Saturday, 15 May 2021

যুদ্ধের দামামা বাজে ঐ...

সময়টা ভালো যাচ্ছে না, একে তো এই অতিমারীর সময়, তায় এ মহামারীর মধ্যেই মাথাচাড়া দিচ্ছে মহাযুদ্ধের আভাস। সারাক্ষণই আতঙ্কে কাটছে সাধারণ মানুষের দিনকাল। এই বুঝি বেজে উঠবে সাইরেনের তীক্ষ্ণ শিস।। মারণ ভাইরাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চারদিকে। এই অবস্থাতেও যুদ্ধ ও দখলের রক্তাক্ত ইতিহাস পৃথিবীকে ছাড়তে চায়নি। দেখতে দেখতে কতগুলো দিন হয়ে গেছে। ইজরায়েল (Israel) ও ফিলিস্তাইনি জঙ্গি সংগঠন হামাসের (Hamas) মধ্যে সংঘর্ষ থামার কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। তাই, হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাই আঁকড়ে ছুটে গিয়ে লুকোতে হবে আন্ডারপাসে। কখন কোন বাড়িতে আছড়ে পড়বে রকেট, কে জানে! দূরে বসে আমরা দেখছি সেইসব ভিডিও। রাতের আকাশ আলো করে রেখেছে রাশি রাশি সব রকেট। যেন আতসবাজি, আসলে মৃত্যুবান, ঠিক যেন রামানন্দ সাগর-এর কোনো ঐতিহাসিক সিরিয়াল! কার জন্য মরণের শমণ আনছে কে তার হিসেব রাখে। অথবা কোনও উঁচু অট্টালিকা গুঁড়িয়ে গেল আছড়ে পড়া রকেটে। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে আর্ত চিৎকার, শেষ সময়ে নিজের ঈশ্বরকে ডেকে নিচ্ছে কেউ। এমনই সব ভিডিও ও ছবি দেখে আঁতকে উঠছে বিশ্ব, থুড়ি, অন্য আরেক বিশ্ব! এদিকে আছড়ে পড়া করোনার দ্বিতীয় ঢেউ, মানুষ মারা যাচ্ছে অক্সিজেনটুকু না পেয়ে। ঠিক সেই সময়ই আর একদল মানুষ উদ্যত এই চাহিদায়, যে একে অন্যকে শেষ করে ফেলতে হবে। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে এগোচ্ছে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে। আরও ক্ষয়, আরও মৃত্যুর খতিয়ান যেন তৈরি হওয়ার জন্যই অপেক্ষা করছে। কিন্তু কেন? ‘কেন’ ইজরায়েল ও ফিলিস্তাইনের (Palestine) মধ্যে এই লড়াই? আসলে এই লড়াই অনেক কাল পুরনো। দশকের পর দশক ধরে চলছে। কখনও তা তীব্র আকার ধারণ করে, কখনও আবার চলতে থাকে ঢিমে তালে। ইজরায়েলের তেল আভিভ বা অন্য বড় শহরের মানুষের কাছে তাই মাঝেমধ্যে আকাশ থেকে রকেট আছড়ে পড়তে দেখা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এবারের পরিস্থিতিটা হয়ে গিয়েছে ভয়ংকর। তাই আশঙ্কায় কাঁপছে সারা বিশ্বের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। আমার মতো, অনেকেরই মনে পড়ছে ২০১৪ সালের কথা। সেবার টানা প্রায় ২ মাস চলেছিল একটানা লড়াই। গাজা (Gaza) ভূখণ্ডে ইজরায়েলি সেনার বোমাবর্ষণে চুরমার হয়েছিল ঘরবাড়ি। কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল গাজা শহরটা। ইংল্যান্ডের প্লেয়ার মোইন আলির সাজাও হয়েছিল হাতে বিশেষ ধরনের ব্যান্ড পরার কারনে, যাতে লেখা ছিল 'SAVE GAZA'। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (ICC) সেবার তাকে হুঁশিয়ারি অবধি দিয়েছিল! এবারও ইতিমধ্যেই গাজা শহরের বড় বড় ইমারতের ক্ষতি হওয়ার কথা জানা গিয়েছে। পাল্টা রকেট হামলা করে চলেছে হামাসও। যদিও ‘আয়রন ডোম’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে বেশির ভাগ রকেটকে প্রতিহত করে দিয়েছে ইজরায়েল, নাহলে গত চারদিনে ছোঁড়া ১৬০০ রকেটে তেল আভিভের মতো শহর তছনছ হয়ে যেতে পারত। 


আসলে এই সমস্যার শুরুয়াৎ অনেক গভীরে। ইতিহাস বলবে সেই খ্রিস্টজন্মের আগের সময়কালের কথা। তবে মোটামুটি আধুনিক সময়ের হিসেবে তার সূচনা গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে গঠিত হয় ইজরায়েল। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের ইসলাম ধর্মাবলম্বী দেশগুলি মান্যতা দেয়নি তাদের। অনেক টালবাহানার পরে স্থির হয় পশ্চিম জেরুসালেম থাকবে ইজরায়েলের অধীনে আর পূর্ব জেরুজালেম থাকবে জর্ডনের অধীনস্থ। কিন্তু তা ছিল একেবারেই অস্থায়ী ব্যাপার। দু’দশক যেতে না যেতে লাগল যুদ্ধ; ১৯৬৭ সালে সিরিয়া, জর্ডন ও ফিলিস্তাইনিদের সঙ্গে ইজরায়েলের লড়াইয়ের পরে পূর্ব জেরুসালেমও দখল করে নেয়। সেই সঙ্গে দখল করে আরেক উল্লেখযোগ্য স্থান ফিলিস্তাইনের ওয়েস্ট ব্যাংক। এরপর থেকেই এই সব অঞ্চলে ইজরায়ে‌ল ও ফিলিস্তানীয়দের সংঘর্ষ এক নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। 


এরই মধ্যে ১৯৮৭ সালে জন্ম নেয় ফিলিস্তাইনের সবচেয়ে কট্টর ইসলামপন্থী সংগঠন হামাস। ‘ইন্তিফাদা’ বা ফিলিস্তাইনি গণজাগরণ শুরু হওয়ার পরে তাদের জন্ম হয়। এই জঙ্গিগোষ্ঠীর ঘোষিত লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে ইজরায়েলের ধ্বংস। বর্তমানে যা ইজরায়েল, গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাংককে একসঙ্গে নিয়ে তৈরি হবে একটি ইসলামপ্রধান রাষ্ট্র, এমনই স্বপ্ন দেখে তারা। প্রাথমিক ভাবে সামরিক শাখা ইজ্জেদিন আল-কাশেম ব্রিগেডসের মাধ্যমে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই চালানোর পরিকল্পনাই ছিল তাদের।

তবে ২০০৫ সালে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতেও অংশগ্রহণ করে হামাস। পরের বছর ফিলিস্তাইনের আইন পরিষদের নির্বাচনেও জিতে যায়। কিন্তু এরপরই ২০০৭ সালে আরেক প্রবল শক্তিশালী জঙ্গি গোষ্ঠী ফাতাহ-র সঙ্গে তাদের লড়াই লেগে যায়, কিন্তু সেই যুদ্ধে জিতে যায় হামাসই। আর তারপর থেকে গাজা রয়েছে তাদেরুই দখলে। আর সেই থেকেই ইজরায়েলের সঙ্গে হামাসের সংঘর্ষ সমানে চলছে। ইজরায়েল চেষ্টা করে চলেছে গাজা দখল করে নিতে, আকাশপথে হানা দিয়েছে। আর হামাস বারবার রকেট ছুঁড়ে ইজরায়েলকে চায় পালটা জবাব দিতে। কেবল ২০০৮ সালেই ইজরায়েলের সেনার আক্রমণে ১৩০০ ফিলিস্তানি মারা যান। মৃত্যু হয় ১৩ জন ইজরায়েলির। পরে ফের ২০১২ সালে ইজরায়েলের এয়ার স্ট্রাইকে হামাসের কাসাম ব্রিগেডের কমান্ডার আহমেদ জাবারির মৃত্যু হলে শুরু হয় প্রবল সংঘর্ষ। সেবারও ১৭০ জন ফিলিস্তানি ও ৬ জন ইজরায়েলির মৃত্যু হয়। ২০১৪ সালে শুরু হয় আরেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। হামলা, এবং পালটায় ক্ষতবিক্ষত হয় গাজা, মারা যান ২১৪৩ ফিলিস্তাইনি। আহত ১১ হাজার, ঘরছাড়া হতে হয় লক্ষাধিক সাধারণ মানুষকে! 


