'সুইসাইডাল বক্স'
উষস চট্টোপাধ্যায়
পর্ব : ৬
_____________________
ব্যালকনি তে বসে ফেসবুক স্ক্রলিং করছিলো রিমা৷ আবার ঐ গ্রুপটা চোখের সামনে পড়ে তার৷ রিমা মোবাইলটা বন্ধ করে রাখে৷ এই গ্রুপটা দেখলেই তার অস্বস্তি হয়, মনে হয় সবাই ওর মনের কথা বুঝে ফেলেছে! সবাই বোধহয় সবটা জানে!
রকিং চেয়ারে বসে দোল খেতে খেতে রিমা চোখ বন্ধ করে ফেলল; তারপর মনে মনে ভাবতে থাকে সে আসলে ঠিক কী কারনে সুইসাইড করতে চায়! সে ভীষণ একা, বাবার স্নেহবর্জিত ... এটাই কি একমাত্র কারন? না, এর সবচেয়ে বড় কারন অপরাধবোধ৷ একটা গোপন পাপে পাপী রিমা৷ নিজেকে তাই নিজেই ক্ষমা করতে পারে না সে ...যতবার ঐ দূর্ঘটনার কথা মনে পড়ে, ততবার রিমার নিজেকে সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে এই পৃথিবী থেকে৷ ব্যাপারটা কি ভোলার চেষ্টা রিমা করেনি! করেছে...বহুবার করেছে... কিন্তু আজ অবধি পারেনি, আজকাল রিমার মনে হয় পারবেও না৷
শৌভনিক .... ফর্সা, গোলগাল মুখ, বড় বড় কবিতা বলা চোখ ..কোঁকড়া চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ .. আচ্ছা এমন একটা ছেলের প্রেমে পড়া কি খুব অন্যায় ছিলো! শৌভনিকের প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছিলো রিমা .. আর শৌভনিক! সে ছিলো সমাপ্তির প্রেমে অন্ধ৷ দুজন ছিলো কলেজের সবচেয়ে পরিচিত জুটি৷ বেশ মানাতো দুজনকে৷ সবার প্রিয় ছিলো ওরা, শুধু রিমা বাদে! রিমা সহ্য করতে পারতো না ওদের .. অসহ্য লাগতো রিমার! তারপরেও সহ্য করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো৷
কিন্তু, সেদিন যখন লাইব্রেরির পেছন দিকটাতে শৌভনিকের বুকের মধ্যে লতার মতো করে লেপ্টে থাকতে দেখলো সমাপ্তি কে, সেদিন নিজেকে আর কনট্রোল করতে পারেনি রিমা! যে গল্পটায় তার হবার কথা সে ভেবে আসছে শয়নে-স্বপনে, সেই গল্পের নায়িকা যখন অন্য কেউ হয় তা ঠিক কতক্ষন সহ্য করতে পারা যায়? যারা সহ্য করতে পারে তারা বোধহয় মহান মানুষ, রিমা সাধারন মানুষ, সে মহান হতে চায়না৷ রিমা পারেনি ...
অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে রিমার৷ ভয়াবহ সেই গোপন পাপের স্মৃতি রিমাকে বাঁচতে দিচ্ছে না৷ নিজেকে নোংরা মনে হয় ওর .. আচ্ছা তার কি ঐ সুইসাইডাল বক্সটা দরকার? এর আগেও সে চেষ্টা করেছে কয়েকবার, সফল হতে পারেনি, এই সুইসাইডাল বক্স কি তাকে নিশ্চিত মৃত্যু দিতে পারবে! সেখান থেকেও তাকে ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসতে হবে না তো?
******
ছোট্ট একটা ফুলের মতো ফুটফুটে মেয়েকে নিয়ে মিতালী গোস্বামী দেখা করতে এসেছেন৷ এ বয়সের মেয়েরা হবে ছটফটে ফড়িং এর মতো, অথচ মিতালী-র কন্যাটি বড্ড বেশিই চুপচাপ৷
আমাকে দেখে মিতালী বললেন
—আপনিই কি আঁধার?
—আজ্ঞে হ্যাঁ
—ও.. আপনার আসল নামটাকি বলা যাবে?
—আমার ডাক নাম রণি৷ আপনি আমাকে রণি বলে ডাকতে পারেন ..
—আচ্ছা৷ আমার বক্সটি কি এনেছেন? আমি টাকা নিয়ে এসেছি..
—আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই ৷ আপনি যদি আমাকে ভাই ভাবেন, আমি কি কথাগুলো আপনাকে বলতে পারি.. যদি আপনি অভয় দেন তবেই..!
