Saturday, 16 September 2023

সুইসাইডাল বক্স (পর্ব: ৪)

 


'সুইসাইডাল বক্স'

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ৪

_____________________


আনোয়ারা মেয়েটা রিমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে৷ ভয়ার্ত গলায় সে রিমাকে বললো- 


—দিদি, চলো ঘরে যাই.. 


—তুই কীভাবে বুঝিস আমার সবকিছু বলতো? 


—দিদি, ঘরে গিয়ে কতা বলবো, চলো!


—ভয় পাচ্ছিস কেন ? আরে আমি লাফ দেবো না 


—তা বেশ, চলো ঘরে যাই...


—ঠিক আছে বাবা, চল ..


রিমা আনোয়ারার সাথে ঘরে চলে যায়৷ রিমা বিছানায় হ্যালান দিয়ে শুয়ে পড়লো, চোখটা বন্ধ করে রিমা৷ ওর আজ খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে৷ আনোয়ারার সাথে কথা বলা খানিকটা দেওয়ালের সাথে বলার মতো; চুপচাপ শুনবে, কিন্তু সচরাচর কোন উত্তরই সে পাবে না! সে শুধু একটা কাজই ভালোমতো করতে পারে, তা হলো ছায়ার মতো রিমাকে ফলো করতে৷ রিমা চোখ মেলে তাকালো, আনোয়ারা সেখানে নেই৷ সে আনোয়ারা বলে ডাক দিতেই সে চলে এলো সাথে সাথেই- হাতে তার এক কাপ কড়া লিকারের চা....


রিমা চা হাতে নিলো৷ হাতে নিয়ে বললো; 


—আনোয়ারা, বাবা তোকে বলেছে না, সারাক্ষন আমাকে ফলো করতে?


আনোয়ারা চুপ করে রইলো৷ রিমার বাবা তাকে এই দায়িত্ব দেয়নি; কিছুই বলেনি, কিন্তু গতবারের ঘটনার পর আনোয়ারা নিজেই এ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে৷ সেবার আনোয়ারা যদি একটু সচেতন হতো তাহলে বোধহয় এমনটা হতো না!


—কি রে আনোয়ারা, চুপ করে আছিস কেন? বল! বাবা কি বলেছে তোকে.. আমাকে ফলো করতে?


—না তো দিদি..! 


—সত্যি করে বল! বাবা যদি এমনটা বলে আমার কিন্তু ভালোই লাগবে, মনে হবে মানুষটা অন্তত আমার কথা ভাবছে ..


—বাপের কাছে বেটির চাইতে আপন কেউ হয় না গো দিদি..বড়দাদাবাবু আপনাকে অনেক ভালোবাসে, কিন্তু দেখায় না..


—হা হা হা! আনোয়ারা, তোকে যে বিক্রি করে দিয়েছিলো বারো বছর বয়সে সে তোর বাবাই ছিলো, তাই না..? বাবা হলেই ভালো হবে, মেয়েকে ভালোবাসবে.. এ ধরনের চিন্তা করাটা হচ্ছে বুলশিট, বুঝেছিস! মানে একদম বাজে কথা...


—অভাবের জন্যে এমুন করেছিলো৷ আমার আরো ভাই-বোন ছিলো, নদী ভেঙ্যে ক্ষেত-ফসল সব গেছিলো গাঙের জলে ... এতগুলো মানুষের বাঁচবার আশায় আমাকে বেচেছিলো.. 


—তার উপর তোর রাগ নেই? এভাবে বলছিস অভাবের জন্য বিক্রি করেছে .. সত্যিই কি রাগ নেই ?


—না দিদি ... আমি তো ভালোই আছি৷ খাওয়ার কষ্ট নেই, গায়ের কাপড়ের কষ্ট নেই ... রাগ রেখ্যে কি করবো, নিজেরটা খালি বুঝলে হব্যে! ওদের কষ্টও বোঝা লাগে দিদি ...


—তুই ভালো আছিস, কারন তোকে যে কিনেছিলো সে তোকে ব্রোথেলে বিক্রি না করে আমার বাবার কাছে বিক্রি করেছে! ব্রোথেল বুঝিস? নষ্ট মেয়ে মানুষদের আখড়া .. তোর কপাল ভালো বুঝেছিস! আর কিচ্ছু না ..


—কপাল যদি ভালোই হয় তাইলে আর রাগ রেখ্যে লাভ কি কও!


—যাক গে, তোর সাথে এসব কথা বলা অর্থহীন.. তারপরও বুঝলি আনোয়ারা, তোর বাবা আমার বাবার চেয়ে ভালো৷ তোর বাবা তোকে বিক্রি করে দিয়েছে টাকার কাছে, আর আমার বাবা আমাকে বিক্রি করেছে সময়ের কাছে ...


মা মারা যাবার পর আমার কথা বলার মানুষটাও আর কেউ থাকলো না৷ কখনো কোন বন্ধু বানাতে পারিনি, সবসময় নিজেকে সংকীর্ণ লাগতো! আমি তো শুধু বাবার কাছে সময়ই চেয়েছি, বাবা কি এতোটুকুও আমাকে কখনো দিয়েছে..!


তুই আর আমি তো একসাথেই বেড়ে উঠলাম এই বাড়িতে! কখনো দেখেছিস বাবাকে আমার মাথায় একটু হাত রাখতে..! আমার যখন জ্বর হতো, আমি জ্বরের ঘোরে কাঁপতাম৷ সুমিতা আন্টিকে জড়িয়ে ধরে আমি বাবাকে খুঁজতাম .. বাবা হয় বিদেশে থাকতো না হয় অফিসে! আমার পাশে ছিলো না কখনো .. সুমিতা আন্টি আমাকে মায়ের মতো ভালোবাসতো জানিস, তোকেও অনেক ভালোবাসতো তোর মনে নেই? সেই আন্টিও একদিন আসা বন্ধ করে দিলো, দিনের দিনের দিন আমি আন্টির জন্য অপেক্ষা করেছি .. অনেকদিন পর জানলাম আমাদের বাড়ির চাকরিটা আন্টি ছেড়ে দিয়েছে৷ কেন ছেড়ে দিলো চাকরিটা বলতে পারিস?


আজ আমি বাবার কাছে গিয়ে বসলাম৷ বাবা যদি শুধু একবার জিজ্ঞেস করতো, "রিমা মা ভালো আছো?" আমি কতটা খুশি হতাম তোকে বোঝাতে পারবো না ... কিন্তু বাবা একবারও বললো নারে আনোয়ারা! আমার বাবা একটাবারের জন্যেও বললো না..


—দিদি, মেয়্যা মানুষের ধৈয্য ধরতে লাগে অনেক.. বড়দাদাবাবু মানুষ খারাপ না৷ শুধু কাজকামের চাপ বেশি.. এর জন্যি তোমার সাথে গফসফ করতে পারে না৷ এইগুলো মনে নিয়্যা মন ভারি করে রাখল্যে চলব্যে? এরচে বিরাট বিরাট কষ্ট নিয়্যা মানুষে হাসি মুখে বেঁচ্যা থাকে গো.. ধৈয্যের গুণ বড় গুণ


—ধৈর্য্য, হা হা হা! হুম ভালো বলছিস ... হা হা হা!


******


একটা কেস সল্ভ করার আগে আমি অন্য কেস নিতে চাই না৷ মনোযোগ ডাইভার্ট হয়ে যায়৷ কিন্তু মিতালী গোস্বামী আমার সাথে আর যোগাযোগ করছে না! হয়তো টাকাটা এখনো জোগাড় করতে পারেনি৷ তাকে অনলাইনে দেখি, কিন্তু সে আমাকে নক করে না ... চিন্তা হচ্ছিলো, ভাবলাম সব ঠিক আছে তো! নিজে থেকেই তাই 'হ্যালো' বললাম ৷ আমার হ্যালোর জবাবে তিনি লিখলেন, 'আর কটা দিন সময় লাগবে ..' আমি আর কথা বাড়ালাম না, উনিও আর কোন কিছু বললেন না৷ যাক, আমি নিশ্চিন্ত হলাম কিছুটা৷ উনি ভালো আছেন, এটুকুই যথেষ্ট, টাকা জোগাড়ের চেষ্টায় আছে, থাকুক!


আজ আমি পেন্ডিং ম্যাসেজগুলো চেক করতে বসলাম৷ তিনটে নতুন ম্যাসেজ! এত মানুষ মরতে চায়.. কেন! মৃত্যুই কি তবে জগতের সব সমস্যার সমাধান? এই যে আমার তিতলী এই মৃত্যুকে সমাধান ভেবে যে চলে গেলো, ও কি জানে যে ওর চলে যাবার পর আমরা কেমন আছি? আমার মা তিতলী চলে যাবার পর থেকে একবারও হাসেনি৷ মায়ের কথা ভাবলে বড্ড অবাক হই৷ আট বছর বয়সী দুটো জমজ ছেলে-মেয়ে রেখে বাবা মারা গেলেন৷ এরপর মা ঐ স্কুলে চাকরি করেই আমাদের ভাই-বোনদুটোকে বড় করলেন৷ বাবা যখন মারা যায় তখন মায়ের আর কতই বা বয়স ছিলো! কিন্তু তারপরও উনি একটাবারও নিজের কথা ভাবেনি৷ দ্বিতীয়বার সংসার করেননি৷ শুধু আমাদের জন্য নিজের জীবনটা উৎসর্গ করে দিয়ে গেলো৷ অথচ বিনিময়ে তার একটা সন্তান তার মুখ থেকে হাসি কেড়ে নিয়ে চলে গেলো সারাজীবনের জন্য৷ মানুষটা বেঁচে আছে ঠিকই, কিন্তু এই বেঁচে থাকাকে ঠিক বেঁচে থাকা বলে কি না, আমার জানা নেই .. বাবার মৃত্যুটাও মা কে এতটা ভেঙে চুরমার করে দেয়নি যতটা দিয়েছে তিতলীর মৃত্যু৷ বাবার মৃত্যুটা ছিলো সহজ, স্বাভাবিক৷ অসুস্থ হয়েছিলেন, দীর্ঘদিন রোগে ভুগেছেন, তারপর মারা গেছেন.. কিন্তু তিতলীর মৃত্যুটা অস্বাভাবিক৷ তিতলীর বয়স ছিলো একুশ ... রোগ ছিলো না, জরা ছিলো না .. শুধু ছিলো হয়তো বুক ভর্তি গোপন অভিমান৷ আমি জানি না সে অভিমানের কারন, জানে না মা-ও ..


বসার ঘরের ছবিটা এখনো আগের মতোই টাঙানো আছে৷ মা ঐ ছবি খুলতে দেয় না৷ ছবিতে আমার দাড়ি ধরে টানছে তিতলী .. আমি চিৎকার করছি আর ও খিলখিল করে হাসছে .. আমাদের দুজনেরই বয়স তখন পনেরো-ষোলো হবে.. 


আমাদের দুই ভাই-বোনের সম্পর্ক ছিলো বন্ধুর মতো৷ আমরা কত রাত গল্প করে পার করেছি, অথচ এত গল্পের পরেও আঁচ করতে পারিনি কি চলছে আমার বোনের বুকের গহীনে .. 


মানুষ কষ্ট লুকোনোর অভিনয় করতে সবচেয়ে ভালো পারে৷ একজন মানুষ সহজ স্বাভাবিক ভাবে আপনার সামনে হেঁটে বেড়াবে, আপনি বুঝতেও পারবেন না সেই মানুষটার হৃদয়ে কোন ঝড় চলছে ... অভিনয়! সবই অভিনয়! এই অভিনয় না জানলে যে সমাজে মান থাকে না, পরিবারে মুখ থাকে না৷ যে যত ভালো অভিনয় করতে পারবে, মানুষ তাকে তত বেশি সুখী ভাববে৷ আচ্ছা, কেউ যদি কষ্টে থাকে তাহলে তা প্রকাশ করতে দোষ কি! কেন করতে হবে এই লোক দেখানো মিথ্যা অভিনয়! অন্য কারো কাছে না হোক আপন মানুষগুলোকে তো বলাই যায়! আমি কি তিতলীর আপন ছিলাম না? কেন ও আমাকে ওর কষ্টের কথা বলেনি? ভালোবাসা আর বন্ধনের চেয়েও কি তবে দ্বিধার শক্তি বেশি?


প্রথম ম্যাসেজটা ওপেন করলাম৷ আইডির নাম 'জোনাকির আলো'.. ফেক আইডি বোঝাই যাচ্ছে৷ ফেক আইডি থেকে আসা কেস এর আগেও সল্ভ করেছি৷ এটা আমার জন্য কোনো বড় ব্যাপার না৷ আইডির নাম যাই হোক, হোক সে পুরুষ অথবা নারী, আমার কাছে সবারই একটাই পরিচয় ..তারা সবাই তিতলী .. আমার বোন..


জোনাকির আলো লিখেছে, "সুইসাইডাল বক্স কেনা হয়তো আমার হয়ে উঠবে না আঁধার৷ তবে আপনাকে আমার গল্পটা শোনাতে ইচ্ছে হলো৷ আপনি শুনে শুধু বলবেন আমি যদি আত্মহত্যা করি কারনটা কি যৌক্তিক হবে নাকি অযৌক্তিক! এর কি কোন সমাধান সম্ভব নাকি সম্ভব নয়! ... বক্স না কিনে যদি আমি গল্পটা বলতে চাই আপনি কি শুনবেন..?"


আমি লিখলাম, "অবশ্যই শুনবো, আপনি বলুন.."


চলবে.. 


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #চতুর্থ_পর্ব

No comments:

Post a Comment