রাষ্ট্রসঙ্ঘ, কাতার ও ইজিপ্টের তৎপরতায় পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ না বাঁধলেও সেই থেকেই কার্যত বারুদের স্তূপের উপরে রয়েছে গাজা ও আশপাশের অঞ্চল। তবে হামাসের পক্ষে ইজরায়েলের বড় ক্ষতিসাধন সম্ভব হয়নি ‘আয়রন ডোম’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য।

২০১৪ সাল থেকে ২০২১। ফের শুরু হয়েছে বড় ধরনের সংঘাত। আসলে ইজরায়েল অধিকৃত পূর্ব জেরুসালেমের শেখ জারাহ এলাকায় কয়েক ঘর ফিলিস্তানি পরিবারের ভিটেমাটিহারা হওয়ার আশঙ্কা থেকেই নতুন করে সংঘাত শুরু হয়ে গিয়েছে, অথচ ওই অঞ্চলে ওই পরিবারগুলি থাকতে পারবে কিনা সেই নিয়ে মামলা চলছে ১৯৭২ সাল থেকে। সেই থেকেই ইহুদিদের দাবি ওই জমি তাদের। আর ফিলিস্তানিদের কাছে এ আসলে তাদের বাস্তুচ্যুত করার রাষ্ট্রীয় কৌশল বলে মনে হয়েছে। সেই থেকেই শুরু, প্রথমে ছোটখাটো সংঘর্ষ, ক্রমে বিষয়টা গত ক-দিন ধরেই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ঘোর করোনা কালে পুরনো শত্রুতাকে আঁকড়ে ধরে দু’পক্ষের হানা সংঘর্ষ, হামলা-পালটা জবাবের এক অনর্গল বৃত্ত! ব্যাক টু স্কোয়ার ওয়ান! পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের আশঙ্কা, এবার বোধহয় আর পূর্ণাঙ্গের যুদ্ধ হওয়াটা আটকানো যাবে না। 


আর মানুষ? সাধারণ মানুষ? তাঁদের দিন কাটছে প্রার্থনায়, বিশেষ করে গাজার পাশ্ববর্তী এলাকায়। সাত বছর আগের সেই ধ্বংসলীলার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে সেখানে। হামাসের দাবি, এখনও পর্যন্ত এই ক’দিনে ৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে এখানে। যার মধ্যে রয়েছে ১৭টি শিশুও! আহতের সংখ্যা প্রায় পাঁচশো! ইজরায়েলের অবশ্য দাবি, নিহতদের অধিকাংশই আসলে জঙ্গি। আতঙ্ক রয়েছে তেল আভিভ, আশকেলন, আশদদের মতো শহরেও। সব রকেট যে আটকাতে পারে না শক্তিশালী প্রযুক্তিও। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে যদি একটি রকেটও আছড়ে পড়ে? প্রতি পদে তাই ঘুরে ঘুরে যায় মৃত্যুর সার্চলাইট। 


বৃহত্তর দৃষ্টিতে সংঘর্ষ কিংবা যুদ্ধে মৃত্যু আসলে সংখ্যা মাত্র, কিন্তু ধ্বংসস্তূপের বারুদগন্ধের ভিতর থেকে যে ক্রন্দনধ্বনি ঠিকরে বেরোয়, তা বুঝিয়ে দেয় যুদ্ধে যেই জিতুক বা হারুক আসলে পরাজিত হয় সাধারন মানুষই। আমাদের কি, আজ শনিবার, উইকেন্ডে সবাই মিলে জমিয়ে মাংস খাওয়া যাবে! তার ওপর কাল থেকে ঘোষিত লকডাউন ... 😊 


©Uষস চttopadhyay~

তাং:- ১৫|৫|২১ 

No comments:

Post a Comment