—ভাই ভাবলে আর আপনি বলছো কেন? তুমি বলো৷ আর তুমি আমার বেশ ছোটই হবে৷ আমি বেশিক্ষন কাউকে আপনি আজ্ঞে করতে পারিনা৷
—বেশ দিদি, আমি আসলে কোন সুইসাইড বক্স বিক্রি করি না৷ আমি চেষ্টা করি মানুষদের সুইসাইড থেকে ফেরাতে৷ টাকার কথাটা বলি যাতে মানুষ কিছুদিন সুইসাইডের চিন্তা বাদ দিয়ে টাকার চিন্তায় থাকে৷ তুমি বলো ..এই কটাদিন তোমার মাথায় কোন চিন্তাটা ছিলো?
—টাকা জোগাড়ের চিন্তা.. কিন্তু রণি, আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম! তুমি এভাবে আমাকে ঠকালে?
—দিদি, আমার কথাটা শেষ করতে দাও প্লিজ৷ তারপর যা বলবে আমি মাথা পেতে নেবো ..
—বলো, কত মানুষের কত কথাই তো শুনলাম! তুমিও বলো না হয়..
—আমি সাধারণত কোন কেস সল্ভ করার জন্য তার আপনজনদের সাহায্য নিই, কিন্তু এইবার আমি আমার সেই পুরোনো পদ্ধতিতে কাজ করতে পারিনি৷ দিদি, আমি খুঁজে পেতেও তোমার কোনও আপনজন খুঁজে পাইনি৷ কিন্তু দিদি, তোমার এই ছোট্ট শান্তু টুনটুনিটার আপনজন খুঁজে পেয়েছি, যে ওকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে, যে ওর পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে পারে ..
— ক.. কে, কে!
—দিদি, তুমি!
—হা হা হা ! রণি, হাসালে তুমি আমাকে .. ঠাট্টা করছো তুমি আমার সাথে?
—না মিতালী দি, ঠাট্টা আমি করি না .. যা বলছি ভেবেই বলছি৷ দিদি, মেয়ের জন্য ঢাল হয়ে তোমাকেই দাঁড়াতে হবে৷ একটাবার চিন্তা করে দেখো ... এই নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে তুমি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে? একটাবার যুদ্ধের চেষ্টাও করবে না?
—আমার কী করার আছে রণি!?
—আমি ভেবে রেখেছি৷ বলছি .. শোনো, তোমার হাতে আছে দশহাজার টাকা৷ প্রথমে তুমি মামনিকে নিয়ে ঐ বাড়িটা ছাড়বে৷ একটা ভাড়া বাড়ি আমি দেখে রেখেছি৷ একটা বয়স্ক দম্পতি থাকে৷ একটা রুম ভাড়া দেয়৷ সুন্দর রুম, রুমের সাথে বাথরুম আর বারান্দা আছে৷ ভাড়া তিনহাজার টাকা প্রতিমাসে৷ ওনারা এক মাসের ভাড়া এডভান্স রাখেন৷ কিন্তু আমি ওনাদের বুঝিয়ে দু'হাজার এডভান্সে দেবো বলেছি৷ এরপর তোমার কাছে থাকলো আট হাজার টাকা৷ এর ভেতর থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তুমি কাপড়ের ব্যবসা শুরু করবে৷ কিছু কাপড় এনে তাঁতীদের থেকে আরো ছবি নিয়ে আসবে৷ অনলাইন প্লাস অফলাইনে বিভিন্ন স্কুলের সামনে গিয়ে গার্জিয়ানদের কাছে বিক্রির চেষ্টা করবে৷ আমরা প্রথমেই নেবো একদম কমের মধ্যে বাটিক, ব্লক, স্ক্রিন প্রিন্টের থ্রিপিস৷ লাভও রাখবো খুব সীমিত৷ এগুলো এখন বেশ ভালো চলে৷ আমি সব খোঁজ খবর করে এনেছি৷ ছ'টা মাস তুমি শুধু আমাকে বিশ্বাস করো, দেখো ...তারপরও কিছু না হলে তুমি যা বলবে মাথা পেতে নেবো৷
—যত সহজে বললে, এত সহজে কী সম্ভব!
—নিশ্চয় সম্ভব৷ এখন ওঠো, তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো৷
—কোথায়?
—আমাদের বাড়িতে৷ আমার মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে৷
আমার মা মিতালী গোস্বামী-র জন্য অপেক্ষা করে আছেন৷ মা এতকিছু জানেন না৷ মা কে শুধু বলেছি, "একজন বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করছি মা, তুমি পাশে থেকো৷"
মিতালী দির মেয়ের নাম মৌলি, ডাকনাম তোতন! আমার মায়ের সাথে তোতনের বেশ ভাব হয়ে গেলো৷ আমাদের বাড়ির কাছেই মিতালী দিদির জন্য বাড়ি দেখেছি৷ তাকে সেই বাড়িও দেখিয়ে আনলাম ... তারপর দিদি একসময় চলে গেলেন ... যাবার সময় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন "বসার ঘরের ছবিটা কি কম্পিউটারে ফটোশপ করেছো? একই মুখ খালি ছেলে আর মেয়ের তফাৎ.. দারুণ হয়েছে... মনে হচ্ছে পাশাপাশি দুটো জেন্ডারে তুমি!"
