহয় না, আমি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলাম তরুনকে৷ একটা ছেলে হয়েও আমি আরেকটা ছেলেকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম ... হয়তো এখনও বাসি .."


"আমি তরুনের সাথে দেখা করলাম৷ ও অবাক হয়ে দেখলো আমাকে .. ঘৃনাভরে দেখলো আমাকে ...কোন কথাই বললো না! শুধু যাবার আগে একদলা থুথু ফেলে দিয়ে গেলো আমার গায়ে .."


"এই ঘটণার ছয়মাস হয়ে গেছে৷ এই ছয়মাসে আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি পুরো ঘটণাটা ভুলে যেতে, পারিনি৷ আমি এখনও ফেক আইডি দিয়ে তরুনের আইডি ফলো করি, ওকে দেখি৷" 


"আমি চেষ্টা করেছিলাম কোন মেয়ের সাথে যেন সম্পর্কে জড়াতে পারি৷ সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক ... আমি পারিনি ... কোন মেয়ের প্রতি আমার সেই অনুভূতিটা জন্মায় না .."


"তরুন কিন্তু আমাকে মনে রাখেনি৷ ও বিয়ে করেছে গত তিনদিন আগে৷ একদম হিন্দুরীতি তে, খুব ধুমধাম করে এক রূপসী মেয়েকে বিয়ে করেছে .. বিয়ের ছবিতে তরুনের হাসিমুখ আমার বুকে শূলের মতো বিঁধেছে আঁধার .." 


"আমি জানি, ভুলটা আমার৷ আমিই প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাবার চেষ্টা করেছি, মিথ্যা বলেছি .. আমি শাস্তি পাবো এটাই স্বাভাবিক! কিন্তু শাস্তির এই বোঝাটা আমি আর টানতে পারছি না৷ তরুনের বিয়ের আগে পর্যন্ত কষ্টটা অন্যরকম ছিল, কিন্তু এখন কষ্টটা আলাদা৷ আমি চোখ বন্ধ করতে পারি না, চোখ বন্ধ করলেই দেখি তরুন ওর বউয়ের সাথে ......." 


"আমি আর পারছি না আঁধার! মৃত্যু মনে হয় সবচেয়ে সহজ সমাধান ... আমাকে ঘৃনা করবেন না আঁধার, খুব সাহস সঞ্চয় করে প্রথমবার এই কথাগুলো আমি কাউকে বললাম ...."


সামসুলের ম্যাসেজ পড়ে আমি খানিকক্ষন চুপ করে থাকলাম৷ ঠিক কী বলা উচিত আসলে বুঝতে পারছি না .. একটা ছেলে আরেকটা ছেলেকে কীভাবে ভালোবাসে এটা আমার মাথায় ঢুকছে না৷ আমি রিপ্লাই দেওয়ার আগে একটু প্রস্তুতি নিলাম৷ আমি লিখলাম "আপনি যে সমস্যায় পড়েছেন সে সমস্যার সাথে আমি পরিচিত নই৷ তবে এটুকু বলতে পারি, আমার মনে হয় আপনার কোন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার৷ এটাও এক ধরনের মানসিক সমস্যা মনে হচ্ছে৷ আমার পরিচিত একজন 

সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন৷ আপনি চাইলে আমি তার সাথে কথা বলে আপনার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে কথা বলে নেবো৷ একটাবার চেষ্টা করে দেখুন৷ ভুল তো মানুষেই করে, তবে ভুল শোধরাবার চেষ্টা তো করা দরকার, তাই না, কি বলেন?"


সামসুল চুপ করে থেকে উত্তর দিলো "আমি আমার পরিবারের একমাত্র ছেলে৷ একটা শেষ চেষ্টা আমি করতে চাই ... আপনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে দেখুন ..." 


আমি আচ্ছা বলে কথা শেষ করলাম৷ কথা শেষ করতেই দেখি মিতালী গোস্বামী-র ম্যাসেজ করেছে৷ তার টাকার জোগাড় হয়ে গেছে৷ আমি তাকে কাল দেখা করার সময় দিলাম৷ অন্য কেস আর মিতালী গোস্বামী-র কেস এক নয়৷ আমার আরো কিছু কাজ আছে, কাজগুলো শেষ করতে হবে অতি দ্রুত...


ইনবক্সে থাকা দ্বিতীয় ম্যাসেজটা ওপেন করলাম৷ ভদ্রমহিলা তার পুরো গল্পটা বলেই রেখেছেন৷ 


"আমার নাম অতসি, বয়স পয়তাল্লিশ৷ তিন সন্তানের জননী৷ বড় মেয়ের বিয়েও দিয়েছি৷ ছোট মেয়েটা টুয়েলভ দিলো এবার৷ আর সবচেয়ে ছোটটা ছেলে, ক্লাস নাইনে পড়ে৷ আমার স্বামীর বয়স সাতান্ন, বারো বছরের বড় আমার থেকে.."


"বছর দুয়েক আগে আমার জরায়ুতে টিউমার ধরা পড়ে৷ টিউমারটার জন্য অপারেশন করে আমার পুরো জরায়ু ফেলে দিতে হয়৷ এরপর থেকে নানান ধরনের সমস্যা হচ্ছে আমার৷ তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা, বয়সের কারনেই হোক আর অপারেশনের কারনেই হোক, স্বামী-স্ত্রী র নিজস্ব সম্পর্কে আমি আর কোন আগ্রহ পাচ্ছি না৷" 


"এটা নিয়ে অনেক অশান্তি৷ আমার স্বামী, এ বিষয়টি বুঝতে চাইছেন না৷ আর বিষয়টি এতটাই লজ্জার আমি আমার সন্তানদের সাথেও শেয়ার করতে পারছি না .. এটা কি ওদের বলার মতো কথা! বাবা-মা মারা গেছেন আমার৷ শ্বশুর মারা গেছেন৷ আছেন এক শ্বাশুড়ি, বৃদ্ধা ... জাগতিক বোধ-বুদ্ধিশূন্য! আমি আমার এ যাতনা কাকে বলবো! আমি ডাক্তার দেখিয়েছি, এ সমস্যার নাকি সমাধান আসলেই নেই!


আমার স্বামী গত পাঁচমাস আগে বিয়ে করেছে৷ ইচ্ছে করলে আমি কেস করতে পারি৷ কিন্তু, আমার নিজেকে এতটাই ক্লান্ত লাগে আমার আর কোন ঝামেলা করতে ইচ্ছে হয় না৷ আমার ছেলে মেয়েরা এখনও জানে না তাদের বাবার এই বিয়ে করার কথা৷ টাকা রেডি আছে আঁধার, আমি কি 'সুইসাইডাল বক্স' টি পেতে পারি? এত কষ্ট করেছি, মৃত্যুটা অন্তত আমার সহজ হোক..."


আমি পড়লাম৷ পড়তে পড়তে আমার দুচোখ দিয়ে জল চলে আসছিলো৷ আমি আজকাল দ্রুতই ভেঙে পড়ছি৷ এভাবে আমার ভেঙে পড়লে তো চলবে না ..


আমি নিজেকে শক্ত করলাম৷ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে রিপ্লাই দিলাম ..


"একটা বয়সের পর সন্তানেরা মায়ের বন্ধু হয়ে যায়৷ আপনার সন্তানেরা সেই বয়সে পৌঁছেছে৷ তাদের কাছে লজ্জার কিছু নেই৷ আপনি আপনার সন্তানদের সাথে কথা বলুন, মন খুলে৷ ওদের আপনি জন্ম দিয়েছেন৷ ওদের মতো ভালো করে আপনাকে কেউ বুঝবে না৷ আর একটা কথা, এই খবরটা এক সময় না এক সময় আপনার সন্তানদের কানে ঠিকই যাবে৷ অন্য কারও থেকে শোনার আগে আপনিই বলুন, এটাই ভালো৷ আপনার কোন ভুল নেই৷ আপনি কেন মরবেন? আর একবার আপনার সন্তানদের কথা ভাবুন ...ওদের কি হবে আপনি না থাকলে...?


আপনার সমস্যার সমাধান আছে৷ আমি খুবই দুঃখিত আপনার কাছে আমি বক্সটি বিক্রি করতে পারবো না.."


উনি উত্তরে বললেন, "আমি কি পারবো, লড়াই করতে..?"


আমি অভয় দিয়ে বললাম, "নিশ্চয় পারবেন..."


চলবে..


***


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #৫ম_পর্ব

Saturday, 16 September 2023

সুইসাইডাল বক্স (পর্ব: ৪)

 


'সুইসাইডাল বক্স'

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ৪

_____________________


আনোয়ারা মেয়েটা রিমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে৷ ভয়ার্ত গলায় সে রিমাকে বললো- 


—দিদি, চলো ঘরে যাই.. 


—তুই কীভাবে বুঝিস আমার সবকিছু বলতো? 


—দিদি, ঘরে গিয়ে কতা বলবো, চলো!


—ভয় পাচ্ছিস কেন ? আরে আমি লাফ দেবো না 


—তা বেশ, চলো ঘরে যাই...


