Sunday, 10 September 2023

'সুইসাইডাল বক্স' (৩য় পর্ব)


সুইসাইডাল বক্স 

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ৩

_____________________


ছ'ফুট লম্বা, ভীষণ সুদর্শন অলির সেই স্বামী লোকটির মানসিক বিকারের নাম sexual sadism disorder.. যে মুহূর্তটি আনন্দের হওয়ার কথা ছিলো লোকটি তা অলির জন্য চরম ভীতিকর মুহূর্তে পরিনত করেছিলো৷ অলি যখন আমাকে কথাগুলো বলছিলো আমি ভেতর ভেতর শিউরে উঠেছি! লোকটি রাতে ব্লেড নিয়ে শুতে যেতো৷ শারীরিক মিলনে অলিকে বাধ্য করতো.. সেই সময়ে ব্লেড দিয়ে আঁচড় দিতো ওর গায়ে৷ অলি যত যন্ত্রনায় চিৎকার করতো লোকটা তত বেশি আনন্দ পেতো, অনেকটা ব্রেন অরগাজমের মতো ব্যাপারটা৷ প্রথমবার যখন অলির সাথে দেখা করলাম, আমাকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে৷ আমি একটা অনলাইন গেমের অপারেটর, যার উদ্দেশ্য সুইসাইডাল বক্স বিক্রি করা এটা একজন শিক্ষিত, বুদ্ধিমতী, ডাক্তার মেয়েকে বিশ্বাস করাতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়েছে, কিন্তু বিশ্বাস না করাতে পারলে আমার সাথে ওর দেখা করাটা সম্ভব হয়ে উঠছিলো না৷ আর যে কথাগুলো চোখে চোখ মিলিয়ে সহজে বোঝানো যায় তা কিন্তু ম্যাসেঞ্জারে বা গেমের চ্যাটবক্সে টাইপ করে বোঝানোটা সম্ভব না৷ আর সুইসাইডাল বক্সের এই নাটকটা আমি কেন করি সেটাও বলি৷ "..ধরে নিন কাউকে কিছু একটা আমি করতে বারন করবো, তাতে কি হবে জানেন? তাতে তার ঐ জিনিসের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাবে৷ নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষন আমাদের সব্বারই থাকে৷" 


আমার ধারনা, সুইসাইড যে করতে চায় তাকে যত ভাবেই বোঝানো হোক ওটা মহাপাপ, ওটা ভালো না, ওটা কোন সমাধান নয়.....দিনের শেষে এসব কোন কথাই তাদের কানে ঢুকবে না৷ কষ্টগুলো এতটাই লাগাম ছাড়া হয় যে এসব নীতিকথা, জ্ঞানের কথা, সেই কষ্টের কাছে ভীষণ তুচ্ছ মনে হয়৷ তাই যখন এমন কাউকে আমি বলি যে, আমি তোমাদের কাছে এমন একটা কিছু বিক্রি করবো যা তোমাদের মৃত্যু সহজ করে দেবে, তখন ঐ হতাশায় ভোগা মানুষগুলো উৎসাহ পায়৷ দামটাও খুব-একটা কম রাখিনি, দশ হাজার খুব ছোট অ্যামাউন্ট নয়৷ দশ হাজার টাকা জোগাড়ের জন্য বেশিরভাগ মানুষকেই ভাবতে হয়৷ অনেক বড়লোক মানুষ যারা তাদের ব্যাপার আলাদা; কিন্তু মধ্যবিত্ত মানুষগুলো তখন মৃত্যুর চিন্তা একপাশে সরিয়ে টাকার জন্য চিন্তা শুরু করে৷ টাকার জন্য চিন্তা, টাকা জোগাড়ের উপায় খুঁজে বের করা মৃত্যুর চিন্তার চেয়েও কঠিন৷ আমি এই সময়টাকেই কাজে লাগাই৷ মরতে চাওয়া মানুষটার ঠিকুজি-কুষ্ঠি, এককথায় আদ্যপান্ত খুঁজে বের করি৷ খুঁজে বের করি মানুষগুলোর আপনজন কারা... ভালোবাসার মানুষ কারা... কে দিতে পারবে একটুখানি মমতার পরশ৷ একটুখানি মমতার পরশ আর মাথার উপর রাখা ভরসার হাত যে এমন কু-চিন্তা মুহূর্তেই উড়িয়ে দিতে পারে, আর কোনোকিছুই এ ব্যথার মলম নয়, জগতের সকল ব্যথার মলম একটুখানি ভালোবাসা ...


