Saturday, 26 August 2023

"সুইসাইডাল বক্স"..

 


'সুইসাইডাল বক্স'

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ১

_____________________


তিতলী সুইসাইড করেছে, ওর নিথর দেহটা ফ্যান থেকে ঝুলছে৷ আমার মা পাশের ঘরে অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছে৷ একটু পরপর থেকে-থেকেই মায়ের জ্ঞান ফিরছে আর মা চিৎকার করে কেঁদে উঠছে.."ও রে, ও তিতলী রে ...মা রে, আমার মনা.." 


লোকজনে আর পুলিশে বাড়ি ভর্তি৷ তিতলীর শরীরটা তারা নামিয়ে ফেলেছে৷ প্লাস্টিকে মুড়ে সেই শরীরটা তারা নিয়ে চলে যাচ্ছে, অ্যাম্বুলেন্সে করে৷ মোড়কের বাইরে থেকে তিতলীর পা দুটো দেখা যাচ্ছে .... তিতলী, আমার যমজ ছোট বোন! আমার দশ মিনিট পরে যার জন্ম হয়েছিলো৷ মায়ের গর্ভে আমরা একসাথেই বেড়ে উঠেছিলাম, অথচ আজ তিতলী আমার আগেই কেমন যেন স্বার্থপরের মতো আমাকে একলা করে দিয়ে চলে গেল৷ আমার চোখে জল নেই৷ আমি যেন কান্নাশূন্য এক মানুষে পরিণত হয়েছি৷ বাবা আগে চলে গিয়ে ভালোই করেছে, নয়তো মায়ের মতোই আজকের দিনটা তাকেও সহ্য করতে হতো ...


*********


সারারাত ঘুমোয়নি রিমা৷ খাটের পাশের ইজি-চেয়ারটাতে বসে ফেসবুক স্ক্রল করছিলো সে৷ ফেসবুকে তার ফ্যান ফলোয়ারের অভাব নেই৷ অপরূপা রিমা মাঝে মধ্যে লাইন চারেকের কবিতা লেখে, ধারাবাহিক গল্প লেখে৷ অবশ্য তার ফলোয়াররা সে সব গল্প-কবিতার কতটুকু বোঝে রিমা নিজেও সে ব্যাপারে সন্দিহান৷ তার ফেসবুক সেলিব্রিটি হবার মূল কারন তার চেহারা৷ রিমা নিজের মনেই হাসে৷ ফ্রেন্ডলিস্টে পাঁচ হাজারের কোটা তার অনেক আগেই পূর্ন হয়েছে৷ এই পাঁচ হাজারের মধ্যে পাঁচশ জনকেও সে চেনে কিনা সন্দেহ৷ তাতে কি, এই ফেসবুকের লাইফটা তার ভালো লাগে৷ পরপর তিনবার সুইসাইড অ্যাটেম্প্ট নেওয়া রিমা ফেসবুকে বেশ হাসিখুশি ৷ 


ভাবনার বেড়াজাল কাটে ফোনের 'টুং' আওয়াজে৷ নোটিফিকেশন এসেছে ফেসবুকে৷ রিমা নোটিফিকেশন চেক করে দেখে অলি ইনভাইটেড ইউ টু দ্য গ্রুপ- "সুইসাইডাল বক্স" .... 


প্রতিদিন এমন হাজারও গ্রুপের ইনভিটেশন আসে৷ আজকাল গ্রুপের তো আর অভাব নেই৷ রিমা এ ধরনের নোটিফিকেশন দেখেও দেখে না, কিন্তু আজকে গ্রুপটার নাম দেখেই তার কেমন যেন আগ্রহ জাগলো৷ সে গ্রুপটার জয়েন রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করে ফেললো৷ তারপর রাত জাগা ক্লান্তি এক পাশে রেখে স্ক্রল করতে থাকলো গ্রুপের হোম পেজ ...


সিক্রেট গ্রুপ, এমন নামের গ্রুপ সিক্রেট হবে এটাই স্বাভাবিক৷ গ্রুপ ডেসক্রিপশনে ছোট্ট করে লেখা আছে, "যারা আত্মহত্যা করতে চান, শুধু তারাই যোগাযোগ করবেন৷" ব্যস এটুকুই... আর কিছু না ! 