—ঠিক আছে বাবা, চল ..


রিমা আনোয়ারার সাথে ঘরে চলে যায়৷ রিমা বিছানায় হ্যালান দিয়ে শুয়ে পড়লো, চোখটা বন্ধ করে রিমা৷ ওর আজ খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে৷ আনোয়ারার সাথে কথা বলা খানিকটা দেওয়ালের সাথে বলার মতো; চুপচাপ শুনবে, কিন্তু সচরাচর কোন উত্তরই সে পাবে না! সে শুধু একটা কাজই ভালোমতো করতে পারে, তা হলো ছায়ার মতো রিমাকে ফলো করতে৷ রিমা চোখ মেলে তাকালো, আনোয়ারা সেখানে নেই৷ সে আনোয়ারা বলে ডাক দিতেই সে চলে এলো সাথে সাথেই- হাতে তার এক কাপ কড়া লিকারের চা....


রিমা চা হাতে নিলো৷ হাতে নিয়ে বললো; 


—আনোয়ারা, বাবা তোকে বলেছে না, সারাক্ষন আমাকে ফলো করতে?


আনোয়ারা চুপ করে রইলো৷ রিমার বাবা তাকে এই দায়িত্ব দেয়নি; কিছুই বলেনি, কিন্তু গতবারের ঘটনার পর আনোয়ারা নিজেই এ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে৷ সেবার আনোয়ারা যদি একটু সচেতন হতো তাহলে বোধহয় এমনটা হতো না!


—কি রে আনোয়ারা, চুপ করে আছিস কেন? বল! বাবা কি বলেছে তোকে.. আমাকে ফলো করতে?


—না তো দিদি..! 


—সত্যি করে বল! বাবা যদি এমনটা বলে আমার কিন্তু ভালোই লাগবে, মনে হবে মানুষটা অন্তত আমার কথা ভাবছে ..


—বাপের কাছে বেটির চাইতে আপন কেউ হয় না গো দিদি..বড়দাদাবাবু আপনাকে অনেক ভালোবাসে, কিন্তু দেখায় না..


—হা হা হা! আনোয়ারা, তোকে যে বিক্রি করে দিয়েছিলো বারো বছর বয়সে সে তোর বাবাই ছিলো, তাই না..? বাবা হলেই ভালো হবে, মেয়েকে ভালোবাসবে.. এ ধরনের চিন্তা করাটা হচ্ছে বুলশিট, বুঝেছিস! মানে একদম বাজে কথা...


—অভাবের জন্যে এমুন করেছিলো৷ আমার আরো ভাই-বোন ছিলো, নদী ভেঙ্যে ক্ষেত-ফসল সব গেছিলো গাঙের জলে ... এতগুলো মানুষের বাঁচবার আশায় আমাকে বেচেছিলো.. 


—তার উপর তোর রাগ নেই? এভাবে বলছিস অভাবের জন্য বিক্রি করেছে .. সত্যিই কি রাগ নেই ?


—না দিদি ... আমি তো ভালোই আছি৷ খাওয়ার কষ্ট নেই, গায়ের কাপড়ের কষ্ট নেই ... রাগ রেখ্যে কি করবো, নিজেরটা খালি বুঝলে হব্যে! ওদের কষ্টও বোঝা লাগে দিদি ...


—তুই ভালো আছিস, কারন তোকে যে কিনেছিলো সে তোকে ব্রোথেলে বিক্রি না করে আমার বাবার কাছে বিক্রি করেছে! ব্রোথেল বুঝিস? নষ্ট মেয়ে মানুষদের আখড়া .. তোর কপাল ভালো বুঝেছিস! আর কিচ্ছু না ..


—কপাল যদি ভালোই হয় তাইলে আর রাগ রেখ্যে লাভ কি কও!


—যাক গে, তোর সাথে এসব কথা বলা অর্থহীন.. তারপরও বুঝলি আনোয়ারা, তোর বাবা আমার বাবার চেয়ে ভালো৷ তোর বাবা তোকে বিক্রি করে দিয়েছে টাকার কাছে, আর আমার বাবা আমাকে বিক্রি করেছে সময়ের কাছে ...


মা মারা যাবার পর আমার কথা বলার মানুষটাও আর কেউ থাকলো না৷ কখনো কোন বন্ধু বানাতে পারিনি, সবসময় নিজেকে সংকীর্ণ লাগতো! আমি তো শুধু বাবার কাছে সময়ই চেয়েছি, বাবা কি এতোটুকুও আমাকে কখনো দিয়েছে..!


তুই আর আমি তো একসাথেই বেড়ে উঠলাম এই বাড়িতে! কখনো দেখেছিস বাবাকে আমার মাথায় একটু হাত রাখতে..! আমার যখন জ্বর হতো, আমি জ্বরের ঘোরে কাঁপতাম৷ সুমিতা আন্টিকে জড়িয়ে ধরে আমি বাবাকে খুঁজতাম .. বাবা হয় বিদেশে থাকতো না হয় অফিসে! আমার পাশে ছিলো না কখনো .. সুমিতা আন্টি আমাকে মায়ের মতো ভালোবাসতো জানিস, তোকেও অনেক ভালোবাসতো তোর মনে নেই? সেই আন্টিও একদিন আসা বন্ধ করে দিলো, দিনের দিনের দিন আমি আন্টির জন্য অপেক্ষা করেছি .. অনেকদিন পর জানলাম আমাদের বাড়ির চাকরিটা আন্টি ছেড়ে দিয়েছে৷ কেন ছেড়ে দিলো চাকরিটা বলতে পারিস?


আজ আমি বাবার কাছে গিয়ে বসলাম৷ বাবা যদি শুধু একবার জিজ্ঞেস করতো, "রিমা মা ভালো আছো?" আমি কতটা খুশি হতাম তোকে বোঝাতে পারবো না ... কিন্তু বাবা একবারও বললো নারে আনোয়ারা! আমার বাবা একটাবারের জন্যেও বললো না..


—দিদি, মেয়্যা মানুষের ধৈয্য ধরতে লাগে অনেক.. বড়দাদাবাবু মানুষ খারাপ না৷ শুধু কাজকামের চাপ বেশি.. এর জন্যি তোমার সাথে গফসফ করতে পারে না৷ এইগুলো মনে নিয়্যা মন ভারি করে রাখল্যে চলব্যে? এরচে বিরাট বিরাট কষ্ট নিয়্যা মানুষে হাসি মুখে বেঁচ্যা থাকে গো.. ধৈয্যের গুণ বড় গুণ


—ধৈর্য্য, হা হা হা! হুম ভালো বলছিস ... হা হা হা!


******


একটা কেস সল্ভ করার আগে আমি অন্য কেস নিতে চাই না৷ মনোযোগ ডাইভার্ট হয়ে যায়৷ কিন্তু মিতালী গোস্বামী আমার সাথে আর যোগাযোগ করছে না! হয়তো টাকাটা এখনো জোগাড় করতে পারেনি৷ তাকে অনলাইনে দেখি, কিন্তু সে আমাকে নক করে না ... চিন্তা হচ্ছিলো, ভাবলাম সব ঠিক আছে তো! নিজে থেকেই তাই 'হ্যালো' বললাম ৷ আমার হ্যালোর জবাবে তিনি লিখলেন, 'আর কটা দিন সময় লাগবে ..' আমি আর কথা বাড়ালাম না, উনিও আর কোন কিছু বললেন না৷ যাক, আমি নিশ্চিন্ত হলাম কিছুটা৷ উনি ভালো আছেন, এটুকুই যথেষ্ট, টাকা জোগাড়ের চেষ্টায় আছে, থাকুক!


আজ আমি পেন্ডিং ম্যাসেজগুলো চেক করতে বসলাম৷ তিনটে নতুন ম্যাসেজ! এত মানুষ মরতে চায়.. কেন! মৃত্যুই কি তবে জগতের সব সমস্যার সমাধান? এই যে আমার তিতলী এই মৃত্যুকে সমাধান ভেবে যে চলে গেলো, ও কি জানে যে ওর চলে যাবার পর আমরা কেমন আছি? আমার মা তিতলী চলে যাবার পর থেকে একবারও হাসেনি৷ মায়ের কথা ভাবলে বড্ড অবাক হই৷ আট বছর বয়সী দুটো জমজ ছেলে-মেয়ে রেখে বাবা মারা গেলেন৷ এরপর মা ঐ স্কুলে চাকরি করেই আমাদের ভাই-বোনদুটোকে বড় করলেন৷ বাবা যখন মারা যায় তখন মায়ের আর কতই বা বয়স ছিলো! কিন্তু তারপরও উনি একটাবারও নিজের কথা ভাবেনি৷ দ্বিতীয়বার সংসার করেননি৷ শুধু আমাদের জন্য নিজের জীবনটা উৎসর্গ করে দিয়ে গেলো৷ অথচ বিনিময়ে তার একটা সন্তান তার মুখ থেকে হাসি কেড়ে নিয়ে চলে গেলো সারাজীবনের জন্য৷ মানুষটা বেঁচে আছে ঠিকই, কিন্তু এই বেঁচে থাকাকে ঠিক বেঁচে থাকা বলে কি না, আমার জানা নেই .. বাবার মৃত্যুটাও মা কে এতটা ভেঙে চুরমার করে দেয়নি যতটা দিয়েছে তিতলীর মৃত্যু৷ বাবার মৃত্যুটা ছিলো সহজ, স্বাভাবিক৷ অসুস্থ হয়েছিলেন, দীর্ঘদিন রোগে ভুগেছেন, তারপর মারা গেছেন.. কিন্তু তিতলীর মৃত্যুটা অস্বাভাবিক৷ তিতলীর বয়স ছিলো একুশ ... রোগ ছিলো না, জরা ছিলো না .. শুধু ছিলো হয়তো বুক ভর্তি গোপন অভিমান৷ আমি জানি না সে অভিমানের কারন, জানে না মা-ও ..