অলি আমার সাথে দেখা করতে এলো৷ প্রথমেই অবাক হয়ে বললো  "আপনি একজন ছেলে..? আমি আশা করেছিলাম মহিলা!" আমি শুধু হেসেছিলাম, আর বলেছিলাম, "আমার নাম আঁধার.." আর কিছু বলিনি৷ সবাই এমন কেন ভাবে আমি জানি না, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম সাক্ষাতে আমাকে এই কথাটিই বলে৷ প্রথমে ইতস্তত বোধ করছিল বোধহয়, কিছুক্ষন কথা বলার পর ও খানিকটা সহজ হলো৷ ফুলস্লিভ হাতার জামা পরে এসেছিলো অলি৷ আমাকে জামার হাতা তুলে দেখালো দগদগে নতুন ঘা..! আমি ওর ফর্সা হাতে ব্লেডের ক্ষতগুলো দেখে রীতিমতো কেঁপে উঠেছিলাম৷ আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠেছিলো সে সময়৷ আমি প্রসঙ্গ বদলে ওর বাবা-মায়ের কথা জানতে চাইলে অলি নির্বিকার গলায় বললো "তারা আমাকে ত্যাগ করেছে আঁধার, তাদের সামনে দাঁড়াবার সাহস আমার নেই!" এই একটা ভুল সন্তানেরা সবসময় করে৷ তারা জানে না বাবা-মা এমন মানুষ, তারা সন্তানের পাহাড়সম অপরাধ এক নিমেষে ক্ষমা করে দিতে পারে... অলি দশহাজার টাকা বের করে আমার কাছে সুইসাইড বক্সটা চাইলো৷ আমি আমার পুরোনো ট্রিকটা খাটালাম৷ পুরোদস্তুর ব্যবসায়িকের মতো গলায় বললাম, "শিপমেন্টে আটকে আছে.. আসলে এটা তো লিগ্যালি আনার উপায় নেই, চায়না-তে তৈরি হয়৷ ওখান থেকে অনেক কায়দা করে আনতে হয়, তবে সামনের সপ্তাহেই চলে আসবে৷ আপনি অর্ধেক অ্যাডভান্স করে যান৷ আমার ডিলারকেও দিতে হবে তো, এই মুহূর্তে আমার একদম হাতখালি নাহলে অ্যাডভান্স নিতাম না ..." 


এই অ্যাডভান্সটা আমি নিই মানুষদেরকে আরো একটু দ্বিধায় ফেলতে৷ অপরিচিত একজন মানুষকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে নিশ্চয়ই কেউ নিশ্চিন্তে থাকবে না৷ তার মাথায় তখন সুইসাইডের চিন্তার পাশাপাশি ঘুরবে আরেকটা চিন্তা ...টাকার চিন্তা .... এতগুলো টাকা একজন অপরিচিত মানুষকে দিলো, টাকাটা মার যাবে না তো! জিনিসটা পাবে তো! 


আমি অলির হসপিটাল থেকে খুঁজে বের করলাম ওর আরেকজন কাছের মানুষ ডাঃ ঋতু কে৷ ডাক্তার ঋতু-র সাহায্য নিয়ে খুঁজে বের করলাম অলির বাবা-মায়ের ঠিকানা ... 


আন্টি আঙ্কেলের সামনে গিয়ে অলির কথা বলতেই আঙ্কেল দৃঢ় গলায় জানালো, "এই বাড়িতে ঐ মেয়ের নাম নেওয়া নিষেধ ...তুমি চলে যাও ..." আমি আঙ্কেলের হাত ধরে ফেললাম৷ আঙ্কেলের হাত ধরে বললাম, "আঙ্কেল, আপনাদের মেয়েটা ভীষণ কষ্টে আছে... ওর স্বামী ওকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছে.. আপনাদের মেয়েটা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছে, সুইসাইড করবে যেকোন সময়!" পাশে দাঁড়িয়ে আন্টিও কাঁদছিলেন! এবার আঙ্কেলও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন৷ তারপর তাদের বুঝিয়ে বললাম পুরো ব্যাপারটা... তাদের রাজী করালাম আমার সাথে গিয়ে অলির সাথে দেখা করতে ..


