বাবা:
আজকের বিষয়ে শুরুর আগে একটা গল্প বলি, নিজের বাড়ির ঘটনা, ছেলে কে আমার বাবা ডাকতে বলায় ডেকে দিলাম, দোতলার ঘর থেকে, কাল রাতের জন্য আনা মিষ্টি থেকে ভাগ বসাতে পারা যাবে জেনে একটু হলেও উত্তেজিত যে ছিলাম না তা নয়! তবু...
তা বাবা ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করল যে সে ওইটা খাবে কিনা, সেও ছিল তার হুজুগে, না বলায়, আমার মধ্যস্থতার প্রয়োজন পড়ল! খেতে খেতে বাবা ওকে অঙ্ক বোঝাল, ভগ্নাংশ সম্পর্কিত বিশেষ বাবা স্পেশাল জ্ঞান, সেখান থেকে অল্প মিষ্টি আমরা ৩ জনেই খেলাম, কাল-আজ-কাল, মানে দাদু-বাবা-ছেলে! মজার পরিস্থিতির একটা উদাহরণ ...
কিন্তু হটাৎ মনে প্রশ্ন এল কীভাবে একজন বাবা তার সন্তানদের তিক্তবিরক্ত করে তোলাকে পরিহার করতে পারে? একজন বাবা হিসেবে তার ভূমিকার গুরুত্ব বুঝতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। "সন্তানদের আবেগগত এবং মেধাগত উন্নতিতে পিতৃত্ব এক জটিল ও অদ্বিতীয় উপায়ে ব্যাপক প্রভাব ফেলে থাকে," মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর একটি পত্রিকায় বলা আছে।
তা একজন বাবার ভূমিকা কী? অনেক পরিবারে বাবাকে মূলত শাসন প্রয়োগকারী হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। একজন সন্তান যখন অশোভন আচরণ করে, তখন অনেক মা-ই সাধারণত তার সন্তানকে বলে, ‘দাঁড়া, তোর বাবা আজ আসুক!’ নিশ্চিতভাবেই, সন্তানরা যাতে পরিপক্ব হয়ে ওঠে, সেইজন্য ভারসাম্যপূর্ণ শাসন এবং যথেষ্ট দৃঢ়তা প্রয়োজন। কিন্তু, একজন ভালো বাবা হওয়ার সঙ্গে আরও বেশি কিছু জড়িত থাকে। তাই না? আজ একটু সেগুলি নিয়ে আলোচনা করা যাক!
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, প্রত্যেক বাবার কাছেই, তার সন্তানের সাহায্য করার জন্য ভালো উদাহরণ থাকে না। কিছু ব্যক্তি বাবা ছাড়াই বা তার সান্নিধ্য ছাড়াই মানুষ হয়ে উঠেছে। কিন্তু, অন্যান্য ক্ষেত্রে যে-ব্যক্তিরা এক কঠোর, উদাসীন বাবার অধীনে বড়ো হয়েছে, তারা হয়তো তাদের সন্তানদের সঙ্গেও একই আচরণ করার প্রবণতা দেখাতে পারে। কীভাবে এই ধরনের একজন বাবা সেই একই ধারা অনুসরণ করা ত্যাগ করতে পারে এবং তার সন্তান লালনপালন করার দক্ষতায় উন্নতি করতে পারে? তা আমার কাছেও প্রশ্ন ...
যেভাবে একজন 'ভালো' বাবা হওয়া যায়, সেই বিষয়ে ব্যবহারিক ও নির্ভরযোগ্য পরামর্শের এক উৎস রয়েছে। পারিবারিক জীবনের ওপর শাস্ত্রীয় বইগুলির থেকে সবচেয়ে সুষ্ঠু পরামর্শ পাওয়া যায়। এটির পরামর্শ নিছক তত্ত্বগত নয়; কিংবা এটির নির্দেশনা কখনো আমাদের ক্ষতি করে না। এগুলির পরামর্শ, এটির গ্রন্থকার সর্বোচ্চ প্রজ্ঞাকে প্রতিফলিত করে, যিনি পারিবারিক জীবনের উদ্যোক্তা। আপনি যদি একজন বাবা হয়ে থাকেন, তাহলে সন্তান লালনপালন সম্বন্ধে এইসব বইগুলি যা বলে, তা আপনার বিবেচনা করা উচিত।
একজন ভালো বাবা হওয়া কেবলমাত্র আপনার সন্তানদের দৈহিক এবং আবেগগত ভালোর জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয় কিন্তু সেইসঙ্গে তাদের আধ্যাত্মিক মঙ্গলের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। যে-সন্তানের তার বাবার সঙ্গে খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তার পক্ষে এ-জগতের সঙ্গেও এক ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তোলা সহজ হতে পারে!
আপনি যে সন্তানদের ভালোবাসেন তা বলতে কখনো দ্বিধা করবেন না, আমি সবসময় আমার সন্তানের প্রতি আমার ভালোবাসা প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি আর তা কেবল আমি তাদেরকে ভালোবাসি, এই কথা বলার মাধ্যমেই নয়, বরং তাদের প্রত্যেকের প্রতি ব্যক্তিগত আগ্রহ দেখিয়েও করেছি, যদিও সবে ১০, কিন্তু ভীত আমি সক্ষমতা সঙ্গে গড়েছি। শুধুআমি কেন সব বাবারাই বোধহয় তাদের সন্তানের ডায়াপার বদলে দিত এবং তাদের স্নান করিয়ে দিত। এ ছাড়া, আপনার সন্তানদের জানা দরকার যে, তাদের প্রতি আপনার এক সহজাত অনুমোদন রয়েছে। তাই, অতিরিক্ত সমালোচক হবেন না, উঠতে-বসতে তাদের সংশোধন করবেন না। এর পরিবর্তে, প্রশংসা করার ব্যাপারে উদার হোন।
একজন বাবার তার সন্তানদের প্রশংসা করার বিভিন্ন সুযোগ খোঁজার চেষ্টা করা উচিত। তাদের জন্য আপনার আস্কারা রয়েছে, এটা জানা আপনার সন্তানদের উপযুক্ত আত্মসম্মানবোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে। আর এটা তাদেরকে জীবনের যে কোনো সমস্যার আরও নিকটবর্তী হতে ও তার থেকে বেরিয়ে আসার সাহায্য করতে পারে!
আপনার সন্তানদের জন্য এক আনন্দপূর্ণ পরিবেশ দরকার। সন্তানদের সঙ্গে খেলাধুলা করার জন্য সময় করে নেওয়া, এই ধরনের এক পরিবেশ সৃষ্টিতে সাহায্য করতে পারে। একসঙ্গে খেলাধুলা করা বাবা ও সন্তানকে এক গভীর বন্ধনে জড়াতে সাহায্য করে। যে বা যারা এই কথার সঙ্গে একমত পোষণ করে তারাই বুঝবেন আশা করি। আমার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বিনোদনের জন্য সময় আলাদা করে রাখা, আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। আমরা একসঙ্গে বিভিন্ন গেম খেলি, বন্ধু হিসেবে সঙ্গে মেলামেশা করি এবং বিনোদনের স্থানগুলোতে বেড়াতে যাই। এটায় পরিবারের একতাকে শক্তিশালী করেছে। তবে, সন্তানদের শাসন প্রয়োজন, যাতে তারা সৃজনশীল এবং দায়িত্ববান প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে। কিছু বাবা-মা মনে করে যে, তাদের সন্তানদের শাসন করার সঙ্গে নির্দয় আচরণ জড়িত, যার অন্তর্ভুক্ত হল তাদের রূঢ়ভাবে বকাঝকা বা ছোটো করা। কিন্তু সন্তানদের শাসন করার সময় বাবা-মাকে রূঢ় আচরণ করতেই হবে। মাঝে মাঝে, শাস্তির প্রয়োজনও হতে পারে। কিন্তু, সন্তানেরও বোঝা উচিত যে, কেন তাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, তাকে শিক্ষা দিন, মাথা ঠান্ডা করে। বাবা-মায়ের শাসন কখনো যেন সন্তানের মনে এইরকম অনুভূতি এনে না দেয় যে, সে পরিত্যক্ত। যে কোনো ধর্মে প্রচণ্ড মারধর করাকে সমর্থন করে না, যা একটা সন্তানের ক্ষতি করতে পারে, যখন গুরুতর বিষয়গুলোর জন্য সন্তানদেরকে আমার সংশোধন করার প্রয়োজন হবে, তখন আমি সবসময় এটা স্পষ্ট করার চেষ্টা করব, তাদের প্রতি ভালোবাসার জন্যেই আমি তাদেরকে সংশোধন করেছি, এটা ওদের বুঝতে হবে!