রিমা অ্যানাউন্সমেন্ট পোস্টগুলো দেখতে থাকে৷ গ্রুপের ফাউন্ডার এডমিনের নাম 'অন্ধকারের যাত্রি'... একটা মুখোশের ছবি দেওয়া প্রোফাইল পিকচার হিসেবে৷ রিমা আগ্রহী হয়ে আইডিটাতে ঢোকে৷ আইডিতে কিচ্ছু নেই৷ কোনও ইনফরমেশনই নেই৷ এমনকি মেল না ফিমেল সেটাও দেওয়া নেই৷ তারওপর আইডিটা লক করা! রিমা খানিকটা বিরক্ত হয়ে 'অন্ধকারের যাত্রি' আইডি থেকে বের হয়ে এলো৷ গ্রুপ থেকে লিভ নিতে গিয়েও অ্যানাউন্সমেন্ট পোস্টটা আবার মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলো৷ সেখানে বিশদ ভাবেই লেখা আছে গ্রুপের উদ্দেশ্য কি! ওখানে লেখা—


"সুইসাইড করার জন্য যারা সবচেয়ে সহজ এবং কম কষ্টের, ঝুকিহীন কিছু পন্থা খুঁজছেন তাদের সাদরে আমন্ত্রন৷ উন্নত টেকনোলজি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে 'সুইসাইডাল বক্স'৷ এটি একটি চারকোনা ঘর সদৃশ বস্তু যা সহযেই ভাঁজ করে বহন করা যায় সুটকেসের মতো৷ বক্সটি রূপান্তরিত হয় একটি ব্যুথে, সেখানে আছে একটি গ্যাস চেম্বার, সুইচ অন করলে সেখান থেকে নির্গত হবে বিষাক্ত গ্যাস, যা মাত্র চার-পাঁচ মিনিটে আপনার মৃত্যু নিশ্চিত করবে৷ এই মৃত্যু হবে যন্ত্রনাহীন, কিছু বুঝে উঠার আগেই আপনার এপারের যাত্রা সাঙ্গ হবে৷ বক্সের মূল্য মাত্র দশ হাজার টাকা, কোন বার্গেনিং করা যাবে না৷ তবে শুধুমাত্র টাকা দিলেই যে আপনি এই বক্সের মালিক হবেন এমনটা ভাবলে ভুল করছেন৷ এজন্য অবশ্যই আপনাকে নিচের সবগুলো শর্ত পূরন করতে হবে৷ শর্তগুলো হলো;


১. প্রথমেই ম্যাসেজে বলতে হবে আপনি কেন সুইসাইড করতে চান৷ আমাদের যদি মনে হয় আপনার সুইসাইডের কারন যথেষ্ট যৌক্তিক, তাহলেই আপনার কাছে সুইসাইডাল বক্সটি বিক্রয় করা হবে, নচেৎ নয়৷


২. আপনার বয়স আঠারো প্লাস হতে হবে৷


৩. আপনার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সঠিকভাবে দিতে হবে৷ এসব তথ্য ভেরিফিকেশন করে যদি মনে হয় ভুল তথ্য দিয়েছেন তাহলে আপনার কাছে 'সুইসাইডাল বক্স' বিক্রয় করা হবে না৷


৪. শুধুমাত্র নিজের জন্যই কিনতে পারবেন, অন্য কারও জন্য নয়৷ 


৫. এ বিষয়ে সকল তথ্য গোপন রাখতে হবে৷ 


৬. একান্ত পরিচিত যাকে মনে হয় সে আসলেই সুইসাইড করতে চায় শুধু তাকেই গ্রুপে অ্যাড করতে পারবেন, নচেৎ চিরতরে ব্যান করা হবে গ্রুপ থেকে৷


৭. অযথা প্রয়োজন ছাড়া অ্যাডমিন আইডিতে ম্যাসেজ করতে পারবেন না, এবং কোন পোস্টও দিতে পারবেন না, প্রয়োজনেই শুধু পারবেন৷


রিমা ধৈর্য্য ধরে পোস্টটি পড়লো৷ তারপর নিজে নিজেই বলে উঠলো "পাগল-ছাগলে দেশ ভরে গেছে ... সুইসাইড বক্স নাকি!... এগুলো মানুষে বেচে? পাগলা কোথাকার, খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই আর, যত্তসব!..."


ফেসবুক থেকে বেরিয়ে সকালের মিষ্টি আলোয় ব্যালকনিতে গিয়ে কয়েকটা সেলফি তুলে ফেলে রিমা৷ এ আলোতে ছবি ভীষণ সুন্দর হয়৷ গায়ের রং থেকে যেন আলো ঠিকরে বের হয়৷ তারপর সেলফিগুলো এডিট করে আরও একটু সুন্দর করে সাজিয়ে পোস্ট করে নিজের প্রোফাইলে ... ছোট্ট একটা ক্যাপশন জুড়ে দেয় তার সাথে! 


"সুপ্রভাত সুহৃদগন.."


মুহূর্তেই লাইক, কমেন্ট আর রিয়্যাক্টে ভরে যায় সেই পোস্ট৷ দশ মিনিটে লাইক, কমেন্ট এক হাজার ছাড়িয়ে যায়৷ রিমা নিজের মনেই হাসে ... হেসে হেসেই আবার বলে "পাগল-ছাগলে দেশ ভরে গেছে.. এই পোস্টে এত লাইক কমেন্টের কি আছে ...পাগলের দল সব ...চিকিৎসার দরকার সবার.."