অলিকে খবর দিলাম 'সুইসাইডাল বক্স' চলে এসেছে বলে৷ অলি চলে এলো নির্দিষ্ট সময়ে৷ আমি আর এবার সামনে গেলাম না, আন্টি-আঙ্কেলকে পাঠালাম ... তাদের দেখে অলি প্রথমে খানিকটা ঘাবড়ে গেলো৷ তারপর আঙ্কেল যখন জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন এক মুহূর্তের মধ্যেই যেন বরফ গলে গেলো৷ তখন আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম অলির৷ তারপর অলির হাতে সেই অ্যাডভান্স হিসেবে নেওয়া পাঁচহাজার টাকা দিয়ে বললাম, "অলি, জীবনটা যতই জঘন্য হোক.. নিজের জন্য বাঁচো, বাবা-মায়ের জন্য বাঁচো ... গ্রুপ থেকে লিভ নিও৷ ঐ গ্রুপ আর তোমার দরকার নেই ... এ ব্যাপারে আর কারও সাথে, কোনও কথা বলবে না প্লিজ..." 


আমি চলে আসছিলাম, এমন সময় অলি দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো "আঁধার, আমি মা-বাবার একমাত্র সন্তান, কিন্তু তোমার মধ্যে আজ আমার দাদা বা ভাইকে পেলাম, ভালো থেকো..." আমার তখন মনে হলো আমার তিতলী আমাকে জড়িয়ে ধরেছে, আমার ভীষণ কান্না পেয়ে গেলো.. কিন্তু আমি কাঁদলাম না, কাঁদলে দুঃখ কমে যায়৷ আমি তো এই দুঃখ, এই শোক কখনোই কমাতে চাই না৷ এই শোক থাকুক, না হলে আমি অন্ধকারে থাকা তিতলী দের আঁধার থেকে বের করার শক্তি কোথায় পাবো! 


মিতালী গোস্বামী-র খোঁজ নিলাম৷ ভদ্রমহিলার সত্যিই কেউ নেই৷ নেই নিজের বলতে কেউ, কোন আপনজন৷ কেউ নেই অলির বাবা-মায়ের মতো তার হাত ধরার ... আমি এবার চিন্তায় পড়ে গেছি৷ কি করবো! 


অনেক ভেবে দেখলাম, যতই তার কেউ না-ই থাক, কিন্তু তার বাচ্চাটার তো মা আছে! এই মাকেই হতে হবে এতটা শক্তিশালী যেন সন্তানের ভার সে-ই নিতে পারে৷ শুধু অন্ন-বস্ত্রের জন্য যেন কারো লালসার স্বীকার হতে না হয় ঐ নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে ...


আচ্ছা, দশ হাজার টাকায় কি কোনো ব্যবসা দাঁড় করানো যায় না? নিশ্চয় যায়৷ সেটাই বরং খুঁজি৷ আত্মনির্ভরশীল হতে হবে মিতালী কে৷ হতেই হবে, হতেই হবে !


****-****


রিমার বাবা আজ বাড়িতে আছে, তার আজ ভালো লাগছে৷ একবার বাবার ঘরে ঢুঁ মারলো রিমা৷ মানুষটার সাথে কথা বললে ভীষণ শান্তি পায় রিমা, যদিও কথা হয় না বেশি৷ রিমার বাবা খুবই সল্পভাষী মানুষ; আজও রিমা বাবার কাছে গেলো ৷ 


রিমার বাবা সম্প্রতি দুটো জাহাজ কিনেছেন৷ জাহাজদুটোতে তার ইনভেষ্ট করতে হয়ে বেশ মোটা অংকের একটা টাকা৷ এ দুটো জাহাজের একটা এখন আটকা পড়েছে আটলান্টিক মহাসাগরে৷ ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে অনেক৷ রিমার বাবার প্রেসার বেড়ে গেছে৷ টাকার টেনশন বড় টেনশন! তা সে যত কোটিপতি মানুষই হোক না কেন, টাকার শোক সামলানোর মতো মানসিক শক্তি সবার থাকে না ....


