Saturday 23 September 2023

'সুইসাইডাল বক্স' (পর্ব: ৫)


 

'সুইসাইডাল বক্স'

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ৫

_____________________

.."আমার আইডি দেখে আপনি হয়তো ভাবছেন আমি হয়তো একটা মেয়ে৷ আসলে এটা আমার ছোটবোনের আইডি৷ ওর-ই নাম জোনাকি, ওর আবার ফেসবুকের নেশা নেই৷ আমিই মাঝে মধ্যে ওর আইডিতে ঢুকি৷ সমস্যাটা শুরু হয় এই আইডি নিয়েই৷ আসলে সমস্যা ঠিক তার নয়... ব্যাপারটা হচ্ছে, সমস্যাটা আমি নিজে নিজেই তৈরি করেছি৷ 


আমার নাম সৌম্য; ভালো নাম, শেখ সামসুল হক। অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তির অপেক্ষায় আছি৷ যাই হোক, আপনার বেশি সময় নেবো না, প্রসঙ্গে আসি৷ আমার বোন নিজের ছবি প্রোফাইলে দিতে খুব-একটা পছন্দ করে না৷ ইন্টারনেট থেকেই ডাউনলোড করে একজন নায়িকার ছবি দিয়েছিলো প্রোফাইলে৷ সাউথ ইন্ডিয়ান মুভির নায়িকা৷ ও যেহেতু ফেসবুকে সেরকম ঢোকে না, আর আমিই মেনলি ওর আইডি চালাই, তাই খেলাচ্ছ্বলেই সমস্যার শুরুটা আমি করে ফেললাম.. 


মেয়েদের আইডিতে বিভিন্ন ছেলেরা নানান সময়ে নানা রকম নোংরা ম্যাসেজ করে থাকে.. আদার ম্যাসেজবক্স ওপেন করলে বোঝা যায় যে মানুষের মনের নোংরামির কোন সীমা-পরিসীমা নেই৷ আমার বোনের আইডিতেও এমনই ছেলেদের ম্যাসেজ আসতো৷ নিজেদের বিশেষ অঙ্গের ছবি পাঠাতো ইনবক্সে৷ আমি খুব কড়া ভাষায় রিপ্লাই দিয়ে সেই আইডিগুলোকে ব্লক করে দিতাম৷ এসবেও কোন সমস্যা ছিলো না৷ 


একদিন একটা ম্যাসেজ আসলো তরুন কুমার নামের একটা আইডি থেকে৷ খুব সুন্দর করে ভদ্রভাষার ম্যাসেজ৷ আমি নোংরা ম্যাসেজ দেখে দেখে এতটাই বিরক্ত ছিলাম, আমার ওনার করা ম্যাসেজ খুব ভালো লাগলো৷ আমি খুব স্বাভাবিকভাবে রিপ্লাই দিলাম৷ তবে ফোনের ওপারের মানুষটা জানতে পারলো না আমি একজন ছেলে ....


তরুন প্রতিদিন ম্যাসেজ পাঠাতো- দারুণ সব কবিতা লিখে লিখে.. ওর কবিতা আমার বেশ ভালো লাগতো৷ আমি নিয়মিত কথা বলে যেতে লাগলাম৷ একসময় অবাক হয়ে দেখলাম আমি তরুনের সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছি.. আমি ভীষণ ভালো লাগা নিয়ে অপেক্ষা করছি ...


আস্তে আস্তে আমাদের কথা বলার সময় বাড়লো, সারারাত আমরা কথা বলতাম৷ আমার পরীক্ষা থাকলে ও আমার সাথে জাগতো৷ আমি অসুস্থ হলে ও আমাকে ওষুধ খাবার কথা মনে করিয়ে দিতো৷ আমি দিনে দিনে ওর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে লাগলাম৷ 


আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন আঁধার? অবশ্য বিরক্ত হবার মতোই কথা বলছি আমি! আর বেশিক্ষন নেব না আপনার ..."


"না..না, বিরক্ত হওয়ার কোন কারণ নেই, আমি অভ্যস্থ! তারপর কী হলো?"


"তারপর যা হবার সেটাই হলো৷ তরুন আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো৷ ও যেহেতু হিন্দু আর আমি মুসলিম ও নিজ থেকেই বললো ও ধর্ম পরিবর্তন করবে৷ প্রেম না, সরাসরি বিয়েই করতে চায় আমাকে..."


"আমি দ্বিধায় পরে গেলাম ! আমি তরুনকে কি বলবো! হিন্দু-মুসলিম এটা সমস্যা না, সমস্যা তো অন্যখানে৷ আমি একজন পুরুষ ... ঠিক একই ভাবে তরুনও একজন পুরুষ৷ তরুনের কাছে আমি নারী হলেও আসলে আমি তো নারী নই!