দরজায় নক করছে কেউ৷ রিমা জানে আনোয়ারা বেগম নক করছে৷ বিরক্তি নিয়ে বারান্দা থেকে উঠে গিয়ে দরজা খোলে সে৷ হাতে ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আনোয়ারা, সে জানে তার দিদি সকালে জলখাবার করেই ঘুমোয়; তাই যতটা দ্রুত সম্ভব খাবার তৈরি করে, মানুষটা যত তাড়াতাড়ি খাবে তত তাড়াতাড়ি ঘুমোবে৷ একটা মানুষ কিভাবে সারারাত জেগে থাকে আনোয়ারা-র মাথায় ঢোকে না !


রিমা চুপচাপ সুবোধ বালিকার মতো জলখাবার খেয়ে নেয়৷ তারপর কড়া ডোজের সিডেটিভ খেয়ে বিছানায় শুতে যায়৷ সারারাত বিছানাটা ফাঁকা পড়ে ছিলো৷ কড়া সিডেটিভেও রিমার ঘুম আসতে চায় না৷ জোর করে, চোখ বন্ধ করে ঘুমাবার চেষ্টা করে সে ..


রিমার বাবা অমল মজুমদার, এ শহরের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ীদের একজন৷ রিমার মা মারা গেছেন অনেক আগেই৷ ভদ্রলোক মেয়ের কথা ভেবেই হয়তো আর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেননি৷ অবশ্য রিমার ধারনা তার বাবা বিয়ে করেননি সময় পাননি বলে৷ ভদ্রলোক সারাদিন ভীষন ব্যস্ত থাকেন৷ মেয়ের সাথে তার দেখা হয় সপ্তাহে একদিন, রবিবার৷ ঐদিন তার বাবা অফিসে যান না, সারাদিন নিজের ঘরেই থাকেন৷ রিমার সাথে তার তেমন বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক না, তবুও রবিবার রিমার মন ভালো থাকে৷ বাবা বাড়িতে আছে এই বোধটুকুও স্বস্তির ....


সিডেটিভ কাজ করতে শুরু করেছে৷ রিমা ঘুমিয়ে পড়ছে অতি দ্রুত৷ তার চিন্তাগুলো এখন কেমন যেন জড়িয়ে যাচ্ছে৷ তার মনে হচ্ছে সে যেন কোন একটা নৌকায় ... মাঝ নদীতে মাঝিহীন সেই নৌকা দুলছে, সেই দুলুনি যেন ছোটবেলার দোলনার মতো৷ ধীরে ধীরে সে ঘুমিয়ে পড়ে, গভীর শব্দহীন এক অতল ঘুমে...


**********


তিতলী মারা যাবার কিছুদিন পরেই আমি 'অন্ধকারের যাত্রি' নামের আইডিটা খুলেছিলাম৷ কেন খুলেছিলাম জানি না৷ দুবছর হয়ে গেছে তিতলী আমাদের মাঝে নেই৷ আমার যমজ বোন, আমার দশ মিনিট পরে যার জন্ম হয়েছিলো দু'বছর আগে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে৷ ঐ আইডিটার সুবাদে গত দুই বছরে আমি এমন অনেক তিতলী-র সন্ধান পেয়েছি যারা সবাই মরতে চায়৷ মৃত্যু কতটা সহজ শব্দ তাদের কাছে৷ আমি মনোযোগ দিয়ে তাদের কথাগুলো শুনি৷ আমার তিতলী-র কথাগুলো আমার শোনা হয়ে ওঠেনি, আমি জানিনা কোন কষ্ট বুকে নিয়ে আমার বোনটা চলে গেলো, তবে আঁধার জানে আঁধারে থাকা হাজার খানেক তিতলীদের গল্প৷ আমার গ্রুপ "সুইসাইডাল বক্স" জানে তিতলীদের গোপন গাথা৷ 'অন্ধকারের যাত্রি' হয়ে আমি মেয়েদের আঁধারের গল্প শুনি৷ মাঝে মধ্যে কেঁপে উঠে ভাবি পৃথিবী কি সত্যিই এতটা ভয়াবহ! মাঝে মধ্যে অবাক হয়ে ভাবি মৃত্যুর জন্য এত ক্ষুদ্র কারনও কি যথেষ্ট? 


ম্যাসেঞ্জারে 'টুং' করে শব্দ হলো৷ আবার কেউ 'অন্ধকারের যাত্রি' কে ম্যাসেজ করেছে ....


চলবে .....


#ধারাবাহিক_গল্প #থ্রিলার #সুইসাইডাল_বক্স

2 comments:

  1. খুব সুন্দর, পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করছি.. 🙂

    ReplyDelete
    Replies
    1. অসংখ্য ধন্যবাদ, সাথে থাকুন 🙏🏼🙂

      Delete