রিমা এসে বসলো বাবার পাশে৷ ভদ্রলোক একটু বিরক্ত হলেন৷ এই মুহূর্তে আটকে পরা জাহাজের চিন্তা ছাড়া তার মাথায় অন্য কোন চিন্তা নেই .. তার কথা বলতেও ইচ্ছা করছে না, আর সবচেয়ে বড় কথা মেয়ের সাথে বলার মতো কোন কথাই খুঁজে পান না .. মেয়েটা বড় হয়ে গেছে৷ মেয়ের সাথে তার মানসিক দুরত্ব বেড়েছে ... এখন হঠাৎ কোন কথা বলতে গেলেই কেন যেন তার মনে হয় কথাটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে৷ বেশ গুছিয়ে তিনি অপ্রয়োজনীয় এলোমেলো কথাগুলো বলছেন৷


রিমার বাবা তাই খানিকটা বিরক্ত গলায় রিমাকে বললেন "মামনি, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি একটু একলা থাকতে চাই এখন..."


রিমা কথা না বাড়িয়ে বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো .... তারপর সোজা চলে গেলো ছাদে৷ ছাদে গিয়ে একদম কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রিমার মনে হলো "আচ্ছা, এখান থেকে লাফ দিলে কেমন হবে? বাবা জানার পর ঠিক কি কি করবে...."


কল্পনায় রিমা স্পষ্ট দেখছে, রাস্তায় উপুর হয়ে পরে আছে তার লাশ ... রক্তাক্ত.... রিমার বাবা বিরক্ত মুখে তার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে আছে...


চলবে..


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #৩য়_পর্ব

Saturday, 2 September 2023

'সুইসাইডাল বক্স' (২)


'সুইসাইডাল বক্স'

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ২

_____________________


গেমের একটা পর্যায় এসে নিজে থেকে চ্যাটরুম অন হয়ে যায়.. সেই সুত্রে একটা ম্যাসেজের আংশিক ছবি!


— হ্যালো, আমি কি 'অন্ধকারের যাত্রি'র সাথে কথা বলছি! আমি সুইসাইডাল বক্সটি কিনতে আগ্রহী ৷


—আপনার নাম?


— প্রোফাইলে যেই নামটা দেওয়া আছে, মিতালী গোস্বামী৷


—প্রোফাইলে তো সবার সঠিক নাম দেওয়া থাকে না, যেমন আমার নিজেরও নেই ৷ যাই হোক, আপনি অ্যানাউন্সমেন্ট পোস্টটি পড়েছেন মন দিয়ে?


— আজ্ঞে হ্যাঁ, পড়েছি .. 


—তাহলে তো আপনি সবটাই জানেন, কি করতে হবে, আর কি করা বারণ, তাই না? 

আচ্ছা বলুন তো, কি কারনে সুইসাইড করতে চান?


— কারনটা কি বলতেই হবে? দেখুন আমার কাছে যেটা যৌক্তিক কারন, আপনার কাছে নাও হতে পারে৷ আর কারন বললেই যে আমি জিনিসটা পাবো তার গ্যারান্টি কি?


—কোন গ্যারান্টি নেই, কারনটা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হতে হবে৷ দেখুন, এটা আমার বিজনেস৷ সবার বিজনেসেরই কিছু রুলস থাকে, আমার রুলস এটাই৷ আপনি বলতে না চাইলে সেটা একান্তই আপনার ব্যাপার, তবে কারন না বললে আমি আপনার সাথে লেনদেন-এ যাবো না৷


— হুম , বুঝতে পারছি..


—বেশ, তাহলে কী ঠিক করলেন? বলতে চান নাকি চান না ..


— আমার বিয়ে হয়েছে বারো বছর আগে, আমার একটা মেয়ে আছে দশ বছর বয়সের৷ 


—তারপর..


