Saturday 11 November 2023

সুইসাইডাল বক্স (পর্ব: ৯)

 


সুইসাইডাল বক্স

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ৯

_____________________



"..সন্তানেরা মাঝে মধ্যে ভীষণ স্বার্থপর হয়, আপনার সন্তানেরা ও স্বার্থপরতা-র পরিচয় দিচ্ছে! যাদের জন্য আপনি জীবন দিয়ে দিচ্ছেন, তারা আপনাকে বোঝেও না৷ সে যাই হোক, আমি আপনার জায়গায় হলে প্রথমেই ওদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা বন্ধ করে দিতাম৷ আমার ধারনা, আপনি প্রতিদিন একাধিকবার চেষ্টা করেন তাদের সাথে কথা বলার৷ আমি বলবো, আপনি ওদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা বন্ধ করে দিন৷


নিজের মতো করে বাঁচতে শিখুন, অনেক করেছেন অন্যদের জন্য; এবার নিজের জন্য কিছু করার সময়৷ সারাজীবন তো স্বামী-বাবা-সন্তানের হয়েই বাঁচলেন, জীবনের বাকী দিনগুলো না হয় স্বার্থপর মানুষ হয়ে বাঁচুন ... আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইলো "


ম্যাসেজ সেন্ড করে আমি সজল অধিকারী-র আইডি ঘেঁটে ঘেঁটে তার দুই ছেলেমেয়ের আইডি বের করে ফেললাম৷ তারপর তাদের ম্যাসেজে লিখে দিলাম; 


"আপনার বাবা, একজন বাবা হবার আগেও একজন মানুষ৷ আপনাদের মতো সব চাহিদাই তারও আছে৷ সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তাও আছে৷ মানসিক, শারীরিক দু'রকম চাহিদাই তার আছে৷ না কি বাবা বলে তার কোন চাহিদা থাকাটা অন্যায়? এভাবে দিনের পর দিন একজন বৃদ্ধ মানুষকে কষ্ট দিচ্ছেন, জানেন তো karma never loses an address! আজ যা আপনার বাবার সাথে করছেন ঠিক তাই আপনি ফেরত পাবেন না কে বলতে পারে? 


প্লিজ, আপনার বাবাকে বাবা না ভেবে একজন মানুষ হিসেবে ভাবুন আগে৷ মানুষটা কষ্ট পাচ্ছে, আপনি কি জানেন উনি ইদানীং আত্মহত্যার কথা ভাবছেন?"


সেম ম্যাসেজ কপি করে ওনার দুই সন্তানকেই পাঠালাম৷ হয়তো আমার ম্যাসেজ খুলেও দেখবে না, স্প্যাম ম্যাসেজে পরে থাকবে৷ তারপরেও করলাম৷ 


সন্ধ্যায় অবাক হয়ে দেখলাম ম্যাসেজ এসেছে সজল বাবুর মেয়ের আইডি থেকে৷ আমাকে লিখেছেন 


"আঁধার, আপনার গ্রুপ সম্পর্কে আমি জানি৷


আপনি যেভাবে বলছেন আমি আসলে ঠিক সেভাবে ভাবিনি, শুধু নিজের দিকটাই ভেবেছি৷ ভেবেছি, স্বামীর কাছে, শ্বশুড়বাড়ির কাছে ছোট হয়ে যাবো না তো? সবাই মন্দ বলবে ... আমি অধম সন্তান তাই বাবার কষ্টটা বুঝিনি৷ আমি অবশ্যই বাবার সাথে কথা বলবো৷ দাদাকেও বোঝাতে চেষ্টা করবো৷ 


আপনার গ্রুপটার জন্য খুব খারাপ লেগেছে৷ কেউ কিছু ভালো করতে চাইলে সবাই যেন তার পেছনেই লাগে৷ তবে আমার বিশ্বাস এমন একটা দুটো গ্রুপের চলে যাওয়া আপনার সদিচ্ছাকে শেষ করে দেবে না, আপনার জন্য শুভকামনা ..."


আমি কিছু বললাম না, শুধু একটা স্মাইলি পাঠিয়ে দিলাম রিপ্লাই তে৷ উনি নিজেই যখন বুঝতে পেরেছেন আমার আর কথা বলার দরকার কি!


পরদিন সকালে সজল বাবুর ম্যাসেজ পেলাম আবার৷ তিনি লিখেছেন- 


"আপনি বোধহয় এনজেল হয়ে এসেছেন আমার জীবনে.. আমার মেয়েটা একটু আগে আমাকে কল করেছিলো৷ খুব কাঁদলো, সরি বললো .. বললো ওর দাদাও আমার সাথে আবার যেন আগের মতো সহজ হয়ে যায় সেই ব্যবস্থা করবে৷ আপনি কি করেছেন জানি না, কিন্তু আমার মন বলছে এর পেছনে কলকাঠি আপনিই নেড়েছেন! নয়তো এত দিনেও যা পারিনি একদিনে তা কিভাবে হলো৷ আপনার জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা থাকলো৷ এখন থেকে আমার প্রত্যেক প্রার্থনাতে আপনি থাকবেন ..."


