'সুইসাইডাল বক্স'
উষস চট্টোপাধ্যায়
পর্ব : ২
_____________________
গেমের একটা পর্যায় এসে নিজে থেকে চ্যাটরুম অন হয়ে যায়.. সেই সুত্রে একটা ম্যাসেজের আংশিক ছবি!
— হ্যালো, আমি কি 'অন্ধকারের যাত্রি'র সাথে কথা বলছি! আমি সুইসাইডাল বক্সটি কিনতে আগ্রহী ৷
—আপনার নাম?
— প্রোফাইলে যেই নামটা দেওয়া আছে, মিতালী গোস্বামী৷
—প্রোফাইলে তো সবার সঠিক নাম দেওয়া থাকে না, যেমন আমার নিজেরও নেই ৷ যাই হোক, আপনি অ্যানাউন্সমেন্ট পোস্টটি পড়েছেন মন দিয়ে?
— আজ্ঞে হ্যাঁ, পড়েছি ..
—তাহলে তো আপনি সবটাই জানেন, কি করতে হবে, আর কি করা বারণ, তাই না?
আচ্ছা বলুন তো, কি কারনে সুইসাইড করতে চান?
— কারনটা কি বলতেই হবে? দেখুন আমার কাছে যেটা যৌক্তিক কারন, আপনার কাছে নাও হতে পারে৷ আর কারন বললেই যে আমি জিনিসটা পাবো তার গ্যারান্টি কি?
—কোন গ্যারান্টি নেই, কারনটা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হতে হবে৷ দেখুন, এটা আমার বিজনেস৷ সবার বিজনেসেরই কিছু রুলস থাকে, আমার রুলস এটাই৷ আপনি বলতে না চাইলে সেটা একান্তই আপনার ব্যাপার, তবে কারন না বললে আমি আপনার সাথে লেনদেন-এ যাবো না৷
— হুম , বুঝতে পারছি..
—বেশ, তাহলে কী ঠিক করলেন? বলতে চান নাকি চান না ..
— আমার বিয়ে হয়েছে বারো বছর আগে, আমার একটা মেয়ে আছে দশ বছর বয়সের৷
—তারপর..
— থাক গে, আর বলবো না! আপনাকে বিরক্ত করার জন্য সরি৷
—সরির কিছু নেই দিদি৷ তবে, বলতে না চাইলে বলতে হবে না৷
— আচ্ছা সুইসাইডাল বক্সে কি একসাথে দুজন ঢোকা যাবে? না মানে.. স্পেস কতটা?
—আজ্ঞে... যাবে বলে মনে হয়৷
— আমার মেয়েটাকে ওর নিজের কাকা অ্যাবিউজ করছে ... দিনের পর দিন... বাচ্চাটা আমার কেঁদে কেঁদে বলে "মা, আমার ব্যথা করে, আমার খুব কষ্ট হয় .."
—আপনি এই সত্যিটা জানার পরেও চুপ করে আছেন? ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না!
— আমি বিধবা.. আমার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই৷ এক ভাই আছে, সেও আমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে আমাদের দায়ভার সে নিতে পারবে না৷ তাই আমাকে এ বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে৷ আমি যে কি পরিমান নিঃস্ব, সেটা আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না৷ এই বক্স কেনার টাকা কোথায় পাবো আমি তাও জানি না, তবে কোনো-না-কোনো উপায়ে জোগাড় করে ফেলবো৷ এই কষ্ট সহ্য করে বেঁচে থাকার চেয়ে, মা-মেয়ে মিলে মরে যাওয়াটাই সহজ৷ আমি একা হলে এই ঝামেলায় আসতাম না ... আমার মেয়েটা অলরেডি অনেক কষ্ট পেয়েছে, অন্তত মৃত্যুটা সহজ হোক ওর জন্য!
—কিছু মনে না করলে আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি, মানে আপনি লেখাপড়া কতদূর করেছেন?
— বি.এ. অনার্স পাশ করেছি, রেজাল্ট ভালো ছিলো না, থার্ড ক্লাস পেয়েছিলাম ৷
—রেজাল্ট টা মূখ্য বিষয় না দিদি... আচ্ছা বাদ দিন, আপনি টাকাটা কিভাবে জোগাড় করবেন বল্লেন নাতো, আমি কিন্তু দাম কমাবো না.. ফিক্সড প্রাইস৷
— এখনও ঠিক জানি না, দেখি! কিছু যদি না হয় তো স্বামীর শেষ চিহ্ন হিসেবে একটা চেন আছে সোনার, ওটাই বিক্রি করে দেবো না হয়..
—ঠিক আছে৷ আপনি টাকা জোগাড় করে আমাকে নক দেবেন, আজ রাখছি৷
— আমি তাহলে সুইসাইডাল বক্সটা পাচ্ছি তো?
