Tuesday, 23 November 2021
পুতুলদের সংসার!
পুতুলদের সংসার:
(এক প্রায় ৪০ বছর বয়সী বাবা আর তার ৬ বছরের ছেলের কথোপকথন। তারা প্রায় দিনের মতো সেদিনও বিকেলে বেড়াতে বেরিয়েছে, একথা-সেকথা বলতে বলতে তাদের খিদে পেয়ে গেল। তখনই ছেলে বাবাকে জিজ্ঞেস করে...)
-বাবা, আজকে আমরা কি দিয়ে ভাত খাবো?
-আজকে আমরা ইলিশ দিয়ে ভাত খাবো বাবা!
-ইলিশ মাছ? (উদগ্রীব হয়ে ওঠে সে, কিন্তু পরমুহূর্তে থিতিয়ে যায় উত্তেজনা) তুমি না বলেছো ইলিশ মাছে অনেক কাঁটা বাবা? আমি কি কাঁটাওআলা মাছ খেতে পারব বাবা?
-কাঁটা হলেই বা কী! আমি তোকে মাছ বেছে দেবো বাবা!
ছেলেকে মাছ বেছে দেয়ার কথা বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো শ্যামল বাবু! কারণ তিনি শত চেষ্টা করেও ছেলেকে মাছের কাঁটা বেছে দিতে পারবেন না! তিন বছর আগে এক এক্সিডেন্টে তার দুই হাত হারিয়ে এখন প্রায় অচল সে! নিজের এই অসহায় জীবন তার দিনে দিনে খুব অসহ্য হয়ে উঠছে আর তার পা কাটা না থাকলেও খুব একটা শক্তি তার দুই পায়ের একটাতেও এখন আর নেই। নাহলে কবে সে এই জগত সংসারের মুখে লাথি মারে!...
-বাবা সত্যিতো, ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাবো? তুমি রোজ মাছের কথা, মাংসের কথা বলো, কিন্তু মাছ মাংস আর খাওয়াও না। সেদিন বললে মাংস দিয়ে ভাত খাবো; আমি সারাদিন হাত ধুয়ে বসেই ছিলাম আর মা খালি ডাল দিয়ে ভাত খাইয়ে দিলো! আজকে যদি মাছ না খাওয়াও আমি কিন্তু ভাত খাবো না, সত্যিই ভাত খাবো না বাবা!
শ্যামলের হাত না থাকলেও, পা দুটো প্রায় অবশ হলেও চোখ দুটো কিন্তু ঠিক সচল! ছেলেটার কথা শুনলে শ্যামলের সেই সচল চোখ সব সময় ভিজে ওঠে! তার কষ্ট আরো বাড়ে যখন এই চোখের জল ছেলেকেও দেখাতে হয়! আর বুকটা ফেটে যায় যখন তার ছয় বছরের ছেলেটা তার ছোট ছোট হাতে বাবার চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, 'বাবা ইলিশ মাছ ভালো না, আমি মাছ খাবো না বাবা! মাছে খালি কাঁটা ভরা! আমি আর মাছ খাবো না বাবা!'
তবে আজ ইলিশের ব্যবস্থা তার ঘরে হবে! কারণ আজ তার ঘরে অতিথি এসেছে! ঘরে অতিথি আসলে শ্যামল ছেলেকে নিয়ে ঘর থেকে অনেক দূরে কোথাও চলে আসে।
প্রায় সময় ছেলেটা তাকে প্রশ্ন করে, বাবা বাড়িতে ওরা কারা আসে, কেন আসে? সে উত্তর দেয়, বাড়িতে অতিথিরা আসে! তাদের কাজ থাকে মা-র সাথে।
-বাবা অতিথিদের সাথে আমরা দেখা করি না কেন?
-আমি পঙ্গু মানুষ যে বাবা। তাই অতিথিদের সামনে যাই না বাবা। লজ্জা করে! আমার না গেলেই ভালো...
-আমিওতো, অতিথি দের সাথে দেখা করতে যাই না বাবা!