— থাক গে, আর বলবো না! আপনাকে বিরক্ত করার জন্য সরি৷


—সরির কিছু নেই দিদি৷ তবে, বলতে না চাইলে বলতে হবে না৷


— আচ্ছা সুইসাইডাল বক্সে কি একসাথে দুজন ঢোকা যাবে? না মানে.. স্পেস কতটা?


—আজ্ঞে... যাবে বলে মনে হয়৷ 


— আমার মেয়েটাকে ওর নিজের কাকা অ্যাবিউজ করছে ... দিনের পর দিন... বাচ্চাটা আমার কেঁদে কেঁদে বলে "মা, আমার ব্যথা করে, আমার খুব কষ্ট হয় .." 


—আপনি এই সত্যিটা জানার পরেও চুপ করে আছেন? ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না!


— আমি বিধবা..  আমার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই৷ এক ভাই আছে, সেও আমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে আমাদের দায়ভার সে নিতে পারবে না৷ তাই আমাকে এ বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে৷ আমি যে কি পরিমান নিঃস্ব, সেটা আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না৷ এই বক্স কেনার টাকা কোথায় পাবো আমি তাও জানি না, তবে কোনো-না-কোনো উপায়ে জোগাড় করে ফেলবো৷ এই কষ্ট সহ্য করে বেঁচে থাকার চেয়ে, মা-মেয়ে মিলে মরে যাওয়াটাই সহজ৷ আমি একা হলে এই ঝামেলায় আসতাম না ... আমার মেয়েটা অলরেডি অনেক কষ্ট পেয়েছে, অন্তত মৃত্যুটা সহজ হোক ওর জন্য!


—কিছু মনে না করলে আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি, মানে আপনি লেখাপড়া কতদূর করেছেন?


— বি.এ. অনার্স পাশ করেছি, রেজাল্ট ভালো ছিলো না, থার্ড ক্লাস পেয়েছিলাম ৷


—রেজাল্ট টা মূখ্য বিষয় না দিদি... আচ্ছা বাদ দিন, আপনি টাকাটা কিভাবে জোগাড় করবেন বল্লেন নাতো, আমি কিন্তু দাম কমাবো না.. ফিক্সড প্রাইস৷


— এখনও ঠিক জানি না, দেখি! কিছু যদি না হয় তো স্বামীর শেষ চিহ্ন হিসেবে একটা চেন আছে সোনার, ওটাই বিক্রি করে দেবো না হয়.. 


—ঠিক আছে৷ আপনি টাকা জোগাড় করে আমাকে নক দেবেন, আজ রাখছি৷ 


— আমি তাহলে সুইসাইডাল বক্সটা পাচ্ছি তো?


—এখনই কনফার্ম বলতে পারবো না, আগে ভেরিফিকেশন করতে হবে, তারপর৷ 


— ঠিক আছে, আমি টাকা জোগাড় করেই আবার নক দেবো না হয়! 


মিতালী গোস্বামী! আমার নতুন তিতলী৷ এটাও কি সম্ভব? দশ বছরের বাচ্চাকে শারিরীকভাবে নোংরা করছে তার আপন কাকা! আর কত কষ্টকর গল্প শুনতে হবে আমাকে... আমার যে ভীষণ কষ্ট হয়, বারবারই মনে হয় আমার তিতলী-র বোধহয় এরকমই কোনও এক কষ্ট ছিলো, যা আমার জানা হয়ে ওঠেনি৷ 


আমার হাতে সময় বেশি নেই৷ আমি জানি মিতালী গোস্বামী খুব তাড়াতাড়ি টাকার ব্যবস্থা করে ফেলবে৷ মরার জন্য টাকার জোগার করতে দেরি হবার কথা নয়৷ অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে৷ যদিও দশ হাজার টাকা খুব ছোট অ্যামাউন্ট ও নয়, তবু মন বলছে দু-তিন দিন লাগবে বড়ো জোর! এর মধ্যেই আমাকে আমার কাজ করতে হবে৷ 


******


রিমার ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যেবেলার দিকে, আকাশটাতে লালচে রঙ ধরতে শুরু করেছে৷ ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দাঁড়াতেই রিমা দেখলো আনোয়ারা দাঁড়িয়ে আছে, চায়ের ট্রে হাতে করে৷ এই মেয়েটাকে মাঝে মাঝে অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা সম্পন্ন মনে হয় রিমা-র৷ রিমার ঘুম ভাঙার পর কখনোই অপেক্ষা করতে হয় না, মেয়েটা গরম-গরম চা নিয়ে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকে৷ 


চা খেতে খেতে রিমা ফোনটা অন করলো, একগাদা নোটিফিকেশন এসেছে তাতে৷ একটা নোটিফিকেশনে চোখ আটকে গেলো রিমার৷ অলি পোস্টেড ইন দি গ্রুপ "সুইসাইডাল বক্স" .. এই অলি কে রিমা জানে না৷ তবে তার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে৷ এই মেয়েটিই তাকে ঐ গ্রুপে ইনভিটেশন পাঠিয়েছিলো৷ ওখানে বলা ছিলো, যাদের দেখে মনে হয় সুইসাইড করতে চায় শুধু তাদেরই ইনভাইট করতে! কিন্তু রিমা অবাক হয় এই ভেবে, যে তার সোশ্যাল লাইফ দেখে তো এটা বোঝার উপায় নেই, যে সে সুইসাইড করতে চায়, এমনকি ও যে অ্যাটেম্পট নিয়েছিলো সেটাও তো পাবলিক করেনি! ফেসবুকে তো রিমা ভীষণভাবে সুখী৷ রিমা অলির পোস্ট চেক করে৷ তিন লাইনে অলি লিখেছে—


"অন্ধকারের যাত্রি-কে চিনেছি বলেই আজ আলোকে চিনতে পারলাম৷ তোমাকে ধন্যবাদ বলে আসলে আমার মনের কৃতজ্ঞতাবোধ প্রকাশ করতে পারবো না, তাই সে চেষ্টাও করলাম না৷ নিয়মানুযায়ী গ্রুপ থেকে চলে যাচ্ছি, ভালো থাকবেন, নমস্কার৷"


রিমা এবার একটু ঝটকা খেলো৷ 'অন্ধকারের যাত্রি' নামের ছেলে বা মেয়েটা আসলে কি এমন করেছে অলির জন্য যে অলি এতটা কৃতজ্ঞ! রিমা নিজে থেকে কখনো কাউকে নক দেয় না ইনবক্সে, এতে তার সেলিব্রিটি ইমেজটা একটু কেমন কেমন দেখায়! তবে, আজ সে নিজে থেকেই নক দিলো অলিকে.. অলি যেন জানতো রিমা নক করবে, সাথে সাথেই রিপ্লাই পেলো রিমা ওপার থেকে৷


—হ্যালো, ভালো আছেন অলি?


—আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন?


—ভালো, আচ্ছা.. আপনি আমাকে একটা গ্রুপে ইনভাইট করেছেন, 'সুইসাইডাল বক্স' নামের!


—আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি জানি আপনার সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি আছে৷ আপনি বোধহয় আমার কথা ভুলে গেছেন৷ আপনার সাথে কিন্তু আমার কথা হয়েছিলো..


—আসলে কিছু মনে করবেন না, আমি মনে করতে পারছি না! আর প্রোফাইলে ও কোনো ছবি নেই তো, ছবি থাকলে হয়তো চিনতে পারতাম৷ 


—কিছুদিন আগে আপনি ট্যাবলেট খেয়েছিলেন, তখন আপনাকে যে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছিলো আমি সেখানকারই ডাক্তার৷ হসপিটালে সাত দিন আমিই আপনাকে অ্যাটেন্ড করেছি৷ মনে পড়েছে এবার?


—ও.. আচ্ছা আচ্ছা, মনে পড়েছে৷ সরি..সরি আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম৷ আচ্ছা আমাকে বলো তো গ্রুপটার ব্যাপার কী! 


—মাফ করবেন, গ্রুপের ব্যাপারে আলোচনা করা তো একদমই নিষেধ৷ বিশেষ করে যারা গ্রুপ থেকে বেরিয়ে চলে আসবে তাদের জন্য একেবারেই নিষেধ৷


—আরে না না, কোন সমস্যা নেই, তুমি বলতে পারো, আমি কি কাউকে বলতে যাবো নাকি!


—দেখো, তুমি বরং 'অন্ধকারের যাত্রি' আইডিতে ম্যাসেজ করো, যা বলার বা করার ওনারাই করে নেবেন!


—ওসব পাগল ছাগলের সাথে কি আর কথা বলবো! থাক বাদ দাও, এই ইস্যু নিয়ে যথেস্ট ভেবে ফেলেছি৷ তুমি বলতে না চাইলে ইটস ওকে৷


—তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে, যদি কখনো আবার এমনটা হয় যে তোমার মনে হচ্ছে পৃথিবীটা বড্ড অর্থহীন, তাহলে প্লিজ ঐ আই ডি টাকে নক দিও! এটা রিকুয়েস্ট৷


—তুমিও কি সুইসাইড করতে চেয়েছিলে নাকি? 


—এসব বলা বারণ আছে রিমা! 


—ঠিক আছে, করুনাময় তার মঙ্গলময় হাত তোমার দিকে বাড়িয়ে দিক, ভালো থেকো অলি..


—তুমিও ভালো থেকো রিমা ..


রিমা-র আবার বিরক্তি লাগা শুরু হয়, অযথাই মেয়েটাকে নক করতে গেছে সে! 


**********


মিতালী গোস্বামী-র খোঁজ খবর বের করা খুব একটা কঠিন হলো না৷ আমি বরং এর চেয়েও ঝামেলা করে এর আগের ক'য়েকটা কেসের খোঁজ বের করেছি৷ যেমন আমার লাস্ট কেস অলি, কম হয়রানি হয়নি ওর ডিটেলস বের করতে৷ অলিকে যে শেষ পর্যন্ত ফেরাতে পারবো এটা আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিলো না! এর চাইতে মিতালী-র কেস সহজ হবার কথা!


অলির কথা মনে হলে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে৷ মেয়েটার সর্বনাশ করেছিলো তাকে ভালোবাসি বলা মানুষটাই৷ বাবা ছেড়ে যার হাত ধরে ঘর ছেড়েছিলো, সেই মানুষটি পেশায় একজন ডাক্তার অলির মতোই৷ একই হসপিটালে কর্মরত ছিলো দুজনে৷ অলির সেই ডাক্তার স্বামীটি এর আগেও বিবাহিত ছিলো৷ ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিলো দুজনের৷ এরপরই অলি আসে তার জীবনে৷ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে অলি৷ তার ডাক্তার হবার পথ অতোটা মসৃন ছিলো না, শুধুমাত্র বাবা-মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে অর্জিত অর্থ আর নিজের অসম্ভব রকমের মেধা অলিকে ডাক্তার বানিয়েছিলো৷ সেই অলি বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে, ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিলো সেই আরেক ডাক্তারের সাথে৷ ঘর ছাড়বার আগে অলির মা শুধু একটা কথাই অলিকে বলেছিলো "যার বউ ছেড়ে গেছে, কোন না কোন কারনেই তো গেছে! ভালোমতো খোঁজ না নিয়ে তুমি তার জন্য পাগল হয়ো না..." 


অলির তখন পাগল হবার সময়ই ছিলো৷ আমি অন্ধকারের যাত্রি হয়ে যখন শুনেছি অলির গোপনগাথা, তখন শিউরে উঠেছি ভিতরে ভিতরে ... কী নিদারুণ, কী ভয়ানক! আবার নতুন করে বুঝেছি,  বাবা-মা যা বলে ভালোর জন্যই বলে, পৃথিবীতে বাবা-মার চেয়ে আপন আর কেউ নয়৷ 


অলির স্বামীটি ছিলো একজন অসুস্থ মানসিকতার এক রোগী! ডাক্তারের সাদা অ্যাপ্রনের তলায় তার ছিলো একটা কুৎসিত, কালো, কলুষিত মন... মাথায় ছিলো বিকার! ভয়ানক! ভয়ানক সেই বিকার ...


চলবে...


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #২য়_পর্ব