—এখনই কনফার্ম বলতে পারবো না, আগে ভেরিফিকেশন করতে হবে, তারপর৷
— ঠিক আছে, আমি টাকা জোগাড় করেই আবার নক দেবো না হয়!
মিতালী গোস্বামী! আমার নতুন তিতলী৷ এটাও কি সম্ভব? দশ বছরের বাচ্চাকে শারিরীকভাবে নোংরা করছে তার আপন কাকা! আর কত কষ্টকর গল্প শুনতে হবে আমাকে... আমার যে ভীষণ কষ্ট হয়, বারবারই মনে হয় আমার তিতলী-র বোধহয় এরকমই কোনও এক কষ্ট ছিলো, যা আমার জানা হয়ে ওঠেনি৷
আমার হাতে সময় বেশি নেই৷ আমি জানি মিতালী গোস্বামী খুব তাড়াতাড়ি টাকার ব্যবস্থা করে ফেলবে৷ মরার জন্য টাকার জোগার করতে দেরি হবার কথা নয়৷ অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে৷ যদিও দশ হাজার টাকা খুব ছোট অ্যামাউন্ট ও নয়, তবু মন বলছে দু-তিন দিন লাগবে বড়ো জোর! এর মধ্যেই আমাকে আমার কাজ করতে হবে৷
******
রিমার ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যেবেলার দিকে, আকাশটাতে লালচে রঙ ধরতে শুরু করেছে৷ ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দাঁড়াতেই রিমা দেখলো আনোয়ারা দাঁড়িয়ে আছে, চায়ের ট্রে হাতে করে৷ এই মেয়েটাকে মাঝে মাঝে অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা সম্পন্ন মনে হয় রিমা-র৷ রিমার ঘুম ভাঙার পর কখনোই অপেক্ষা করতে হয় না, মেয়েটা গরম-গরম চা নিয়ে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকে৷
চা খেতে খেতে রিমা ফোনটা অন করলো, একগাদা নোটিফিকেশন এসেছে তাতে৷ একটা নোটিফিকেশনে চোখ আটকে গেলো রিমার৷ অলি পোস্টেড ইন দি গ্রুপ "সুইসাইডাল বক্স" .. এই অলি কে রিমা জানে না৷ তবে তার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে৷ এই মেয়েটিই তাকে ঐ গ্রুপে ইনভিটেশন পাঠিয়েছিলো৷ ওখানে বলা ছিলো, যাদের দেখে মনে হয় সুইসাইড করতে চায় শুধু তাদেরই ইনভাইট করতে! কিন্তু রিমা অবাক হয় এই ভেবে, যে তার সোশ্যাল লাইফ দেখে তো এটা বোঝার উপায় নেই, যে সে সুইসাইড করতে চায়, এমনকি ও যে অ্যাটেম্পট নিয়েছিলো সেটাও তো পাবলিক করেনি! ফেসবুকে তো রিমা ভীষণভাবে সুখী৷ রিমা অলির পোস্ট চেক করে৷ তিন লাইনে অলি লিখেছে—
"অন্ধকারের যাত্রি-কে চিনেছি বলেই আজ আলোকে চিনতে পারলাম৷ তোমাকে ধন্যবাদ বলে আসলে আমার মনের কৃতজ্ঞতাবোধ প্রকাশ করতে পারবো না, তাই সে চেষ্টাও করলাম না৷ নিয়মানুযায়ী গ্রুপ থেকে চলে যাচ্ছি, ভালো থাকবেন, নমস্কার৷"
রিমা এবার একটু ঝটকা খেলো৷ 'অন্ধকারের যাত্রি' নামের ছেলে বা মেয়েটা আসলে কি এমন করেছে অলির জন্য যে অলি এতটা কৃতজ্ঞ! রিমা নিজে থেকে কখনো কাউকে নক দেয় না ইনবক্সে, এতে তার সেলিব্রিটি ইমেজটা একটু কেমন কেমন দেখায়! তবে, আজ সে নিজে থেকেই নক দিলো অলিকে.. অলি যেন জানতো রিমা নক করবে, সাথে সাথেই রিপ্লাই পেলো রিমা ওপার থেকে৷
—হ্যালো, ভালো আছেন অলি?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন?
—ভালো, আচ্ছা.. আপনি আমাকে একটা গ্রুপে ইনভাইট করেছেন, 'সুইসাইডাল বক্স' নামের!
—আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি জানি আপনার সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি আছে৷ আপনি বোধহয় আমার কথা ভুলে গেছেন৷ আপনার সাথে কিন্তু আমার কথা হয়েছিলো..
—আসলে কিছু মনে করবেন না, আমি মনে করতে পারছি না! আর প্রোফাইলে ও কোনো ছবি নেই তো, ছবি থাকলে হয়তো চিনতে পারতাম৷
—কিছুদিন আগে আপনি ট্যাবলেট খেয়েছিলেন, তখন আপনাকে যে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছিলো আমি সেখানকারই ডাক্তার৷ হসপিটালে সাত দিন আমিই আপনাকে অ্যাটেন্ড করেছি৷ মনে পড়েছে এবার?
—ও.. আচ্ছা আচ্ছা, মনে পড়েছে৷ সরি..সরি আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম৷ আচ্ছা আমাকে বলো তো গ্রুপটার ব্যাপার কী!
—মাফ করবেন, গ্রুপের ব্যাপারে আলোচনা করা তো একদমই নিষেধ৷ বিশেষ করে যারা গ্রুপ থেকে বেরিয়ে চলে আসবে তাদের জন্য একেবারেই নিষেধ৷
—আরে না না, কোন সমস্যা নেই, তুমি বলতে পারো, আমি কি কাউকে বলতে যাবো নাকি!
—দেখো, তুমি বরং 'অন্ধকারের যাত্রি' আইডিতে ম্যাসেজ করো, যা বলার বা করার ওনারাই করে নেবেন!
—ওসব পাগল ছাগলের সাথে কি আর কথা বলবো! থাক বাদ দাও, এই ইস্যু নিয়ে যথেস্ট ভেবে ফেলেছি৷ তুমি বলতে না চাইলে ইটস ওকে৷
—তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে, যদি কখনো আবার এমনটা হয় যে তোমার মনে হচ্ছে পৃথিবীটা বড্ড অর্থহীন, তাহলে প্লিজ ঐ আই ডি টাকে নক দিও! এটা রিকুয়েস্ট৷
—তুমিও কি সুইসাইড করতে চেয়েছিলে নাকি?
—এসব বলা বারণ আছে রিমা!
—ঠিক আছে, করুনাময় তার মঙ্গলময় হাত তোমার দিকে বাড়িয়ে দিক, ভালো থেকো অলি..
—তুমিও ভালো থেকো রিমা ..
রিমা-র আবার বিরক্তি লাগা শুরু হয়, অযথাই মেয়েটাকে নক করতে গেছে সে!
**********
মিতালী গোস্বামী-র খোঁজ খবর বের করা খুব একটা কঠিন হলো না৷ আমি বরং এর চেয়েও ঝামেলা করে এর আগের ক'য়েকটা কেসের খোঁজ বের করেছি৷ যেমন আমার লাস্ট কেস অলি, কম হয়রানি হয়নি ওর ডিটেলস বের করতে৷ অলিকে যে শেষ পর্যন্ত ফেরাতে পারবো এটা আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিলো না! এর চাইতে মিতালী-র কেস সহজ হবার কথা!
অলির কথা মনে হলে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে৷ মেয়েটার সর্বনাশ করেছিলো তাকে ভালোবাসি বলা মানুষটাই৷ বাবা ছেড়ে যার হাত ধরে ঘর ছেড়েছিলো, সেই মানুষটি পেশায় একজন ডাক্তার অলির মতোই৷ একই হসপিটালে কর্মরত ছিলো দুজনে৷ অলির সেই ডাক্তার স্বামীটি এর আগেও বিবাহিত ছিলো৷ ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিলো দুজনের৷ এরপরই অলি আসে তার জীবনে৷ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে অলি৷ তার ডাক্তার হবার পথ অতোটা মসৃন ছিলো না, শুধুমাত্র বাবা-মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে অর্জিত অর্থ আর নিজের অসম্ভব রকমের মেধা অলিকে ডাক্তার বানিয়েছিলো৷ সেই অলি বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে, ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিলো সেই আরেক ডাক্তারের সাথে৷ ঘর ছাড়বার আগে অলির মা শুধু একটা কথাই অলিকে বলেছিলো "যার বউ ছেড়ে গেছে, কোন না কোন কারনেই তো গেছে! ভালোমতো খোঁজ না নিয়ে তুমি তার জন্য পাগল হয়ো না..."
অলির তখন পাগল হবার সময়ই ছিলো৷ আমি অন্ধকারের যাত্রি হয়ে যখন শুনেছি অলির গোপনগাথা, তখন শিউরে উঠেছি ভিতরে ভিতরে ... কী নিদারুণ, কী ভয়ানক! আবার নতুন করে বুঝেছি, বাবা-মা যা বলে ভালোর জন্যই বলে, পৃথিবীতে বাবা-মার চেয়ে আপন আর কেউ নয়৷
অলির স্বামীটি ছিলো একজন অসুস্থ মানসিকতার এক রোগী! ডাক্তারের সাদা অ্যাপ্রনের তলায় তার ছিলো একটা কুৎসিত, কালো, কলুষিত মন... মাথায় ছিলো বিকার! ভয়ানক! ভয়ানক সেই বিকার ...
চলবে...
#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #২য়_পর্ব
No comments:
Post a Comment