-তুমি আমার সঙ্গে না থাকলে আমি গল্প করবো কার সাথে বাবা? তাই তোমাকে আমার সাথে নিয়ে আসি।
আজ ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে একটু বেশি দেরি হয়ে গিয়েছে শ্যামলের। ঘরে এসে দেখে পুতুল রান্না ঘরের চুলায় রান্না চাপিয়েছে। খুব ইচ্ছা করছে কাছে গিয়ে একটু কথা বলতে, কী রান্না চাপিয়েছে একটু দেখতে! কিন্তু যেদিন ঘরে অতিথি আসে সেদিন পুতুলের মন মেজাজ খুব খারাপ থাকে। অল্প কথায় রেগে যায়। এমনি অবশ্য সে খুব ভালো মেয়ে। নাহলে এত কষ্টের সংসারে কেউ থাকে? কার এত ঠেকা পড়েছে ল্যাংড়া, পঙ্গু লোকের সাথে ঘর করার?
ঘরের মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে পুতুল ভাতের প্লেট রাখতে রাখতেই তার ছেলে জেনে গিয়েছে আজ তাদের বাড়িতে ইলিশ রান্না হয়েছে! সেই আনন্দে ছেলেটা ছটফট করছে! বারেবারে হাত ধুতে যাচ্ছে আর আসছে সে। ছেলের ছটফটানি দেখে পুতুল একটা ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেলো। দু'দিন আগে ছেলেটা জ্বর থেকে উঠেছে, একটু ভালো মন্দ যে ছেলেটাকে খাওয়াবে সেই অবস্থা পুতুলের সংসারে নেই। অতিথি আসলে তার মন মেজাজ খারাপ থাকলেও আজ সে একটু খুশি কারণ আজ সে কিছু টাকা বেশি পেয়েছে। সেই টাকাতেই ইলিশ কিনে আনা হয়েছে। যদিও এই ইলিশ খাওয়ার মত বিলাসিতার ফল অনেকদিন তাকে ভোগ করতে হবে সে জানে। তবুও ছেলেটা একটু পেট ভরে ভাত খাক আজ!
পুতুলের ছেলেটা হাত ধুয়ে আসলেও সে তার মায়ের হাতেই ভাত খাচ্ছে। একটা মাছে এত কাটা থাকে যে কিভাবে সে ভেবেই পাচ্ছে না। তার মধ্যে তরকারিটাও হয়েছে ঝাল! তার মা এক দলা ভাত মুখে দেয় আর সে একটু করে জল খায়! যদিও সে ভেবেছিল লঙ্কা খাবে ভাত দিয়ে, তাই হাতে একটা কাঁচালঙ্কা নিয়েছিল সে, কিন্তু তরকারি যে এমন ঝাল হবে বোঝেনি সে, তাই লঙ্কাটা হাতেই রেখে দিয়েছে।
শ্যামল চুপচাপ দূরে বসে ছেলের খাওয়া দেখছে। ছেলের খাওয়া শেষ হলেই পুতুল তাকে ভাত বেড়ে খাইয়ে দেবে। ছেলেটার এত আরাম করে খাওয়া দেখে তার খিদেও বেড়ে যাচ্ছে। পুতুলেরও খিদে পাওয়ার কথা, কাল রাতে ভাত খায় নি সে। খিদেতো লাগারই কথা। খুব ইচ্ছা করছে পুতুলকে বলতে, চলো, এই প্লেটেই ভাত আরেকটু বেশি নাও, আমরা তিন জনেই এক সাথে খাই! তবুও বলতে গিয়ে চুপ হয়ে গেলো সে। যদি রাগ করে কিছু বলে বসে পুতুল? ঘরে অতিথি আসলে মেয়েটার মন মেজাজ একটু বেশি খারাপ থাকে! এছাড়া অবশ্য সে খুব ভালো মেয়ে। নাহলে কার এত ঠেকা পড়েছে ল্যাংড়া, পঙ্গু লোকের সঙ্গে সংসার করার?
আধুনিকতা থেকে দূরে, বহু দূরে এক গ্রামে পুতুলের সংসার। সে গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ ঢোকে নি, তাই সূর্য ডোবার পরে কুপির আলোতেই আলোকিত হয় পুতুলদের সংসার! সেই আলোতে অতিথি আপ্যায়ন করতে করতে ক্লান্ত ঘামে ভেজা পুতুলের ঝলমলে মুখটা দেখে শ্যামলের খুব ইচ্ছা করে পুতুলের মুখটা একটু মুছে দিতে! আর তা ভাবতে ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে!..
©উshaস চttopaধ্যায়~
Labels:
Literature,
Short Story
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment