Tuesday, 21 September 2021
বোধের বোধোদয় ..
বোধের বোধোদয়:-
মার্কেটের শো রুম বন্ধ করে এক্সাইড মোড়ে সিগন্যালের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। বাস, গাড়ি আসছে আর যাচ্ছে। সিগন্যালেও থামার কোনো নাম নাই কারণ বাস ভর্তি যাত্রী। সবাই পুজোর ছুটিতে যার যার বাড়ি যেতে ব্যস্ত! দশমীর একদিন পরেই ঈদুল ফিতর, ফলে ব্যস্ততা আর ও বেশি! আর আমি কিছুক্ষণের মধ্যে ব্যস্ত এই সড়কের যেকোনো একটা বাসের নিচে ঝাঁপ দেবো বলে অপেক্ষা করছি!
নতুন জয়েন করেছি মাল্টিপ্ল্যানের একটা কম্পিউটারের দোকানে সেলসম্যান হিসেবে। মাত্র দশ দিন হয়েছে চাকরীর। বাড়ির বড়ো ছেলে হিসেবে আমার উপর এখন সংসার চালানোর দায়িত্ব!
বাবা ব্যবসায় লস খেয়ে পথে নেমেছেন অনেকদিন। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াও আমার পক্ষে আর সম্ভব হল না। তাই লেখাপড়া ছেড়ে কাজে নেমেছি সংসারের চাকা ঘোরাতে!
দশদিন জয়েনের চাকরী তাই মাইনে হয় নি আমার, আর কদিন পরেই পুজো! ছোটো ছেলেটা টুতে পড়ে আর বোন সামনে টুয়েল্ভ দেবে! বোন যতই বড়ো হয়ে যাক, বায়না তো একটু দাদার কাছে করবেই, এমনিতে বোঝদার হলেও ছোটো বোনটার পুজোর আগের থেকেই বায়না এই বার লাল রঙের একটা কুর্তি লাগবেই, আর তার সাথে আমার ছেলের আবদার পাঞ্জাবী! বড়দের না হয় বোঝাতে পারা যায় তবে ছোটদের?
বাড়িতে গেলেই ছোটো ছেলেটা আমার পিছু পিছু ঘুরবে আর আস্তে আস্তে করে কানের কাছে এসে বলবে "বাবা, আনবে কবে?" তাকে বলা হয়েছে, সেলাই করতে দেওয়া হয়েছে! পুজোতে অনেক মানুষ জামা কাপড় বানায় তাই জামা দিতে দেরি হচ্ছে কিন্তু অষ্টমীর আগেই নতুন পাঞ্জাবী চলে আসবে; সাথে জুতো, বড়োদের জামাকাপড়, আমাদের পায়জামা, পাঞ্জাবী ইত্যাদি!
দোকান থেকে বাড়িতে গেলেই সে দৌড়ে আমার জন্যে জল নিয়ে আসে, খাতির যত্ন করে, মাথা টিপে দেয়, আর এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করবে, "বাবা, আমার পাঞ্জাবী?"
মোটামুটি সচ্ছল পরিবারেরই ছিলাম আমরা, কিন্তু আমার বাবার মানুষের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস আর খরুচে হাতের ফল খুব করে টের পাচ্ছি এখন! একটা পুজোতে নিজেরা কিছু গায়ে না দি, কিন্তু ছোটো ছেলেটার কথা ভাবতেই চোখটা ভিজে যাচ্ছে আমার!
দোকান মালিককে বলতেও লজ্জা লাগলো আমাকে কিছু টাকা এডভান্স দিন! মাত্র কয়েকদিন চাকরীতে ঢুকেই এখনই টাকা পয়সা এডভান্সে চেয়ে চাকরীটাই না যায় ভেবে তাকেও বলা হয় নি!
খালি হাতে বাড়িতে ফিরে ছেলেটার চোখের দিকে তাকাতে পারবো না! বড়ো মানুষ হলেও বুঝিয়ে দেওয়া যেত কিন্তু বাচ্চা মানুষকে কেমন করে বোঝাই? লজ্জায় চোখে জল যেমন আসলো তেমনি গাড়ির নিচে ঝাঁপ দেয়ার জন্যেও সাহসও এলো!
সাহস করে ঝাঁপ দেয়ার মুহূর্তে পেছন থেকে এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক আমার কাঁধে হাত রেখে বলেন, "এই যে একটু শুনুন!"
পেছন ফিরে দেখলাম ভদ্রলোকের গায়ে সাদা চেক শার্ট, শার্টের হাতা গোটানো, সুঠাম দেহ, দারুণ একটা পারফিউমের গন্ধ আসছে তার থেকে ভেসে! সাদা পাকা চুলের মানুষটা বললেন, "আসুন চা খাই! ঝাঁপ পরেও দিতে পারবেন, রাস্তাতো আর ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে না!"
অবাক হয়ে ভদ্রলোককে দেখলাম! উনি জানলেন কিভাবে আমি ঝাঁপ দেবো?
ভদ্রলোক বললেন, "অবাক হচ্ছেন? তা এটা স্বাভাবিক! আমার জানার কথা না আপনি বাসের নিচে ঝাঁপ দেবেন! তবুও কেন জানি না, আমার মনে হলো আপনি ঝাঁপ দেবেন! আসুন, চা খেতে খেতে গল্প করি! এক্সাইড মোড়ে সিগন্যালের এই মালাই চাটা হেব্বি কিন্তু!"
চা হাতে নিয়ে ভদ্রলোক বললেন, "বছর পঁচিশ আগে আমিও আপনার মতন অবস্থায় পড়েছিলাম! লজ্জায় আমিও গাড়ি খুঁজছিলাম ঝাঁপ দিতে! আচ্ছা আপনি ঝাঁপ দিলেন, তারপর? মারা গেলেন কিন্তু এরপর? আপনার পরিবারের কী অবস্থা হবে? মানে আপনার লাশ পোড়ানোর পয়সা কী আছে? সেটা থাকলে ছোট্ট ছেলেটার পাঞ্জাবী কেনাই হয়ে যেত, তাই না? পরে আরেক বিপদ হবে আপনার লাশ পোড়ানোর জন্যে মানুষের কাছ থেকে টাকা ওঠানো! সেটা আরো লজ্জার হবে তাই না? আবার ধরুন গাড়ির নিচে পড়লেন কিন্তু মরলেন না কিন্তু হাত পা কিছু ভেঙ্গে পড়ে আছেন তখন চিকিৎসা করবে কে? খরচই বা কোথায় পাবেন? বা কাজকর্মই বা করবেন কিভাবে?"
ভদ্রলোক কী করে জানলেন আমার ছেলের একটা পাঞ্জাবী লাগবে, ভাবতেই বললেন, "শুনুন! আমার ছেলেরও পাঞ্জাবীর জন্যেই আমি ঝাঁপ দিচ্ছিলাম সেদিন গাড়ির নিচে! লজ্জা লাগছিলো এই ভেবে একটা পাঞ্জাবী ছেলেকে কিনে দিতে পারবো না? তখন আমাকেও কেউ একজন থামায়! কে থামায় একদিন আপনিও বের করতে পারবেন। যান যান বাড়িতে যান! ছেলেকে বোঝান যে, এক পুজোতে পাঞ্জাবী গায়ে না দিলে কিচ্ছু হবে না! বেঁচে থাকুন! বেঁচে থাকলে পুজোর শপিং প্রতিদিন করতে পারবেন পরিবারের জন্যে! বেঁচে থাকাটা উপভোগ করুন! বেঁচে থাকাটা অনেকে আনন্দের! যান যান বাড়িতে যান! আর তারপরেও যদি মনেহয় আপনার স্বাধীনতা আছে ঝাঁপ দেওয়ার ব্যস্ত নগরীতে গাড়ির অভাব নেই!"
ভদ্রলোক চলে যাচ্ছেন! ভদ্রলোককে কেমন যেন খুব চেনা চেনা লাগছে আমার! তার সাথে আমার খুব গভীর সম্পর্ক আছে কিন্তু সেটা কী, তা আমি জানি না! আমার কাছে সব কিছু কেমন স্বপ্নের মতন হচ্ছে! ঘোরের ভেতর আছি আমি!
আমি বাড়িতে ফিরি! ছেলে দৌড়ে এসে দরজা খুলে বলে, "বাবা, পাঞ্জাবী এনেছো?" তাকে জড়িয়ে ধরে বলি, "একদিন একটা পাঞ্জাবীর দোকান কিনে দেবো তোমাকে! আমি বাঁচি! আমি বাঁচলে তোরাও বাঁচবি!"
আমার ক্লাস টুতে পড়া ছোট্ট ছেলেটা এখন ডাক্তারি পড়ছে! আমি যে খুব বড়োলোক হয়ে গেছি তা না, তবে সচ্ছল হয়েছি অনেক! বোনটার বিয়ে দিয়েছি। আমার বাবা রোজ সকালে উঠে বাজারে যান, বাড়িতে এসে বারান্দায় চা হাতে কাগজ আর পত্রিকা পড়েন আর সংসার চালান আমার মা আর আমার গিন্নি! ছেলেমেয়েদের স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আমি কাজে যাই!
প্রায়শই আমি আমার অতীতের কথা ভাবি! প্রায় আমাকে সেদিন গাড়ির নিচে ঝাঁপ দিতে বাধা দেয়া মানুষটার কথা ভাবি! কে ছিলেন তিনি? আয়নার সামনে মাঝেমাঝে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখি! আমি দেখতে ঠিক সেই মানুষটার মতন এখন! একদম সেই মানুষটাই আমি!
সাদা চেক, শার্টের হাতা গুটিয়ে দামী পারফিউম মেখে আয়নার সামনে দাঁড়াই, প্রায় সেই মানুষটাকে দেখতে! আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি না হাসলেও আয়নার ভেতরে থাকা মানুষটা হাসে! হেসে হেসে বলে, "কী দেখলেনতো, বেঁচে থাকাটা কত আনন্দের?"
মাঝেমাঝে ভাবি, ভবিষ্যতের আমিই কী সেদিন আমাকে বাঁচাতে অতীতে ফিরে গিয়েছিলাম, নাকি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো আমার বোধ?
©উshaস চttopaধ্যায়~
Labels:
Literature,
Short Story
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment