Saturday 4 November 2023

সুইসাইডাল বক্স (পর্ব: ৮)


 

সুইসাইডাল বক্স

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ৮

_____________________



..গ্রুপটা বন্ধ করলেও ইনবক্সে ম্যাসেজ আসা বন্ধ হলো না৷ ফেসবুকে এখন আমার গ্রুপটা নিয়েই তোলপাড় চলছে৷ অনেকেই সাপোর্ট করে পোস্ট দিচ্ছে, তারা গ্রুপটি আবার ফিরে পেতে চায়৷ নেগেটিভ পোস্টেরও অভাব নেই৷ তারা বলছেন সবটাই ব্যবসা .. আমি মিতালী দি-কে বললাম সবটা৷ দিদি বলেছিলেন দেখো, গ্রুপ থামলেও আঁধারের পথচলা থামবে না৷ হলোও তাই৷ আসলেই অভিজ্ঞতা একটা বড় জিনিস৷ মিতালী গোস্বামী জীবন যুদ্ধে অভিজ্ঞ৷ আসলে একটু দেরি হলেও, আমি নক পেলাম আবার ..


নক দিয়েছেন একজন মাঝ বয়সী ভদ্রলোক৷ নাম সজল অধিকারী৷ উনি লিখেছেন—


"আপনার কথা এক বন্ধুর থেকে শুনেছি, এও শুনেছি সুইসাইড বক্স আপনি কখনোই বিক্রি করেননি৷ বরং আপনি সবার ভালো চেয়েছেন, আত্মহত্যার থেকে ফেরাতে চেয়েছেন এবং কয়েকবার সফলও হয়েছেন৷ আপনার উদ্দেশ্য মহৎ হলেও আসলে আপনার উপস্থাপনটা খানিকটা দৃষ্টিকটু ছিলো.. অন্তত যারা প্রথমবার দেখবে তাদের জন্য৷ কিছু মনে করবেন না, আমি শুধু আমার মনের কথাটাই বললাম৷ 


আমি সজল অধিকারী, সরকারী চাকুরিজীবী৷ বয়স ৫৮ বছর৷ হয়তো ভাবছেন এত বয়সী একজন মানুষ আপনাকে কেন ম্যাসেজ করলো! তার আগে বলে নিই, আমি ফেসবুক ব্যাপারটা এত ভালো বুঝি না, ছেলে-মেয়েরাই শিখিয়েছে৷ তবে, বেশ কিছু বছর যাবৎ, আমার ছেলে-মেয়েরা দেশের বাইরে থাকে৷ এখন ওদের ছবি দেখাই আমার প্রধান উদ্দেশ্য৷ ইদানীং আপনার গ্রুপ নিয়ে এত বেশি সবাই লিখছে যে আমিও দেখলাম৷ সেখান থেকেই আপনাকে জানা আসলে৷ যাই হোক, যে সুইসাইড বক্সের অস্তিত্বই নেই আমি সেটা কিনতে চাই না৷ তবে, এটাও ঠিক আজকাল আর বাঁচবার ইচ্ছে হয় না৷ 


আমার স্ত্রী গত হয়েছে পনেরো বছর আগে৷ দুই ছেলেমেয়ে আমার, ও কারোই প্রতিষ্ঠা বা বিয়ে দেখে যেতে পারেনি৷ ছেলেটা বিদেশে পড়তে গিয়ে সেখানেই স্থায়ী হয়ে গেলো৷ মেয়েটার বিয়ে দিয়েছিলাম দেশেই৷ চেয়েছিলাম একটা সন্তান অন্তত কাছে থাক, সেও চলে গেলো ... 


এখন আমার দিন কাটে এই স্মার্টফোন নিয়েই৷ যতক্ষন অফিসে থাকি, ভালো থাকি৷ বাড়িতে ফিরলেই শূন্যতা আমাকে গ্রাস করে৷ এই নিস্তব্ধতা সহ্য করা আমার জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো৷ আমার এখন কথা বলার একজন সঙ্গী প্রয়োজন৷ অনেক ভেবে চিন্তে তাই দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবি৷ 


একটা বয়সে ছেলে-মেয়েরা বাবা মায়ের গার্জেন হয়ে যায়, আমার ছেলে মেয়েরাও তাই হয়েছে। আমি প্রথমেই কথাটা বললাম আমার মেয়েকে৷ ভাবলাম, ওই আমার সবচেয়ে বেশি আদরের, ও নিশ্চয় বুঝবে৷ কিন্তু ফলাফল হলো ভিন্ন৷ ও কেঁদে-কেঁটে একাকার অবস্থা করে ফেললো৷ জামাই আমাকে বললো "বাবা আপনার বয়স হয়েছে, এখন ধর্ম কর্মে মন দিন৷" সকাল-সন্ধ্যা দুবেলা আহ্নিক করি আমি, পৈতা হওয়ার পর সেই অভ্যাস বাদ দিইনি কখনো৷ আমি যুবক বয়সেও যেমন ধর্ম কর্ম করেছি এখনও তাই করি৷ আমি জানি কোথাও আমার দ্বিতীয় বিয়েতে মানা করবার কেউ নেই৷ তারপরও সবার আপত্তি... আমি আর কথা বাড়ালাম না৷ আমার দুই ছেলে-মেয়েকে বললাম৷ ওরা অবশ্য কাঁদলো না তবে চিল্লামেল্লি করলো অনেক৷ এমনকি এটাও বললো, আমার নাকি ভীমরতি হয়েছে৷ আমার চরিত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে, আরো অনেক কিছু, তাই, আমি আর এ বিষয়ে কথা বাড়ালাম না৷ 


আমার নিজেরও মনে হলো নাতি-নাতনি হয়ে গেছে এখন আর এসব মানায় না, কিন্তু আমার একাকীত্ব কমলো না৷ সারাজীবন রাত দশটার মধ্যে যে মানুষটা ঘুমাতাম, রাতের পর রাত তার বিনিদ্র রজনী কাটতে লাগলো৷ 


অফিসের কলিগদের সাথে ব্যাপারটা শেয়ার করলাম৷ তারা সবাই বললো আমার বিয়ে করাই উচিত৷ ছেলে মেয়ে তো আর কাছে এসে থাকছে না বা আমাকে ওদের কাছে নিয়ে যাচ্ছে না৷ তাই, ওদের কথা না ভেবে আমার বিয়ে করাটাই যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করলো সবাই৷ 


তারাই আমার জন্য মেয়েও দেখলো৷ একজনকে আমারও পছন্দ হলো৷ বিধবা, নিঃসন্তান৷ বয়স ৪০+ .. বলা যায় আমার অর্ধেক বয়সী, কিন্তু বয়সটা নিয়ে আমার একটু সংশয় ছিলো৷ বিয়ের কথা বলার আগেই তাই আমি মেয়ের সাথে সরাসরি কথা বললাম৷ তাকে বললাম, "আপনি কম বয়স্ক কাউকে বিয়ে করতে পারবেন৷ আমি যথেষ্ট বয়স্ক, আমার মৃত্যুর পর আপনাকে অনেটা জীবন একা থাকতে হতে পারে৷" উনি বললেন "সমবয়সী-কেই বিয়ে করেছিলাম, তারপরও সে তো চলে গেলো! কখন, কার মৃত্যু হবে কে বলতে পারে! আপনার আগে আমিও চলে যেতে পারি .." 


বুঝলাম তার আপত্তি নেই৷ আমার কলিগদের উপস্থিতিতে, একদম ঘরোয়াভাবে আমি বিয়ে করে ফেললাম৷ 


সমস্যাটা শুরু হলো তারপর থেকেই৷ চিরকাল শুনেছি পিতা-মাতা সন্তানকে ত্যাজ্য করে, আমার ক্ষেত্রে ঘটনা হলো উল্টো৷ আমার দুই সন্তান আমাকে ত্যাজ্য করলো৷ গত ছয়-সাতমাসে তারা আমার সাথে কোন যোগাযোগ করেনি, আমি করতে চেয়েও পারিনি৷ আমার বর্তমান স্ত্রী সঙ্গীতা-ও অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু আমার দ্বিতীয় বিয়ের অপরাধ ক্ষমা করছে না তারা৷ 


আমার আজকাল কিছুই ভালো লাগে না৷ আমার এখন সর্বক্ষনের কথা বলার মানুষ আছে, আমার অসুখে সেবা করার মানুষ আছে, আমার জন্য ঘরে অপেক্ষা করা মানুষ আছে .. তারপরেও আমার ঘুম হয় না রাতে! আমি সারা রাত জেগে বসে থাকি৷ ফেসবুকে আমার ছেলেমেয়েদের হাসিখুশি ছবি দেখি .. ওদের ছবিতে হাত বুলাই ..


আমি কি জীবনকে আরেকটা সুযোগ দিয়ে খুব বেশিই অন্যায় করে ফেলেছি, যে অন্যায় ক্ষমার ও অযোগ্য?"


আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম৷ আমার মায়ের কথা মনে হলো৷ মানুষটা তার সারাটা জীবন শুধু আমাদের কথাই ভাবলো৷ আমরা বিনিময়ে তাকে কি দিলাম? সন্তানেরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বড্ড বেশি স্বার্থপর হই৷ তিতলী তো চলেই গেলো, আমারও একসময় বিয়ে হবে৷ তখন আমাকে ও ব্যস্ত হতে হবে তাদের জন্য, হয়তো আলাদা সংসারে যেতে হবে না তবু আরেকটা সংসারের চাপ৷ তখন মায়ের কি হবে? কিভাবে থাকবে মা একা একা আমাকে ছাড়া৷ আজকে আমি বুঝলাম আমি মা কে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবো না, মা ও এই একাকীত্বের ভার সহ্য করতে পারবে না৷ তিনি তো আর সজল আঙ্কেলের মতো বিয়েও করবেন না .. কাজেই আমাকে সারাজীবন আমার মায়ের দেখভাল করতে হবে, কাছেই থাকতে হবে তার৷ যদি কোনদিন বিয়ে করি আমার শর্ত থাকবে একটাই, আমার মা আমার সাথেই থাকবে ... সবসময়!


আমি ম্যাসেজের রিপ্লাই দিলাম৷ আমি লিখলাম,


"..বয়সে আমি আপনার মেয়ের মতোই হবো হয়তো৷ আপনার লেখাটা আমি তাই আপনার সন্তান এবং আপনি দুটো দৃষ্টিকোন থেকেই দেখার চেষ্টা করলাম .. 


প্রথমেই একটা কথা বলে নিই, আপনি কোন অন্যায় করেননি৷ একজন একাকী মানুষের সঙ্গী পাওয়ার ইচ্ছেটা কোন অন্যায় কখনোই না৷ আপনার সন্তানেরা আপনাকে তাদের কাছে নেওয়ার কোন ব্যবস্থা করেনি৷ আমার ধারনা তারা দেশেও নিয়মিত আসে না৷ একাকীত্ব সহ্য করা সবার পক্ষে সম্ভবও না৷ আপনি যা করেছেন তাতে তাই কোন অন্যায় নেই ...


চলবে..


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #পর্ব_৮

No comments:

Post a Comment