প্রচন্ড দ্বিধা নিয়ে দিন কাটাতে লাগলাম৷ আমি তরুনের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম... ও আমাকে পাগলের মতো নক করতো৷ আমার সাথে কথা বলার জন্য ও পাগল হয়ে ছিলো৷ আমার অসহায় লাগতো৷" 


"নিজের সাথে যুদ্ধ করে আর পারলাম না৷ সত্যিটা বলে দিলাম অবশেষে৷ বললাম, 'তরুন আমি একজন ছেলে...' ও বিশ্বাস করতে চাইলো না৷ ও ভাবলো আমি ওকে বিয়ে না করার জন্য মিথ্যে কথা বলছি ..."


"আমি অবশেষে ওর সাথে দেখা করতে চাইলাম৷ ওর কান্না আমার সহ্য হচ্ছিলো না৷ আমিও কাঁদছিলাম, কেন কাঁদছিলাম জানি না..আমিও বোধহয় ভালোবেসে ফেলেছিলাম তরুনকে! বোধহয় না, আমি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলাম তরুনকে৷ একটা ছেলে হয়েও আমি আরেকটা ছেলেকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম ... হয়তো এখনও বাসি .."


"আমি তরুনের সাথে দেখা করলাম৷ ও অবাক হয়ে দেখলো আমাকে .. ঘৃনাভরে দেখলো আমাকে ...কোন কথাই বললো না! শুধু যাবার আগে একদলা থুথু ফেলে দিয়ে গেলো আমার গায়ে .."


"এই ঘটণার ছয়মাস হয়ে গেছে৷ এই ছয়মাসে আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি পুরো ঘটণাটা ভুলে যেতে, পারিনি৷ আমি এখনও ফেক আইডি দিয়ে তরুনের আইডি ফলো করি, ওকে দেখি৷" 


"আমি চেষ্টা করেছিলাম কোন মেয়ের সাথে যেন সম্পর্কে জড়াতে পারি৷ সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক ... আমি পারিনি ... কোন মেয়ের প্রতি আমার সেই অনুভূতিটা জন্মায় না .."


"তরুন কিন্তু আমাকে মনে রাখেনি৷ ও বিয়ে করেছে গত তিনদিন আগে৷ একদম হিন্দুরীতি তে, খুব ধুমধাম করে এক রূপসী মেয়েকে বিয়ে করেছে .. বিয়ের ছবিতে তরুনের হাসিমুখ আমার বুকে শূলের মতো বিঁধেছে আঁধার .." 


"আমি জানি, ভুলটা আমার৷ আমিই প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাবার চেষ্টা করেছি, মিথ্যা বলেছি .. আমি শাস্তি পাবো এটাই স্বাভাবিক! কিন্তু শাস্তির এই বোঝাটা আমি আর টানতে পারছি না৷ তরুনের বিয়ের আগে পর্যন্ত কষ্টটা অন্যরকম ছিল, কিন্তু এখন কষ্টটা আলাদা৷ আমি চোখ বন্ধ করতে পারি না, চোখ বন্ধ করলেই দেখি তরুন ওর বউয়ের সাথে ......." 


"আমি আর পারছি না আঁধার! মৃত্যু মনে হয় সবচেয়ে সহজ সমাধান ... আমাকে ঘৃনা করবেন না আঁধার, খুব সাহস সঞ্চয় করে প্রথমবার এই কথাগুলো আমি কাউকে বললাম ...."


সামসুলের ম্যাসেজ পড়ে আমি খানিকক্ষন চুপ করে থাকলাম৷ ঠিক কী বলা উচিত আসলে বুঝতে পারছি না .. একটা ছেলে আরেকটা ছেলেকে কীভাবে ভালোবাসে এটা আমার মাথায় ঢুকছে না৷ আমি রিপ্লাই দেওয়ার আগে একটু প্রস্তুতি নিলাম৷ আমি লিখলাম "আপনি যে সমস্যায় পড়েছেন সে সমস্যার সাথে আমি পরিচিত নই৷ তবে এটুকু বলতে পারি, আমার মনে হয় আপনার কোন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার৷ এটাও এক ধরনের মানসিক সমস্যা মনে হচ্ছে৷ আমার পরিচিত একজন 

সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন৷ আপনি চাইলে আমি তার সাথে কথা বলে আপনার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে কথা বলে নেবো৷ একটাবার চেষ্টা করে দেখুন৷ ভুল তো মানুষেই করে, তবে ভুল শোধরাবার চেষ্টা তো করা দরকার, তাই না, কি বলেন?"


সামসুল চুপ করে থেকে উত্তর দিলো "আমি আমার পরিবারের একমাত্র ছেলে৷ একটা শেষ চেষ্টা আমি করতে চাই ... আপনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে দেখুন ..." 


আমি আচ্ছা বলে কথা শেষ করলাম৷ কথা শেষ করতেই দেখি মিতালী গোস্বামী-র ম্যাসেজ করেছে৷ তার টাকার জোগাড় হয়ে গেছে৷ আমি তাকে কাল দেখা করার সময় দিলাম৷ অন্য কেস আর মিতালী গোস্বামী-র কেস এক নয়৷ আমার আরো কিছু কাজ আছে, কাজগুলো শেষ করতে হবে অতি দ্রুত...


ইনবক্সে থাকা দ্বিতীয় ম্যাসেজটা ওপেন করলাম৷ ভদ্রমহিলা তার পুরো গল্পটা বলেই রেখেছেন৷ 


"আমার নাম অতসি, বয়স পয়তাল্লিশ৷ তিন সন্তানের জননী৷ বড় মেয়ের বিয়েও দিয়েছি৷ ছোট মেয়েটা টুয়েলভ দিলো এবার৷ আর সবচেয়ে ছোটটা ছেলে, ক্লাস নাইনে পড়ে৷ আমার স্বামীর বয়স সাতান্ন, বারো বছরের বড় আমার থেকে.."


"বছর দুয়েক আগে আমার জরায়ুতে টিউমার ধরা পড়ে৷ টিউমারটার জন্য অপারেশন করে আমার পুরো জরায়ু ফেলে দিতে হয়৷ এরপর থেকে নানান ধরনের সমস্যা হচ্ছে আমার৷ তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা, বয়সের কারনেই হোক আর অপারেশনের কারনেই হোক, স্বামী-স্ত্রী র নিজস্ব সম্পর্কে আমি আর কোন আগ্রহ পাচ্ছি না৷" 


"এটা নিয়ে অনেক অশান্তি৷ আমার স্বামী, এ বিষয়টি বুঝতে চাইছেন না৷ আর বিষয়টি এতটাই লজ্জার আমি আমার সন্তানদের সাথেও শেয়ার করতে পারছি না .. এটা কি ওদের বলার মতো কথা! বাবা-মা মারা গেছেন আমার৷ শ্বশুর মারা গেছেন৷ আছেন এক শ্বাশুড়ি, বৃদ্ধা ... জাগতিক বোধ-বুদ্ধিশূন্য! আমি আমার এ যাতনা কাকে বলবো! আমি ডাক্তার দেখিয়েছি, এ সমস্যার নাকি সমাধান আসলেই নেই!


আমার স্বামী গত পাঁচমাস আগে বিয়ে করেছে৷ ইচ্ছে করলে আমি কেস করতে পারি৷ কিন্তু, আমার নিজেকে এতটাই ক্লান্ত লাগে আমার আর কোন ঝামেলা করতে ইচ্ছে হয় না৷ আমার ছেলে মেয়েরা এখনও জানে না তাদের বাবার এই বিয়ে করার কথা৷ টাকা রেডি আছে আঁধার, আমি কি 'সুইসাইডাল বক্স' টি পেতে পারি? এত কষ্ট করেছি, মৃত্যুটা অন্তত আমার সহজ হোক..."


আমি পড়লাম৷ পড়তে পড়তে আমার দুচোখ দিয়ে জল চলে আসছিলো৷ আমি আজকাল দ্রুতই ভেঙে পড়ছি৷ এভাবে আমার ভেঙে পড়লে তো চলবে না ..


আমি নিজেকে শক্ত করলাম৷ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে রিপ্লাই দিলাম ..


"একটা বয়সের পর সন্তানেরা মায়ের বন্ধু হয়ে যায়৷ আপনার সন্তানেরা সেই বয়সে পৌঁছেছে৷ তাদের কাছে লজ্জার কিছু নেই৷ আপনি আপনার সন্তানদের সাথে কথা বলুন, মন খুলে৷ ওদের আপনি জন্ম দিয়েছেন৷ ওদের মতো ভালো করে আপনাকে কেউ বুঝবে না৷ আর একটা কথা, এই খবরটা এক সময় না এক সময় আপনার সন্তানদের কানে ঠিকই যাবে৷ অন্য কারও থেকে শোনার আগে আপনিই বলুন, এটাই ভালো৷ আপনার কোন ভুল নেই৷ আপনি কেন মরবেন? আর একবার আপনার সন্তানদের কথা ভাবুন ...ওদের কি হবে আপনি না থাকলে...?


আপনার সমস্যার সমাধান আছে৷ আমি খুবই দুঃখিত আপনার কাছে আমি বক্সটি বিক্রি করতে পারবো না.."


উনি উত্তরে বললেন, "আমি কি পারবো, লড়াই করতে..?"


আমি অভয় দিয়ে বললাম, "নিশ্চয় পারবেন..."


চলবে..


***


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #৫ম_পর্ব

No comments:

Post a Comment