সবচেয়ে বড়ো যে-পুরস্কার একজন বাবা তার সন্তানদের দিতে পারে তা হল, পরিবেশ আর পরিস্থিতির সঙ্গে এক দৃঢ় ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য তাদেরকে সাহায্য করা, উৎসাহ দেওয়া। বাবার উদাহরণ এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাবাদের দেখাতে হবে যে, সত্যের মূল্যবোধের সঙ্গে তারা নিজেদের সম্পর্ককে কতটা মূল্যবান বলে গণ্য করে। এটা বিশেষভাবে তখন স্পষ্ট হওয়া উচিত, যখন তারা ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন সমস্যা বা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। এই ধরনের পরিস্থিতিতে, বাবা দেখায় যে সে পারিপার্শিক পরিস্থিতির ওপর কতটা গভীরভাবে নির্ভর করে। পারিবারিক প্রার্থনায় যাকে ঈশ্বর বলে মনে করা হয়, তার মঙ্গলভাবের জন্য তাঁর প্রতি বার বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হলে, সেটা সন্তানদেরকে এ জগতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার গুরুত্ব সম্বন্ধে শেখাবে...
প্রত্যেক বাবাই চায় তার ছেলের মধ্যে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে। ছেলেকে সফল দেখার আশায় অনেক ক্ষেত্রেই বাবারা বেশ কঠোর হয়। আর সেখানেই শুরু হয় সমস্যা। বাবা-ছেলের সম্পর্কের মাঝে এসে পড়ে অভিমান, রাগ, কথা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো একাধিক সমস্যা।
কিন্তু এই সমস্যার শিকড় কোথায়, তা তো খুঁজে বার করলেই হয়, তাই না? বার তো করতেই হবে। তবেই তো পাওয়া যাবে সমাধান!
একটা বয়সের পরে বাবা যখন অবসর নিচ্ছে আর ছেলের কর্মজীবন শুরু হচ্ছে, এই সময়টা খুব স্পর্শকাতর। এই সময়ে বাবারা অনেক বেশি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। ছোটখাটো কথাতেই হয়তো অপমানিত হয় বলে মনে করেন। অন্য দিকে ছেলেও কর্মজগতে পা রেখে বাবার কথা শুনতে নারাজ। এই সময়ে দু’জনকেই বুঝে চলতে হবে। ছেলেকেই তখন একটু পরিণত ভাবেই পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে, বাবাকে বোঝাতে হবে। আর এমন কোনও আচরণ করা চলবে না, যাতে বাবা আঘাত পায়। অন্য দিকে ছেলের সিদ্ধান্তের উপরে বাবাকেও ভরসা রাখতে হবে, নইলে ছেলের আত্মবিশ্বাসও কোনোদিন বাড়বে না।
ছেলের সঙ্গে সময় কাটান। দেখবেন, বাইরে মেশার দরকার পড়ছে না। ঘরের মধ্যে পেয়ে যাবেন আপনার প্রিয় বন্ধুকে! 😊
[বিঃদ্রঃ- ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সন্তান, ছবিটি প্রতীকী এবং লেখায় কোনো অনিচ্ছাকৃত ভুল হলে ক্ষমা করবেন]
©উষস চট্টোপাধ্যায়~
No comments:
Post a Comment