আমি বললাম "দিদি, ওটা আমার জমজ বোনের ছবি৷ ও দু'বছর আগে সুইসাইড করেছে৷ ওর জন্যই আমি আঁধার! ওর মৃত্যু ঠেকাতে পারিনি, তাই চেষ্টা করে যাই যতটা সম্ভব মানুষের সমস্যার সমাধান করতে ..."
মিতালী দি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, "রণি, তুমি পারবে ..নিশ্চয় পারবে ... আগামীকাল আমি চলে আসবো৷ সকাল সকালই চলে আসবো৷ পাশেই থেকো আমার৷ তুমি থাকলে তোতনের ভার আমি নিতে পারবো, তোতনের ঢাল আমিই হতে পারবো...ভগবান চাইলে ঠিক পারবো .."
আমাকে জড়িয়ে ধরলেন মিতালী দি৷ আমার আবার মনে হলো আমাকে জড়িয়ে ধরেছে তিতলী!
আচ্ছা ওপারে বসে কী তিতলী দেখতে পায়, আমি, মা, আমরা যে সারাটাক্ষন ওকে মিস করি! পাগলের মত মিস করি!
*******
রিমার বাবা গেছেন দেশের বাইরে৷ তার কি নাকি জাহাজে কোন সমস্যা হয়েছে, সেই জাহাজের পেছনেই ছুটেছেন তিনি৷ রিমা আজ এসব চিন্তা বাদ দিয়ে একটু মন ভালো করার চেষ্টা করছে৷
মায়ের আলমারি খুলে একটা লাল শাড়ি বের করে রিমা৷ তারপর রান্নাঘরে গিয়ে রাঁধুনি কে বলে আসে ভালো করে কষিয়ে মাংস, মুগের ডাল আর ভাত রান্না করতে৷ সাথে টমেটোর চাটনি৷ বলে এসে নিজের ঘরে না গিয়ে মায়ের ঘরেই ঢোকে৷ মায়ের ঘরটা এখনও আগের মতই আছে৷ মায়ের ড্রেসিং টেবিল, তার সাজ-গোজের জিনিসপত্র .. অবশ্য সাজগোজের জিনিস বলতে শুধু কয়েকটা কাজল, আর একটা হালকা কালারের লিপস্টিক৷ এসবের এক্সপায়ারি থাকার কথা না, তবু.. রিমা জানে, আনোয়ারা তার আশেপাশেই আছে, তাই আনোয়ারা কে ডেকে তার ঘর থেকে তার কাজল আর লিপস্টিকটা আনতে বলে৷ আজ সে মায়ের মত করেই সাজবে ..
সময় নিয়ে সাজে রিমা৷ সুন্দর করে শাড়ি পড়ে, চোখে কাজল দেয়, ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক দেয় ...তারপর মুগ্ধ হয়ে নিজেকে দেখে সে৷ ওর বেশ ভালো লাগতে থাকে৷ এভাবে সেজেগুজেই দীর্ঘদিন পর সে ডাইনিং টেবিলে বসে নিজের সব পছন্দের খাবার তৃপ্তি করে খায়৷
তারপর ঘরে এসে নিজেকে এলিয়ে দেয় বিছানায় ....
ঠিক তখন ওর মনে হয় শাড়িটা জঞ্জাল লাগছে ...শাড়ি খুলে একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার পরে ফেলে সে৷ তারপর আবার ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে ... এই রিমা একটু আগে আনন্দে থাকা রিমা না..বরং এ সেই পুরোনো ডিপ্রেসড রিমা..
সাজ-গোজ বা খাওয়া-দাওয়া ডিপ্রেশন কমায় না৷ যখন কাউকে বলা হয় খুব মন খারাপ হলে আপনি কি করেন? বেশিরভাগ মেয়েই উত্তর দেয়, আমি তখন সাজি, বা আমি তখন খাই ... এসবই আসলে নিজেই নিজেকে বোকা বানানো, ধোঁকা দেওয়া৷ সাময়িকভাবে নিজেকে ডাইভার্ট করা৷ কিন্তু পরিপূর্ন সমাধান এটা নয়৷ আসলে আমরা ক'জনই সমস্যার পরিপূর্ন সমাধান চাই! আমরা বোধহয় দুঃখবিলাস করতেই বেশি ভালোবাসি ....
চলবে..
#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #ষষ্ঠ_পর্ব