বসার ঘরের ছবিটা এখনো আগের মতোই টাঙানো আছে৷ মা ঐ ছবি খুলতে দেয় না৷ ছবিতে আমার দাড়ি ধরে টানছে তিতলী .. আমি চিৎকার করছি আর ও খিলখিল করে হাসছে .. আমাদের দুজনেরই বয়স তখন পনেরো-ষোলো হবে.. 


আমাদের দুই ভাই-বোনের সম্পর্ক ছিলো বন্ধুর মতো৷ আমরা কত রাত গল্প করে পার করেছি, অথচ এত গল্পের পরেও আঁচ করতে পারিনি কি চলছে আমার বোনের বুকের গহীনে .. 


মানুষ কষ্ট লুকোনোর অভিনয় করতে সবচেয়ে ভালো পারে৷ একজন মানুষ সহজ স্বাভাবিক ভাবে আপনার সামনে হেঁটে বেড়াবে, আপনি বুঝতেও পারবেন না সেই মানুষটার হৃদয়ে কোন ঝড় চলছে ... অভিনয়! সবই অভিনয়! এই অভিনয় না জানলে যে সমাজে মান থাকে না, পরিবারে মুখ থাকে না৷ যে যত ভালো অভিনয় করতে পারবে, মানুষ তাকে তত বেশি সুখী ভাববে৷ আচ্ছা, কেউ যদি কষ্টে থাকে তাহলে তা প্রকাশ করতে দোষ কি! কেন করতে হবে এই লোক দেখানো মিথ্যা অভিনয়! অন্য কারো কাছে না হোক আপন মানুষগুলোকে তো বলাই যায়! আমি কি তিতলীর আপন ছিলাম না? কেন ও আমাকে ওর কষ্টের কথা বলেনি? ভালোবাসা আর বন্ধনের চেয়েও কি তবে দ্বিধার শক্তি বেশি?


প্রথম ম্যাসেজটা ওপেন করলাম৷ আইডির নাম 'জোনাকির আলো'.. ফেক আইডি বোঝাই যাচ্ছে৷ ফেক আইডি থেকে আসা কেস এর আগেও সল্ভ করেছি৷ এটা আমার জন্য কোনো বড় ব্যাপার না৷ আইডির নাম যাই হোক, হোক সে পুরুষ অথবা নারী, আমার কাছে সবারই একটাই পরিচয় ..তারা সবাই তিতলী .. আমার বোন..


জোনাকির আলো লিখেছে, "সুইসাইডাল বক্স কেনা হয়তো আমার হয়ে উঠবে না আঁধার৷ তবে আপনাকে আমার গল্পটা শোনাতে ইচ্ছে হলো৷ আপনি শুনে শুধু বলবেন আমি যদি আত্মহত্যা করি কারনটা কি যৌক্তিক হবে নাকি অযৌক্তিক! এর কি কোন সমাধান সম্ভব নাকি সম্ভব নয়! ... বক্স না কিনে যদি আমি গল্পটা বলতে চাই আপনি কি শুনবেন..?"


আমি লিখলাম, "অবশ্যই শুনবো, আপনি বলুন.."


চলবে.. 


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #চতুর্থ_পর্ব

Sunday, 10 September 2023

'সুইসাইডাল বক্স' (৩য় পর্ব)


সুইসাইডাল বক্স 

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ৩

_____________________


ছ'ফুট লম্বা, ভীষণ সুদর্শন অলির সেই স্বামী লোকটির মানসিক বিকারের নাম sexual sadism disorder.. যে মুহূর্তটি আনন্দের হওয়ার কথা ছিলো লোকটি তা অলির জন্য চরম ভীতিকর মুহূর্তে পরিনত করেছিলো৷ অলি যখন আমাকে কথাগুলো বলছিলো আমি ভেতর ভেতর শিউরে উঠেছি! লোকটি রাতে ব্লেড নিয়ে শুতে যেতো৷ শারীরিক মিলনে অলিকে বাধ্য করতো.. সেই সময়ে ব্লেড দিয়ে আঁচড় দিতো ওর গায়ে৷ অলি যত যন্ত্রনায় চিৎকার করতো লোকটা তত বেশি আনন্দ পেতো, অনেকটা ব্রেন অরগাজমের মতো ব্যাপারটা৷ প্রথমবার যখন অলির সাথে দেখা করলাম, আমাকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে৷ আমি একটা অনলাইন গেমের অপারেটর, যার উদ্দেশ্য সুইসাইডাল বক্স বিক্রি করা এটা একজন শিক্ষিত, বুদ্ধিমতী, ডাক্তার মেয়েকে বিশ্বাস করাতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়েছে, কিন্তু বিশ্বাস না করাতে পারলে আমার সাথে ওর দেখা করাটা সম্ভব হয়ে উঠছিলো না৷ আর যে কথাগুলো চোখে চোখ মিলিয়ে সহজে বোঝানো যায় তা কিন্তু ম্যাসেঞ্জারে বা গেমের চ্যাটবক্সে টাইপ করে বোঝানোটা সম্ভব না৷ আর সুইসাইডাল বক্সের এই নাটকটা আমি কেন করি সেটাও বলি৷ "..ধরে নিন কাউকে কিছু একটা আমি করতে বারন করবো, তাতে কি হবে জানেন? তাতে তার ঐ জিনিসের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাবে৷ নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষন আমাদের সব্বারই থাকে৷" 


আমার ধারনা, সুইসাইড যে করতে চায় তাকে যত ভাবেই বোঝানো হোক ওটা মহাপাপ, ওটা ভালো না, ওটা কোন সমাধান নয়.....দিনের শেষে এসব কোন কথাই তাদের কানে ঢুকবে না৷ কষ্টগুলো এতটাই লাগাম ছাড়া হয় যে এসব নীতিকথা, জ্ঞানের কথা, সেই কষ্টের কাছে ভীষণ তুচ্ছ মনে হয়৷ তাই যখন এমন কাউকে আমি বলি যে, আমি তোমাদের কাছে এমন একটা কিছু বিক্রি করবো যা তোমাদের মৃত্যু সহজ করে দেবে, তখন ঐ হতাশায় ভোগা মানুষগুলো উৎসাহ পায়৷ দামটাও খুব-একটা কম রাখিনি, দশ হাজার খুব ছোট অ্যামাউন্ট নয়৷ দশ হাজার টাকা জোগাড়ের জন্য বেশিরভাগ মানুষকেই ভাবতে হয়৷ অনেক বড়লোক মানুষ যারা তাদের ব্যাপার আলাদা; কিন্তু মধ্যবিত্ত মানুষগুলো তখন মৃত্যুর চিন্তা একপাশে সরিয়ে টাকার জন্য চিন্তা শুরু করে৷ টাকার জন্য চিন্তা, টাকা জোগাড়ের উপায় খুঁজে বের করা মৃত্যুর চিন্তার চেয়েও কঠিন৷ আমি এই সময়টাকেই কাজে লাগাই৷ মরতে চাওয়া মানুষটার ঠিকুজি-কুষ্ঠি, এককথায় আদ্যপান্ত খুঁজে বের করি৷ খুঁজে বের করি মানুষগুলোর আপনজন কারা... ভালোবাসার মানুষ কারা... কে দিতে পারবে একটুখানি মমতার পরশ৷ একটুখানি মমতার পরশ আর মাথার উপর রাখা ভরসার হাত যে এমন কু-চিন্তা মুহূর্তেই উড়িয়ে দিতে পারে, আর কোনোকিছুই এ ব্যথার মলম নয়, জগতের সকল ব্যথার মলম একটুখানি ভালোবাসা ...


অলি আমার সাথে দেখা করতে এলো৷ প্রথমেই অবাক হয়ে বললো  "আপনি একজন ছেলে..? আমি আশা করেছিলাম মহিলা!" আমি শুধু হেসেছিলাম, আর বলেছিলাম, "আমার নাম আঁধার.." আর কিছু বলিনি৷ সবাই এমন কেন ভাবে আমি জানি না, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম সাক্ষাতে আমাকে এই কথাটিই বলে৷ প্রথমে ইতস্তত বোধ করছিল বোধহয়, কিছুক্ষন কথা বলার পর ও খানিকটা সহজ হলো৷ ফুলস্লিভ হাতার জামা পরে এসেছিলো অলি৷ আমাকে জামার হাতা তুলে দেখালো দগদগে নতুন ঘা..! আমি ওর ফর্সা হাতে ব্লেডের ক্ষতগুলো দেখে রীতিমতো কেঁপে উঠেছিলাম৷ আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠেছিলো সে সময়৷ আমি প্রসঙ্গ বদলে ওর বাবা-মায়ের কথা জানতে চাইলে অলি নির্বিকার গলায় বললো "তারা আমাকে ত্যাগ করেছে আঁধার, তাদের সামনে দাঁড়াবার সাহস আমার নেই!" এই একটা ভুল সন্তানেরা সবসময় করে৷ তারা জানে না বাবা-মা এমন মানুষ, তারা সন্তানের পাহাড়সম অপরাধ এক নিমেষে ক্ষমা করে দিতে পারে... অলি দশহাজার টাকা বের করে আমার কাছে সুইসাইড বক্সটা চাইলো৷ আমি আমার পুরোনো ট্রিকটা খাটালাম৷ পুরোদস্তুর ব্যবসায়িকের মতো গলায় বললাম, "শিপমেন্টে আটকে আছে.. আসলে এটা তো লিগ্যালি আনার উপায় নেই, চায়না-তে তৈরি হয়৷ ওখান থেকে অনেক কায়দা করে আনতে হয়, তবে সামনের সপ্তাহেই চলে আসবে৷ আপনি অর্ধেক অ্যাডভান্স করে যান৷ আমার ডিলারকেও দিতে হবে তো, এই মুহূর্তে আমার একদম হাতখালি নাহলে অ্যাডভান্স নিতাম না ..." 


এই অ্যাডভান্সটা আমি নিই মানুষদেরকে আরো একটু দ্বিধায় ফেলতে৷ অপরিচিত একজন মানুষকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে নিশ্চয়ই কেউ নিশ্চিন্তে থাকবে না৷ তার মাথায় তখন সুইসাইডের চিন্তার পাশাপাশি ঘুরবে আরেকটা চিন্তা ...টাকার চিন্তা .... এতগুলো টাকা একজন অপরিচিত মানুষকে দিলো, টাকাটা মার যাবে না তো! জিনিসটা পাবে তো! 


আমি অলির হসপিটাল থেকে খুঁজে বের করলাম ওর আরেকজন কাছের মানুষ ডাঃ ঋতু কে৷ ডাক্তার ঋতু-র সাহায্য নিয়ে খুঁজে বের করলাম অলির বাবা-মায়ের ঠিকানা ... 


আন্টি আঙ্কেলের সামনে গিয়ে অলির কথা বলতেই আঙ্কেল দৃঢ় গলায় জানালো, "এই বাড়িতে ঐ মেয়ের নাম নেওয়া নিষেধ ...তুমি চলে যাও ..." আমি আঙ্কেলের হাত ধরে ফেললাম৷ আঙ্কেলের হাত ধরে বললাম, "আঙ্কেল, আপনাদের মেয়েটা ভীষণ কষ্টে আছে... ওর স্বামী ওকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছে.. আপনাদের মেয়েটা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছে, সুইসাইড করবে যেকোন সময়!" পাশে দাঁড়িয়ে আন্টিও কাঁদছিলেন! এবার আঙ্কেলও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন৷ তারপর তাদের বুঝিয়ে বললাম পুরো ব্যাপারটা... তাদের রাজী করালাম আমার সাথে গিয়ে অলির সাথে দেখা করতে ..


অলিকে খবর দিলাম 'সুইসাইডাল বক্স' চলে এসেছে বলে৷ অলি চলে এলো নির্দিষ্ট সময়ে৷ আমি আর এবার সামনে গেলাম না, আন্টি-আঙ্কেলকে পাঠালাম ... তাদের দেখে অলি প্রথমে খানিকটা ঘাবড়ে গেলো৷ তারপর আঙ্কেল যখন জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন এক মুহূর্তের মধ্যেই যেন বরফ গলে গেলো৷ তখন আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম অলির৷ তারপর অলির হাতে সেই অ্যাডভান্স হিসেবে নেওয়া পাঁচহাজার টাকা দিয়ে বললাম, "অলি, জীবনটা যতই জঘন্য হোক.. নিজের জন্য বাঁচো, বাবা-মায়ের জন্য বাঁচো ... গ্রুপ থেকে লিভ নিও৷ ঐ গ্রুপ আর তোমার দরকার নেই ... এ ব্যাপারে আর কারও সাথে, কোনও কথা বলবে না প্লিজ..." 


আমি চলে আসছিলাম, এমন সময় অলি দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো "আঁধার, আমি মা-বাবার একমাত্র সন্তান, কিন্তু তোমার মধ্যে আজ আমার দাদা বা ভাইকে পেলাম, ভালো থেকো..." আমার তখন মনে হলো আমার তিতলী আমাকে জড়িয়ে ধরেছে, আমার ভীষণ কান্না পেয়ে গেলো.. কিন্তু আমি কাঁদলাম না, কাঁদলে দুঃখ কমে যায়৷ আমি তো এই দুঃখ, এই শোক কখনোই কমাতে চাই না৷ এই শোক থাকুক, না হলে আমি অন্ধকারে থাকা তিতলী দের আঁধার থেকে বের করার শক্তি কোথায় পাবো! 


মিতালী গোস্বামী-র খোঁজ নিলাম৷ ভদ্রমহিলার সত্যিই কেউ নেই৷ নেই নিজের বলতে কেউ, কোন আপনজন৷ কেউ নেই অলির বাবা-মায়ের মতো তার হাত ধরার ... আমি এবার চিন্তায় পড়ে গেছি৷ কি করবো! 


অনেক ভেবে দেখলাম, যতই তার কেউ না-ই থাক, কিন্তু তার বাচ্চাটার তো মা আছে! এই মাকেই হতে হবে এতটা শক্তিশালী যেন সন্তানের ভার সে-ই নিতে পারে৷ শুধু অন্ন-বস্ত্রের জন্য যেন কারো লালসার স্বীকার হতে না হয় ঐ নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে ...


আচ্ছা, দশ হাজার টাকায় কি কোনো ব্যবসা দাঁড় করানো যায় না? নিশ্চয় যায়৷ সেটাই বরং খুঁজি৷ আত্মনির্ভরশীল হতে হবে মিতালী কে৷ হতেই হবে, হতেই হবে !


****-****


রিমার বাবা আজ বাড়িতে আছে, তার আজ ভালো লাগছে৷ একবার বাবার ঘরে ঢুঁ মারলো রিমা৷ মানুষটার সাথে কথা বললে ভীষণ শান্তি পায় রিমা, যদিও কথা হয় না বেশি৷ রিমার বাবা খুবই সল্পভাষী মানুষ; আজও রিমা বাবার কাছে গেলো ৷ 


রিমার বাবা সম্প্রতি দুটো জাহাজ কিনেছেন৷ জাহাজদুটোতে তার ইনভেষ্ট করতে হয়ে বেশ মোটা অংকের একটা টাকা৷ এ দুটো জাহাজের একটা এখন আটকা পড়েছে আটলান্টিক মহাসাগরে৷ ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে অনেক৷ রিমার বাবার প্রেসার বেড়ে গেছে৷ টাকার টেনশন বড় টেনশন! তা সে যত কোটিপতি মানুষই হোক না কেন, টাকার শোক সামলানোর মতো মানসিক শক্তি সবার থাকে না ....


রিমা এসে বসলো বাবার পাশে৷ ভদ্রলোক একটু বিরক্ত হলেন৷ এই মুহূর্তে আটকে পরা জাহাজের চিন্তা ছাড়া তার মাথায় অন্য কোন চিন্তা নেই .. তার কথা বলতেও ইচ্ছা করছে না, আর সবচেয়ে বড় কথা মেয়ের সাথে বলার মতো কোন কথাই খুঁজে পান না .. মেয়েটা বড় হয়ে গেছে৷ মেয়ের সাথে তার মানসিক দুরত্ব বেড়েছে ... এখন হঠাৎ কোন কথা বলতে গেলেই কেন যেন তার মনে হয় কথাটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে৷ বেশ গুছিয়ে তিনি অপ্রয়োজনীয় এলোমেলো কথাগুলো বলছেন৷


রিমার বাবা তাই খানিকটা বিরক্ত গলায় রিমাকে বললেন "মামনি, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি একটু একলা থাকতে চাই এখন..."


রিমা কথা না বাড়িয়ে বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো .... তারপর সোজা চলে গেলো ছাদে৷ ছাদে গিয়ে একদম কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রিমার মনে হলো "আচ্ছা, এখান থেকে লাফ দিলে কেমন হবে? বাবা জানার পর ঠিক কি কি করবে...."


কল্পনায় রিমা স্পষ্ট দেখছে, রাস্তায় উপুর হয়ে পরে আছে তার লাশ ... রক্তাক্ত.... রিমার বাবা বিরক্ত মুখে তার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে আছে...


চলবে..


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #৩য়_পর্ব

Saturday, 2 September 2023

'সুইসাইডাল বক্স' (২)


'সুইসাইডাল বক্স'

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ২

_____________________


গেমের একটা পর্যায় এসে নিজে থেকে চ্যাটরুম অন হয়ে যায়.. সেই সুত্রে একটা ম্যাসেজের আংশিক ছবি!


— হ্যালো, আমি কি 'অন্ধকারের যাত্রি'র সাথে কথা বলছি! আমি সুইসাইডাল বক্সটি কিনতে আগ্রহী ৷


—আপনার নাম?


— প্রোফাইলে যেই নামটা দেওয়া আছে, মিতালী গোস্বামী৷


—প্রোফাইলে তো সবার সঠিক নাম দেওয়া থাকে না, যেমন আমার নিজেরও নেই ৷ যাই হোক, আপনি অ্যানাউন্সমেন্ট পোস্টটি পড়েছেন মন দিয়ে?


— আজ্ঞে হ্যাঁ, পড়েছি .. 


—তাহলে তো আপনি সবটাই জানেন, কি করতে হবে, আর কি করা বারণ, তাই না? 

আচ্ছা বলুন তো, কি কারনে সুইসাইড করতে চান?


— কারনটা কি বলতেই হবে? দেখুন আমার কাছে যেটা যৌক্তিক কারন, আপনার কাছে নাও হতে পারে৷ আর কারন বললেই যে আমি জিনিসটা পাবো তার গ্যারান্টি কি?


—কোন গ্যারান্টি নেই, কারনটা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হতে হবে৷ দেখুন, এটা আমার বিজনেস৷ সবার বিজনেসেরই কিছু রুলস থাকে, আমার রুলস এটাই৷ আপনি বলতে না চাইলে সেটা একান্তই আপনার ব্যাপার, তবে কারন না বললে আমি আপনার সাথে লেনদেন-এ যাবো না৷


— হুম , বুঝতে পারছি..


—বেশ, তাহলে কী ঠিক করলেন? বলতে চান নাকি চান না ..


— আমার বিয়ে হয়েছে বারো বছর আগে, আমার একটা মেয়ে আছে দশ বছর বয়সের৷ 


—তারপর..


— থাক গে, আর বলবো না! আপনাকে বিরক্ত করার জন্য সরি৷


—সরির কিছু নেই দিদি৷ তবে, বলতে না চাইলে বলতে হবে না৷


— আচ্ছা সুইসাইডাল বক্সে কি একসাথে দুজন ঢোকা যাবে? না মানে.. স্পেস কতটা?


—আজ্ঞে... যাবে বলে মনে হয়৷ 


— আমার মেয়েটাকে ওর নিজের কাকা অ্যাবিউজ করছে ... দিনের পর দিন... বাচ্চাটা আমার কেঁদে কেঁদে বলে "মা, আমার ব্যথা করে, আমার খুব কষ্ট হয় .." 


—আপনি এই সত্যিটা জানার পরেও চুপ করে আছেন? ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না!


— আমি বিধবা..  আমার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই৷ এক ভাই আছে, সেও আমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে আমাদের দায়ভার সে নিতে পারবে না৷ তাই আমাকে এ বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে৷ আমি যে কি পরিমান নিঃস্ব, সেটা আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না৷ এই বক্স কেনার টাকা কোথায় পাবো আমি তাও জানি না, তবে কোনো-না-কোনো উপায়ে জোগাড় করে ফেলবো৷ এই কষ্ট সহ্য করে বেঁচে থাকার চেয়ে, মা-মেয়ে মিলে মরে যাওয়াটাই সহজ৷ আমি একা হলে এই ঝামেলায় আসতাম না ... আমার মেয়েটা অলরেডি অনেক কষ্ট পেয়েছে, অন্তত মৃত্যুটা সহজ হোক ওর জন্য!


—কিছু মনে না করলে আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি, মানে আপনি লেখাপড়া কতদূর করেছেন?


— বি.এ. অনার্স পাশ করেছি, রেজাল্ট ভালো ছিলো না, থার্ড ক্লাস পেয়েছিলাম ৷


—রেজাল্ট টা মূখ্য বিষয় না দিদি... আচ্ছা বাদ দিন, আপনি টাকাটা কিভাবে জোগাড় করবেন বল্লেন নাতো, আমি কিন্তু দাম কমাবো না.. ফিক্সড প্রাইস৷


— এখনও ঠিক জানি না, দেখি! কিছু যদি না হয় তো স্বামীর শেষ চিহ্ন হিসেবে একটা চেন আছে সোনার, ওটাই বিক্রি করে দেবো না হয়.. 


—ঠিক আছে৷ আপনি টাকা জোগাড় করে আমাকে নক দেবেন, আজ রাখছি৷ 


— আমি তাহলে সুইসাইডাল বক্সটা পাচ্ছি তো?


—এখনই কনফার্ম বলতে পারবো না, আগে ভেরিফিকেশন করতে হবে, তারপর৷ 


— ঠিক আছে, আমি টাকা জোগাড় করেই আবার নক দেবো না হয়! 


মিতালী গোস্বামী! আমার নতুন তিতলী৷ এটাও কি সম্ভব? দশ বছরের বাচ্চাকে শারিরীকভাবে নোংরা করছে তার আপন কাকা! আর কত কষ্টকর গল্প শুনতে হবে আমাকে... আমার যে ভীষণ কষ্ট হয়, বারবারই মনে হয় আমার তিতলী-র বোধহয় এরকমই কোনও এক কষ্ট ছিলো, যা আমার জানা হয়ে ওঠেনি৷ 


আমার হাতে সময় বেশি নেই৷ আমি জানি মিতালী গোস্বামী খুব তাড়াতাড়ি টাকার ব্যবস্থা করে ফেলবে৷ মরার জন্য টাকার জোগার করতে দেরি হবার কথা নয়৷ অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে৷ যদিও দশ হাজার টাকা খুব ছোট অ্যামাউন্ট ও নয়, তবু মন বলছে দু-তিন দিন লাগবে বড়ো জোর! এর মধ্যেই আমাকে আমার কাজ করতে হবে৷ 


******


রিমার ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যেবেলার দিকে, আকাশটাতে লালচে রঙ ধরতে শুরু করেছে৷ ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দাঁড়াতেই রিমা দেখলো আনোয়ারা দাঁড়িয়ে আছে, চায়ের ট্রে হাতে করে৷ এই মেয়েটাকে মাঝে মাঝে অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা সম্পন্ন মনে হয় রিমা-র৷ রিমার ঘুম ভাঙার পর কখনোই অপেক্ষা করতে হয় না, মেয়েটা গরম-গরম চা নিয়ে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকে৷ 


চা খেতে খেতে রিমা ফোনটা অন করলো, একগাদা নোটিফিকেশন এসেছে তাতে৷ একটা নোটিফিকেশনে চোখ আটকে গেলো রিমার৷ অলি পোস্টেড ইন দি গ্রুপ "সুইসাইডাল বক্স" .. এই অলি কে রিমা জানে না৷ তবে তার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে৷ এই মেয়েটিই তাকে ঐ গ্রুপে ইনভিটেশন পাঠিয়েছিলো৷ ওখানে বলা ছিলো, যাদের দেখে মনে হয় সুইসাইড করতে চায় শুধু তাদেরই ইনভাইট করতে! কিন্তু রিমা অবাক হয় এই ভেবে, যে তার সোশ্যাল লাইফ দেখে তো এটা বোঝার উপায় নেই, যে সে সুইসাইড করতে চায়, এমনকি ও যে অ্যাটেম্পট নিয়েছিলো সেটাও তো পাবলিক করেনি! ফেসবুকে তো রিমা ভীষণভাবে সুখী৷ রিমা অলির পোস্ট চেক করে৷ তিন লাইনে অলি লিখেছে—


"অন্ধকারের যাত্রি-কে চিনেছি বলেই আজ আলোকে চিনতে পারলাম৷ তোমাকে ধন্যবাদ বলে আসলে আমার মনের কৃতজ্ঞতাবোধ প্রকাশ করতে পারবো না, তাই সে চেষ্টাও করলাম না৷ নিয়মানুযায়ী গ্রুপ থেকে চলে যাচ্ছি, ভালো থাকবেন, নমস্কার৷"


রিমা এবার একটু ঝটকা খেলো৷ 'অন্ধকারের যাত্রি' নামের ছেলে বা মেয়েটা আসলে কি এমন করেছে অলির জন্য যে অলি এতটা কৃতজ্ঞ! রিমা নিজে থেকে কখনো কাউকে নক দেয় না ইনবক্সে, এতে তার সেলিব্রিটি ইমেজটা একটু কেমন কেমন দেখায়! তবে, আজ সে নিজে থেকেই নক দিলো অলিকে.. অলি যেন জানতো রিমা নক করবে, সাথে সাথেই রিপ্লাই পেলো রিমা ওপার থেকে৷


—হ্যালো, ভালো আছেন অলি?


—আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন?


—ভালো, আচ্ছা.. আপনি আমাকে একটা গ্রুপে ইনভাইট করেছেন, 'সুইসাইডাল বক্স' নামের!


—আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি জানি আপনার সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি আছে৷ আপনি বোধহয় আমার কথা ভুলে গেছেন৷ আপনার সাথে কিন্তু আমার কথা হয়েছিলো..


—আসলে কিছু মনে করবেন না, আমি মনে করতে পারছি না! আর প্রোফাইলে ও কোনো ছবি নেই তো, ছবি থাকলে হয়তো চিনতে পারতাম৷ 


—কিছুদিন আগে আপনি ট্যাবলেট খেয়েছিলেন, তখন আপনাকে যে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছিলো আমি সেখানকারই ডাক্তার৷ হসপিটালে সাত দিন আমিই আপনাকে অ্যাটেন্ড করেছি৷ মনে পড়েছে এবার?


—ও.. আচ্ছা আচ্ছা, মনে পড়েছে৷ সরি..সরি আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম৷ আচ্ছা আমাকে বলো তো গ্রুপটার ব্যাপার কী! 


—মাফ করবেন, গ্রুপের ব্যাপারে আলোচনা করা তো একদমই নিষেধ৷ বিশেষ করে যারা গ্রুপ থেকে বেরিয়ে চলে আসবে তাদের জন্য একেবারেই নিষেধ৷


—আরে না না, কোন সমস্যা নেই, তুমি বলতে পারো, আমি কি কাউকে বলতে যাবো নাকি!


—দেখো, তুমি বরং 'অন্ধকারের যাত্রি' আইডিতে ম্যাসেজ করো, যা বলার বা করার ওনারাই করে নেবেন!


—ওসব পাগল ছাগলের সাথে কি আর কথা বলবো! থাক বাদ দাও, এই ইস্যু নিয়ে যথেস্ট ভেবে ফেলেছি৷ তুমি বলতে না চাইলে ইটস ওকে৷


—তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে, যদি কখনো আবার এমনটা হয় যে তোমার মনে হচ্ছে পৃথিবীটা বড্ড অর্থহীন, তাহলে প্লিজ ঐ আই ডি টাকে নক দিও! এটা রিকুয়েস্ট৷


—তুমিও কি সুইসাইড করতে চেয়েছিলে নাকি? 


—এসব বলা বারণ আছে রিমা! 


—ঠিক আছে, করুনাময় তার মঙ্গলময় হাত তোমার দিকে বাড়িয়ে দিক, ভালো থেকো অলি..


—তুমিও ভালো থেকো রিমা ..


রিমা-র আবার বিরক্তি লাগা শুরু হয়, অযথাই মেয়েটাকে নক করতে গেছে সে! 


**********


মিতালী গোস্বামী-র খোঁজ খবর বের করা খুব একটা কঠিন হলো না৷ আমি বরং এর চেয়েও ঝামেলা করে এর আগের ক'য়েকটা কেসের খোঁজ বের করেছি৷ যেমন আমার লাস্ট কেস অলি, কম হয়রানি হয়নি ওর ডিটেলস বের করতে৷ অলিকে যে শেষ পর্যন্ত ফেরাতে পারবো এটা আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিলো না! এর চাইতে মিতালী-র কেস সহজ হবার কথা!


অলির কথা মনে হলে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে৷ মেয়েটার সর্বনাশ করেছিলো তাকে ভালোবাসি বলা মানুষটাই৷ বাবা ছেড়ে যার হাত ধরে ঘর ছেড়েছিলো, সেই মানুষটি পেশায় একজন ডাক্তার অলির মতোই৷ একই হসপিটালে কর্মরত ছিলো দুজনে৷ অলির সেই ডাক্তার স্বামীটি এর আগেও বিবাহিত ছিলো৷ ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিলো দুজনের৷ এরপরই অলি আসে তার জীবনে৷ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে অলি৷ তার ডাক্তার হবার পথ অতোটা মসৃন ছিলো না, শুধুমাত্র বাবা-মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে অর্জিত অর্থ আর নিজের অসম্ভব রকমের মেধা অলিকে ডাক্তার বানিয়েছিলো৷ সেই অলি বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে, ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিলো সেই আরেক ডাক্তারের সাথে৷ ঘর ছাড়বার আগে অলির মা শুধু একটা কথাই অলিকে বলেছিলো "যার বউ ছেড়ে গেছে, কোন না কোন কারনেই তো গেছে! ভালোমতো খোঁজ না নিয়ে তুমি তার জন্য পাগল হয়ো না..." 


অলির তখন পাগল হবার সময়ই ছিলো৷ আমি অন্ধকারের যাত্রি হয়ে যখন শুনেছি অলির গোপনগাথা, তখন শিউরে উঠেছি ভিতরে ভিতরে ... কী নিদারুণ, কী ভয়ানক! আবার নতুন করে বুঝেছি,  বাবা-মা যা বলে ভালোর জন্যই বলে, পৃথিবীতে বাবা-মার চেয়ে আপন আর কেউ নয়৷ 


অলির স্বামীটি ছিলো একজন অসুস্থ মানসিকতার এক রোগী! ডাক্তারের সাদা অ্যাপ্রনের তলায় তার ছিলো একটা কুৎসিত, কালো, কলুষিত মন... মাথায় ছিলো বিকার! ভয়ানক! ভয়ানক সেই বিকার ...


চলবে...


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #২য়_পর্ব 

Saturday, 26 August 2023

"সুইসাইডাল বক্স"..

 


'সুইসাইডাল বক্স'

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ১

_____________________


তিতলী সুইসাইড করেছে, ওর নিথর দেহটা ফ্যান থেকে ঝুলছে৷ আমার মা পাশের ঘরে অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছে৷ একটু পরপর থেকে-থেকেই মায়ের জ্ঞান ফিরছে আর মা চিৎকার করে কেঁদে উঠছে.."ও রে, ও তিতলী রে ...মা রে, আমার মনা.." 


লোকজনে আর পুলিশে বাড়ি ভর্তি৷ তিতলীর শরীরটা তারা নামিয়ে ফেলেছে৷ প্লাস্টিকে মুড়ে সেই শরীরটা তারা নিয়ে চলে যাচ্ছে, অ্যাম্বুলেন্সে করে৷ মোড়কের বাইরে থেকে তিতলীর পা দুটো দেখা যাচ্ছে .... তিতলী, আমার যমজ ছোট বোন! আমার দশ মিনিট পরে যার জন্ম হয়েছিলো৷ মায়ের গর্ভে আমরা একসাথেই বেড়ে উঠেছিলাম, অথচ আজ তিতলী আমার আগেই কেমন যেন স্বার্থপরের মতো আমাকে একলা করে দিয়ে চলে গেল৷ আমার চোখে জল নেই৷ আমি যেন কান্নাশূন্য এক মানুষে পরিণত হয়েছি৷ বাবা আগে চলে গিয়ে ভালোই করেছে, নয়তো মায়ের মতোই আজকের দিনটা তাকেও সহ্য করতে হতো ...


*********


সারারাত ঘুমোয়নি রিমা৷ খাটের পাশের ইজি-চেয়ারটাতে বসে ফেসবুক স্ক্রল করছিলো সে৷ ফেসবুকে তার ফ্যান ফলোয়ারের অভাব নেই৷ অপরূপা রিমা মাঝে মধ্যে লাইন চারেকের কবিতা লেখে, ধারাবাহিক গল্প লেখে৷ অবশ্য তার ফলোয়াররা সে সব গল্প-কবিতার কতটুকু বোঝে রিমা নিজেও সে ব্যাপারে সন্দিহান৷ তার ফেসবুক সেলিব্রিটি হবার মূল কারন তার চেহারা৷ রিমা নিজের মনেই হাসে৷ ফ্রেন্ডলিস্টে পাঁচ হাজারের কোটা তার অনেক আগেই পূর্ন হয়েছে৷ এই পাঁচ হাজারের মধ্যে পাঁচশ জনকেও সে চেনে কিনা সন্দেহ৷ তাতে কি, এই ফেসবুকের লাইফটা তার ভালো লাগে৷ পরপর তিনবার সুইসাইড অ্যাটেম্প্ট নেওয়া রিমা ফেসবুকে বেশ হাসিখুশি ৷ 


ভাবনার বেড়াজাল কাটে ফোনের 'টুং' আওয়াজে৷ নোটিফিকেশন এসেছে ফেসবুকে৷ রিমা নোটিফিকেশন চেক করে দেখে অলি ইনভাইটেড ইউ টু দ্য গ্রুপ- "সুইসাইডাল বক্স" .... 


প্রতিদিন এমন হাজারও গ্রুপের ইনভিটেশন আসে৷ আজকাল গ্রুপের তো আর অভাব নেই৷ রিমা এ ধরনের নোটিফিকেশন দেখেও দেখে না, কিন্তু আজকে গ্রুপটার নাম দেখেই তার কেমন যেন আগ্রহ জাগলো৷ সে গ্রুপটার জয়েন রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করে ফেললো৷ তারপর রাত জাগা ক্লান্তি এক পাশে রেখে স্ক্রল করতে থাকলো গ্রুপের হোম পেজ ...


সিক্রেট গ্রুপ, এমন নামের গ্রুপ সিক্রেট হবে এটাই স্বাভাবিক৷ গ্রুপ ডেসক্রিপশনে ছোট্ট করে লেখা আছে, "যারা আত্মহত্যা করতে চান, শুধু তারাই যোগাযোগ করবেন৷" ব্যস এটুকুই... আর কিছু না ! 


রিমা অ্যানাউন্সমেন্ট পোস্টগুলো দেখতে থাকে৷ গ্রুপের ফাউন্ডার এডমিনের নাম 'অন্ধকারের যাত্রি'... একটা মুখোশের ছবি দেওয়া প্রোফাইল পিকচার হিসেবে৷ রিমা আগ্রহী হয়ে আইডিটাতে ঢোকে৷ আইডিতে কিচ্ছু নেই৷ কোনও ইনফরমেশনই নেই৷ এমনকি মেল না ফিমেল সেটাও দেওয়া নেই৷ তারওপর আইডিটা লক করা! রিমা খানিকটা বিরক্ত হয়ে 'অন্ধকারের যাত্রি' আইডি থেকে বের হয়ে এলো৷ গ্রুপ থেকে লিভ নিতে গিয়েও অ্যানাউন্সমেন্ট পোস্টটা আবার মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলো৷ সেখানে বিশদ ভাবেই লেখা আছে গ্রুপের উদ্দেশ্য কি! ওখানে লেখা—


"সুইসাইড করার জন্য যারা সবচেয়ে সহজ এবং কম কষ্টের, ঝুকিহীন কিছু পন্থা খুঁজছেন তাদের সাদরে আমন্ত্রন৷ উন্নত টেকনোলজি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে 'সুইসাইডাল বক্স'৷ এটি একটি চারকোনা ঘর সদৃশ বস্তু যা সহযেই ভাঁজ করে বহন করা যায় সুটকেসের মতো৷ বক্সটি রূপান্তরিত হয় একটি ব্যুথে, সেখানে আছে একটি গ্যাস চেম্বার, সুইচ অন করলে সেখান থেকে নির্গত হবে বিষাক্ত গ্যাস, যা মাত্র চার-পাঁচ মিনিটে আপনার মৃত্যু নিশ্চিত করবে৷ এই মৃত্যু হবে যন্ত্রনাহীন, কিছু বুঝে উঠার আগেই আপনার এপারের যাত্রা সাঙ্গ হবে৷ বক্সের মূল্য মাত্র দশ হাজার টাকা, কোন বার্গেনিং করা যাবে না৷ তবে শুধুমাত্র টাকা দিলেই যে আপনি এই বক্সের মালিক হবেন এমনটা ভাবলে ভুল করছেন৷ এজন্য অবশ্যই আপনাকে নিচের সবগুলো শর্ত পূরন করতে হবে৷ শর্তগুলো হলো;


১. প্রথমেই ম্যাসেজে বলতে হবে আপনি কেন সুইসাইড করতে চান৷ আমাদের যদি মনে হয় আপনার সুইসাইডের কারন যথেষ্ট যৌক্তিক, তাহলেই আপনার কাছে সুইসাইডাল বক্সটি বিক্রয় করা হবে, নচেৎ নয়৷


২. আপনার বয়স আঠারো প্লাস হতে হবে৷


৩. আপনার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সঠিকভাবে দিতে হবে৷ এসব তথ্য ভেরিফিকেশন করে যদি মনে হয় ভুল তথ্য দিয়েছেন তাহলে আপনার কাছে 'সুইসাইডাল বক্স' বিক্রয় করা হবে না৷


৪. শুধুমাত্র নিজের জন্যই কিনতে পারবেন, অন্য কারও জন্য নয়৷ 


৫. এ বিষয়ে সকল তথ্য গোপন রাখতে হবে৷ 


৬. একান্ত পরিচিত যাকে মনে হয় সে আসলেই সুইসাইড করতে চায় শুধু তাকেই গ্রুপে অ্যাড করতে পারবেন, নচেৎ চিরতরে ব্যান করা হবে গ্রুপ থেকে৷


৭. অযথা প্রয়োজন ছাড়া অ্যাডমিন আইডিতে ম্যাসেজ করতে পারবেন না, এবং কোন পোস্টও দিতে পারবেন না, প্রয়োজনেই শুধু পারবেন৷


রিমা ধৈর্য্য ধরে পোস্টটি পড়লো৷ তারপর নিজে নিজেই বলে উঠলো "পাগল-ছাগলে দেশ ভরে গেছে ... সুইসাইড বক্স নাকি!... এগুলো মানুষে বেচে? পাগলা কোথাকার, খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই আর, যত্তসব!..."


ফেসবুক থেকে বেরিয়ে সকালের মিষ্টি আলোয় ব্যালকনিতে গিয়ে কয়েকটা সেলফি তুলে ফেলে রিমা৷ এ আলোতে ছবি ভীষণ সুন্দর হয়৷ গায়ের রং থেকে যেন আলো ঠিকরে বের হয়৷ তারপর সেলফিগুলো এডিট করে আরও একটু সুন্দর করে সাজিয়ে পোস্ট করে নিজের প্রোফাইলে ... ছোট্ট একটা ক্যাপশন জুড়ে দেয় তার সাথে! 


"সুপ্রভাত সুহৃদগন.."


মুহূর্তেই লাইক, কমেন্ট আর রিয়্যাক্টে ভরে যায় সেই পোস্ট৷ দশ মিনিটে লাইক, কমেন্ট এক হাজার ছাড়িয়ে যায়৷ রিমা নিজের মনেই হাসে ... হেসে হেসেই আবার বলে "পাগল-ছাগলে দেশ ভরে গেছে.. এই পোস্টে এত লাইক কমেন্টের কি আছে ...পাগলের দল সব ...চিকিৎসার দরকার সবার.."


দরজায় নক করছে কেউ৷ রিমা জানে আনোয়ারা বেগম নক করছে৷ বিরক্তি নিয়ে বারান্দা থেকে উঠে গিয়ে দরজা খোলে সে৷ হাতে ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আনোয়ারা, সে জানে তার দিদি সকালে জলখাবার করেই ঘুমোয়; তাই যতটা দ্রুত সম্ভব খাবার তৈরি করে, মানুষটা যত তাড়াতাড়ি খাবে তত তাড়াতাড়ি ঘুমোবে৷ একটা মানুষ কিভাবে সারারাত জেগে থাকে আনোয়ারা-র মাথায় ঢোকে না !


রিমা চুপচাপ সুবোধ বালিকার মতো জলখাবার খেয়ে নেয়৷ তারপর কড়া ডোজের সিডেটিভ খেয়ে বিছানায় শুতে যায়৷ সারারাত বিছানাটা ফাঁকা পড়ে ছিলো৷ কড়া সিডেটিভেও রিমার ঘুম আসতে চায় না৷ জোর করে, চোখ বন্ধ করে ঘুমাবার চেষ্টা করে সে ..


রিমার বাবা অমল মজুমদার, এ শহরের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ীদের একজন৷ রিমার মা মারা গেছেন অনেক আগেই৷ ভদ্রলোক মেয়ের কথা ভেবেই হয়তো আর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেননি৷ অবশ্য রিমার ধারনা তার বাবা বিয়ে করেননি সময় পাননি বলে৷ ভদ্রলোক সারাদিন ভীষন ব্যস্ত থাকেন৷ মেয়ের সাথে তার দেখা হয় সপ্তাহে একদিন, রবিবার৷ ঐদিন তার বাবা অফিসে যান না, সারাদিন নিজের ঘরেই থাকেন৷ রিমার সাথে তার তেমন বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক না, তবুও রবিবার রিমার মন ভালো থাকে৷ বাবা বাড়িতে আছে এই বোধটুকুও স্বস্তির ....


সিডেটিভ কাজ করতে শুরু করেছে৷ রিমা ঘুমিয়ে পড়ছে অতি দ্রুত৷ তার চিন্তাগুলো এখন কেমন যেন জড়িয়ে যাচ্ছে৷ তার মনে হচ্ছে সে যেন কোন একটা নৌকায় ... মাঝ নদীতে মাঝিহীন সেই নৌকা দুলছে, সেই দুলুনি যেন ছোটবেলার দোলনার মতো৷ ধীরে ধীরে সে ঘুমিয়ে পড়ে, গভীর শব্দহীন এক অতল ঘুমে...


**********


তিতলী মারা যাবার কিছুদিন পরেই আমি 'অন্ধকারের যাত্রি' নামের আইডিটা খুলেছিলাম৷ কেন খুলেছিলাম জানি না৷ দুবছর হয়ে গেছে তিতলী আমাদের মাঝে নেই৷ আমার যমজ বোন, আমার দশ মিনিট পরে যার জন্ম হয়েছিলো দু'বছর আগে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে৷ ঐ আইডিটার সুবাদে গত দুই বছরে আমি এমন অনেক তিতলী-র সন্ধান পেয়েছি যারা সবাই মরতে চায়৷ মৃত্যু কতটা সহজ শব্দ তাদের কাছে৷ আমি মনোযোগ দিয়ে তাদের কথাগুলো শুনি৷ আমার তিতলী-র কথাগুলো আমার শোনা হয়ে ওঠেনি, আমি জানিনা কোন কষ্ট বুকে নিয়ে আমার বোনটা চলে গেলো, তবে আঁধার জানে আঁধারে থাকা হাজার খানেক তিতলীদের গল্প৷ আমার গ্রুপ "সুইসাইডাল বক্স" জানে তিতলীদের গোপন গাথা৷ 'অন্ধকারের যাত্রি' হয়ে আমি মেয়েদের আঁধারের গল্প শুনি৷ মাঝে মধ্যে কেঁপে উঠে ভাবি পৃথিবী কি সত্যিই এতটা ভয়াবহ! মাঝে মধ্যে অবাক হয়ে ভাবি মৃত্যুর জন্য এত ক্ষুদ্র কারনও কি যথেষ্ট? 


ম্যাসেঞ্জারে 'টুং' করে শব্দ হলো৷ আবার কেউ 'অন্ধকারের যাত্রি' কে ম্যাসেজ করেছে ....


চলবে .....


#ধারাবাহিক_গল্প #থ্রিলার #সুইসাইডাল_বক্স

Monday, 26 June 2023

Some Quotes, Every Parent Should Read Quite Often!

 

Perhaps it takes courage to raise children…


Our youth can’t possibly know how age thinks and feels. And likewise, as we age we are often guilty of being so busy-brained that we forget what it was like to be young. Spending time with my young son helps me tap into my younger mind — he keeps me on my toes. For that I am grateful, but I still struggle as a parent. I struggle to be present. I struggle to be patient. I struggle to remember. Almost every single day.


Truth be told, every parent battles with parenthood in their own way. Because parenting is not easy.


What helps me is journaling about the lessons parenthood is gradually teaching me, and then referring back to what I’ve learned when I’m struggling and forgetful.


Today, I want to share some quotes from my parenting journal with you. Perhaps they will assist you someday, the way they have assisted me again this morning…


• Trust yourself. You know far more than you think you do.


• Parenting is unquestionably one of the hardest things you’ll ever do, but in exchange it teaches you about the meaning and power of unconditional love.


• Everything involving your children will be painful in some way. The emotions are deep, whether they are happiness, heartache, love or pride. And in the end they will leave you vulnerable, exposed, and yes, in pain. The human heart was not meant to beat outside the human body, and yet you will find that your children carry with them just this kind of surreal phenomena — a loving, emotionally attached parent (YOU), with your heart exposed and beating forever outside of your chest. Breathe… It’s OK.


• No one is ever quite ready — every parent is caught off guard, again and again. Parenthood chooses you every day, not the other way around. And perhaps a week in, a month in, or even a year in, you open your eyes, look at what you’ve got, say “Oh, my goodness,” and suddenly awake to the fact that of all the things there ever were to juggle, this is the one you should not drop. It’s not a question of choice. It’s a presence of love.


• The nature of being a parent seems thankless sometimes, until you realize and embrace the fact that you are choosing to love your children far more than you have ever loved anyone before them, even more than you love your own parents. And, within this realization that your own children can’t possibly understand the depth of your love, you come to understand the tragic and yet immensely beautiful, unrequited, unconditional love your own parents have for you.


• Being a parent is a daily attitude, not a biological relation.


• To be in your children’s memories tomorrow, you have to make time to be in their lives today. Every day of our lives we make deposits in the memory banks of our children. The more present we are, the more deposits we get to make.


• When you take the time to open your mind and ears, and actually listen with humility to what people have to say, it’s amazing what you can learn. This is especially true if the people who are doing the talking also happen to be your children. 


• Your children are the greatest gift life will give you, and their souls the heaviest responsibility it will place in your hands. Take time with them, and teach them to have faith in themselves by being a person they can have faith in — a person who listens — a person they can trust without question. When you are old, nothing else you’ve done will have mattered as much.


• Walk the talk. Children have never been perfect at listening to their parents, but they have never failed to imitate them in some way.


• Your children need you to love them for who they are, not spend all your time trying to fix them.


• Children must be taught how to think, not what to think.


• Parents can only guide by example and put their offspring on the right path, but the final forming of a person’s character and life story lies in their own hands.


• All details aside, if you have never been “hated” by your kid for a short time, you have never truly been a parent. A harsh truth, I know.


• It’s absolutely impossible to protect your children against disappointment in life. Some things you just have to live through to learn.


• One of the best things you can do for your children as they grow is to let go and allow them to do things for themselves, allow them to be strong and responsible, allow them the freedom to experience things on their own terms, allow them to take the bus or the train and learn from life firsthand — allow them to be better people, allow them to believe more in themselves and do more by themselves. 


• No matter how great of a job you do parenting — especially if you truly do it right — your children won’t stay with you. They will eventually break away. It’s the one job in life, where the better you do, the more rapidly and surely you won’t be needed as often in the long run.


Afterthoughts

I want to end this post with a famous quote by Walt Disney that I’ve always loved:


“Children are people, and they should have to reach, to learn about things, to understand things, just as adults have to reach if they want to grow in mental stature. Life is composed of lights and shadows, and we would be untruthful, insincere, and saccharine if we tried to pretend there were no shadows. Most things are good, and they are the strongest things; but there are evil things too, and you are not doing a child a favor by trying to shield him or her from reality. The important thing is to teach a child that good can always triumph over evil.”


Now, it’s your turn…

I would love to hear from YOU before you go.


Please leave me a comment below to let me know what you think of this post and its advice.



Did you have a favorite quote or point? Anything else to share about parenting?


Your feedback is truly important to me, cheers! 


~Ushas ©


#Parenthood #Motivation #Mindcoach

Friday, 21 April 2023

How in different language say "When Pigs Fly."

 How different languages say “When Pigs Fly.”


Language diversity makes languages fun and interesting. It shows the varied potential of human genius and imagination. Imagine how much fun we would have been robbed of if we had only one language! Having different ways to say something across cultures is a great source of joy and fascination. I always ask my tremendously diverse community on Facebook about how they say stuff in their own languages and the results never stop to fascinate us. Down below is our latest thread of how different languages say “when pigs fly”, i.e. it will never happen. We hope you enjoy what you’re about to read...



Welsh:

When Christmas will be in the summer and goosberries in winter.


Turkish:

When a fish climbs a poplar tree.


Ukrainian:

When the crayfish on the hill whistles.


Portuguese:

On Saint Never’s day.


Tai:

When 7-11 closes.


German:

When Easter and Whistun fall on the same day.


On Saint Never’s day / on Saint Never.


When Hell freezes over.


When it snows in summer.


I’ve seen horses puke before.


On poodle’s Whitsunday.


Serbian:

When grapes grow on willows.


Chinese:

When the sun would rise from the West.


Croatian:

When grapes rippen the on willow.


On St. Nobody’s day.


Polish:

When a cactus grows on my hand.


Tagalog:

When the crow turns white.


Finnish:

When hell freezes over.


When cows fly.


When flagpoles bloom.


Danish:

When there’s two Thursdays in a week.


Swedish:

When hell freezes over.


When pigs fly.


When the asphalt blossoms.


Spanish:

When frogs grow hair.


When it rains upwards.



Slovenian:

On Saint Never’s Day.


Russian:

When the crayfish on the hill whistles.


French:

When chickens grow teeth.


In the week with 4 Thursdays.


On Saint Glinglin’s day (an imaginary saint).


Scots:

When two moons in the sky shall shine.


Italian:

When donkeys fly.


When Easter falls in May.


In the year of never and the month of then.


In the week with two thursdays.


When hens piss.



Hungarian:

When it’s snowing red snowflakes.


When Hell freezes over.


Romanian:

when I see the back of my head.


English:

When pigs fly / and pigs might fly.


When hell freezes over.


On a cold day in hell.


Not in a month of Sundays.


Occitan:

When hens pee.


Irish:

When the sky falls to the ground.



Norwegian:

When it’s snowing in hell.


Latvian:

When the owl’s tail blossoms.


Moroccan:

When a goat flies.


Korean:

The sound of a ghost eating rice seeds.


Hindi:

When the sun rises in the west.


Bengali:

যখন সুর্য পশ্চিমে উদয় হয়/When rise up in the West


Dutch:

If the calves dance on ice.


If the owls preach.


Danish:

When there’s two Thursdays in a week.


Bosnian:

When grapes rippen on the willow.


Algerian:

When salt produces flowers.


Greek:

When the sun rises from the west.


When the earth stops turning.


Brazilian Portuguese:

When cows cough.


There's lot of things to learn through fun, keep following for more, cheers!