আমি এবার ও কিছু বললাম না৷ শুধু একটা স্মাইলি দিলাম৷ এবার আসলে আমার বলার কিছু ছিলোও না ..শুধু গলার কাছটায় কেমন যেন একটা দলা পাকানো অনুভূতি হলো৷ 


*********


রিমা আজ বেরিয়েছে অনেক দিন পর৷ দীর্ঘদিন ঘরে থাকতে থাকতে রিমার নিঃশ্বাস কেমন বন্ধ হয়ে আসছিলো৷ আজ তাই গাড়িটা নিয়ে বের হয়েছে৷ ড্রাইভারকে নেওয়ার ইচ্ছে ছিলো না, কিন্তু তার একা বের হওয়ার উপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা আছে তার বাবার.. 


কোথায় যাবে রিমা জানে না৷ ইউনিভার্সিটির দিকে যাওয়া যায়৷ সেকেন্ড ইয়ারের পর আর পড়াশোনা করেনি রিমা, আর কলেজেতে যায়নি৷ ওর কাছে ওই জায়গাটাই বিষাক্ত লাগতো ...


হঠাৎ করে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে রিমার বাবা খুব রাগ করেছিলো৷ কিন্তু রিমা নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলো৷ ও আর পড়বে না ...


ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে একটু খোলা জায়গা দেখে রিমা সেখানে ঘাসের উপর বসে পড়লো৷ ও যেখানে বসেছে সেখান থেকে সেই জায়গাটা দেখা যাচ্ছে যেখানে শৌভনিক আর সমাপ্তি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতো৷ রিমা যেন সব দেখতে পারছে ... চোখের সামনে সবটাই কেমন যেন দৃশ্যমান! 


সেদিন যখন শৌভনিকের বুকের মধ্যে বরফের মতো মিশে যেতে দেখেছিলো সে সমাপ্তিকে, সেদিন ওর মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিলো; ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ এ সবকিছুর উর্দ্ধে চলে গিয়েছিলো সে৷ মনের মধ্যে হিংসার দগদগে ঘা ... ভয়ঙ্কর সেই ঘায়ের যন্ত্রনা ... 


সেদিন বাড়ি ফিরে রিমা একটা সিদ্ধান্ত নেয়৷ যা হওয়ার হবে, এদের দুজনকে আলাদা সে করবেই ... সমাপ্তি-র একটা ছবি জোগাড় করে সে৷ তারপর সেই ছবিটাকে ফটোশপের নিপুন দক্ষতার সাথে জুড়ে দেয় আরেকটা ছেলের ছবি৷ তারপর একগাদা নোংরা কথা লেখে সমাপ্তির সম্পর্কে; প্রমান করতে সমাপ্তি চরিত্রহীন! সেই চিঠি সে টাইপ করে যাতে হাতের লেখা বোঝা না যায়৷ তারপর দু-কপি করে এক কপি পাঠায় শৌভনিকের কাছে আরেক কপি ওর বাড়িতে তার বাবার কাছে!


শৌভনিক হয় তো ব্যাপারটাকে ইগনোর করতো, কিন্তু পরিবারের চাপে সে সমাপ্তির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে৷ হাসিখুশি প্রাণোচ্ছ্বল সমাপ্তি এরপর থেকে একদম চুপচাপ হয়ে যায়! রিমা সেই নিষ্প্রাণ সমাপ্তি কে দেখে মনে মনে পুলকিত হয়ে যায়!


রিমার মনের ক্ষতটা যেন ওদের আলাদা করেও শুকায়নি৷ এবার সে সমাপ্তির আরো একটা ছবি এডিট করে, নোংরা একটা ছবিতে রূপান্তরিত করে সেই সাধাসিধে সাধারণ ছবিকে৷ তারপর ক্লাসের প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ের কাছে সেটা পৌঁছাবার ব্যবস্থা করে খুব যত্ন করে, যেন কেউ না বোঝে কাজটা কে করছে! 


রিমা ভেবেছিলো মেয়েটা এতে অপমানিত হবে! সবার কাছে ঘৃণার পাত্রী হবে, হলোও তাই ..


কিন্তু এরপর কি হতে পারে একুশ বছরের রিমার মাথায় সে পর্যন্ত চিন্তা যায়নি৷ প্রচন্ড রকম অপমানিত হওয়ার পর সেই ধিক্কার, সেই ঘৃণা সহ্য করতে পারেনি সমাপ্তি ... ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে নিজের জীবনটা শেষ করে দিয়েছে সে... 


এত কিছুর পর শৌভনিকও তার হয়নি৷ শৌভনিক কে তার বাবা মা বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে সমাপ্তির মৃত্যুর পর৷ রিমা না পেয়েছে শৌভনিক কে, না পেয়েছে সুখ! শুধু হিংসার আগুনে জ্বলে-পুড়ে একটা তরতাজা প্রানের খুনী হয়েছে সে ...


চলবে..


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #পর্ব_৯

No comments:

Post a Comment