Saturday, 9 December 2023

মাঝরাতের আতঙ্ক!..

 


কর্মসূত্রে প্রত্যেক ছ'মাস অন্তর বদলি অর্থাৎ জায়গার পরিবর্তন করতে হয়। দেশের নতুন নতুন স্থানে গিয়ে অফিসের অ্যাকোমোডেশন নয়তো ভাড়া বাড়িতেই উঠতে হয়, এবার অনেকের মতে কোনো বাড়ি দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে থাকলে নাকি সেখানে খারাপ কিছু এসে থাকা আরম্ভ করে। আজকাল এসব বিশ্বাস করার সময় আর হয়ে ওঠে না। আমিও এসব বিশ্বাস করতাম না, যদি না আমার সাথে সেরকম কিছু ঘটত; 

অফিসের কাছাকাছি হওয়ায় সেই পরিত্যক্ত বাড়িটা আমাকে ভাড়া নিতে না হতো। 


আমার বাড়িটা বেশ পছন্দ হয়েছিল স্বল্প বসতির এলাকায় হওয়ার জন্য; খালি ছোট ছোট ঘর-বাড়ি, পাহাড় আর বিভিন্ন জংলা গাছপালা আর খোলা আকাশের সমাবেশ, আমায় সেই ছোটবেলার মতো টেনে নিয়ে যায় হিমালয়ের কোলে। তবে পাহাড় বলতে অতো উঁচু উঁচু পাহাড় না হলেও ছোট টিলা বা ডুংগার বলা ভালো..

যাই হোক, ঘরে ওঠার কয়েক দিনের ভেতরেই সব গোছগাছ করে নিলাম। একা থাকি, নির্ঝঞ্ঝাট সব কিছু। সারাদিন অফিসে কাটিয়ে রাতটা খালি কাটাতে বাড়িতে আসা.. সপ্তাহ খানিক স্বাভাবিক ভাবেই কাটলো। এরপর এক রাতে রোজকার মতো অফিস থেকে ফিরে সব কাজ শেষ করে দরজা-জানলা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, এবার রাতে জানলায় আচমকা টোকা পড়ার শব্দে আমার ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল।


পাহাড়ের অঞ্চলে রাত ১০টা মানেই শুনশান, সেখানে ঘড়িতে দেখলাম রাত ১২ টা ২০। ঘরের একমাত্র জানলাটা আমার খাটের সঙ্গে প্রায় লাগোয়া, ঘরের দরজার মুখোমুখি উল্টো পাশে। কে যেন ডাকছে ঘরের পেছন থেকে! যদ্দুর দেখেছি, জানলার ওপাশে মানুষহীন পরিত্যক্ত বাড়িটা ছাড়া আর কোনো ঘর নেই। একরাশ বিরক্তি নিয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে রইলাম। টোকার শব্দ বদলে এবার কারো জোরে জোরে ধাক্কা দেওয়ার কারণে জানলাটা ঝনঝন করে কেঁপে উঠল। অতি প্রয়োজনের তাগিদে কেউ যেন জানলা খুলতে আবেদন করছে। আচমকা, অপ্রত্যাশিত এই ঝনঝন শব্দে বুকটা কেঁপে উঠল। ওপাশে যেই থাকুক না কেন, বেশ অধৈর্য পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, ক্রমাগত ঝনঝন করে কেঁপেই চলেছে জানলাটা। জানলা খোলার আগে আমি গলার আওয়াজ কিছুটা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কে ভাই?' সঙ্গে সঙ্গে জানলার কম্পন থেমে গেল। ক'য়েক মুহূর্ত কেটে গেল। কোনো সাড়া-শব্দও নেই। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, 'হ্যালো.. কে ওখানে, কী চাই?' আমি জানলা খুলবো কি খুলবো না ভাবছি এমন সময় আমার বুক কাঁপিয়ে দিয়ে আবার ঝনঝন করে কাঁপতে লাগলো জানলাটা। খুব জরুরী প্রয়োজন ছাড়া এমন করে এত রাতে কেউ ডাকবে না! আমি বিছানা থেকেই জানলার তিনটে পার্টের মাঝখানেরটা ধিরে ধিরে খুলতে গেলাম, উৎসুক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকালাম।


কিন্তু..


কেউ নেই জানলার সামনে। আশ্চর্য্য! 

এর মানে কী! বালিশের পাশ থেকে টর্চটা তুলে হাত বাইরে বের করে আলো এদিক সেদিক ঘোরালাম, সত্যিই কেউ নেই! জানলাটা বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়লাম। বড়ো জোর দশ-পনেরো মিনিট কেটেছে বোধ হয়, চোখ পুরোপুরি লাগেনি। আবার জানলায় টোকার আওয়াজ পড়লো, পরের মুহূর্তেই ঝনঝন করে কাঁপতে লাগলো ওটা। এবার প্রচণ্ড রাগ হলো। জানলা খুলে বাইরে তাকালাম। সেই একই অবস্থা। কেউ নেই। এবার বিরক্তির পাশাপাশি রাগও অনুভব করলাম। এত রাতে কেউ রসিকতা করছে আমার সাথে! টর্চ হাতে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। মৃদু চাঁদের আলো, উঠোনের বাল্বের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে আছে চারপাশ। এই দুতলা ঘরের উল্টোমুখে বাড়িওয়ালাদের থাকার ঘর। ওদের ঘরের সব আলো বন্ধ। শুনশান একটা ভাব। আশেপাশের সব বাড়িগুলোর ও একই অবস্থা। সামনে একটা লাঠি পড়ে থাকতে দেখে কী মনে করে তা হাতে নিয়ে ঘরের পেছনের দিকে চলে এলাম। উৎসুক ভাবে এদিক-সেদিক আলো ফেলে খুঁজে দেখলাম, কিন্তু কারও অস্তিত্বই পেলাম না।


বিরক্তি নিয়ে ঘরে ফিরতে যাবো, হঠাৎ খেয়াল করলাম পাশের পরিত্যক্ত দু-তলা বাড়িটার বারান্দার লাগোয়া ঘরটায় আলো জ্বলছে। কিছুটা অবাক হলাম। কারণ যতটুকু জানি, এই বাড়িটা দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে আছে। তাছাড়া এতক্ষণের ভেতরে, বেশ কয়েকবার বাড়িটার দিকে চোখ পড়েছিল আমার; কিন্তু, আলোটা আমার চোখে পড়েনি। আমার ঘরের জানলা দিয়ে তাকালেও পুরো বাড়িটাই প্রায় দেখা যায়। তখন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ও আলোটা দেখিনি। বাড়িতে কেউ উঠেছে বোধ হয়! টর্চের আলো গেটের উপর ফেলতেই অবাক হলাম। সেই আগেকার মতোই বড় পিতলের তালাটা লাগানো আছে ছিটকিনি-তে বাইরে থেকে। ওই রুমে তালা না খুলে কেউ ঢুকতে পারবে না। কেমন যেন একটা সন্দেহ হলো।


আমি সন্তর্পণে বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলাম। বারান্দার ঘরটার একটা কাঠের জানলা বাইরের দেওয়ালের দিকে। ওটায় ধাক্কা দিয়ে জানতে চাইলাম, 'কে আছে ভেতরে?' কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম ভেতরে কারও নড়াচড়ার শব্দ শুনে। খানিক পরেই খটখট আওয়াজ করে ওটা খুলে গেল। একটা মেয়ে, উৎসুক মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার চাউনিতে কেমন অভিভূত হয়ে পড়লাম আমি। কম্পিত গলায় বললাম, 'ইয়ে মানে.. এই বাড়িতে কেউ থাকে বলে জানতাম না, আলো জ্বলছে দেখে অবাক হয়ে এখানে এলাম..!'


মেয়েটা হাসিমুখে বলল, 'আজই আমরা এলাম! কিছুক্ষণ আগে..'


'কিন্তু গেট বাইরে থেকে তালা দেওয়া যে!'


'কই?'


আমি ঘুরে বাড়ির গেটের দিকে আলো ফেলেই বিস্মিত হলাম। একটু আগেও দেখলাম বাইরে থেকে তালা দেওয়া কিন্তু এখন তালার কোনো চিহ্নই নেই! গেটটা সামান্য ফাঁক হয়েও আছে। মেয়েটার মুখ এখনো হাসি হাসি। বলল, 'এর আগের বার যখন এসেছিলাম আপনাকে তো দেখিনি! নতুন প্রতিবেশী নাকি আপনি?'


'ওই ইয়ে.. মানে ওই ঘরটায় সপ্তাহ খানেক হবে উঠেছি। আপনাকে এত রাতে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত!' অপ্রস্তুত ভাবে জবাব দিলাম।


'..জানলায় কারো ধাক্কার আওয়াজ পেয়ে বেরিয়েছিলেন বোধ হয়..!'


আমি সামান্য মানসিক ধাক্কা খেলাম। 'আপনি জানলেন কী করে?'


'আমিও যে ঝনঝন শব্দ শুনে জানলা খুলে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। আপনার জানলার পাশে একটা অদ্ভুত ছায়ার মতো কালো কিছু দেখে ভয় পেয়ে আবার জানলাটা বন্ধ করে দিয়েছি। তারপরে এই আপনি এলেন!'


অদ্ভুত এক ভয়ের শিহরণ অনুভব করলাম আমি। মেয়েটা বলল, 'এসেছেন যখন ভালোই করেছেন, একটা উপকার করে দিয়ে যাবেন, প্লিজ? একটু ভেতরে আসুন..'


এই বলে জানলাটা বন্ধ করে দিল হুট করে, আবার পরমুহূর্তেই বারান্দার আলো জ্বেলে উঠল। গেটটার অর্ধেক নিশ্ছিদ্র লোহা আর বাকি অংশ গ্রিলের হওয়ায়, বারান্দার আলো গেট ভেদ করে বাইরে আসছিল। আমি হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর প্রবেশ করলাম ভেতরে ওনার আমন্ত্রণে, ওনারই সঙ্গে..


পরিত্যাক্ত বাড়ি বলতে এটা খুব সাদা-মাটা একটা দু-তলা বাড়ি। দুটো বেডরুম পাশাপাশি। রুম থেকে বের হলেই ডান পাশে বাথরুম ঘর এবং বাম পাশে আরেকটা ছোট হল ঘর। যেই ঘরের জানলা খুলে মেয়েটা আমাকে আসতে আহ্বান করলো।


বারান্দার ঘরটিতে উঁকি মেরে দেখলাম মেয়েটি নেই। আশ্চর্য্য! ডান পাশের বেডরুমের ভেতর থেকে ডাক এলো মেয়েটির মিষ্টি আওয়াজে, 'ভেতরে আসুন!' আমি কিছুটা সংকোচ নিয়ে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। ঘরের বাল্ব বন্ধ। টর্চের আলোতে ঘরটা ভরে উঠল। আমার থেকে কয়েক হাত দূরেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা এগিয়ে এসে একটা চেয়ার ইঙ্গিত করে দেখিয়ে আমার হাতে একটা বাল্ব ধরিয়ে দিয়ে বলল, 'এটা একটু লাগিয়ে দিন না! এটার জন্যে খুবই জ্বালাতনে পড়েছি। পুরো বাড়িতে কোনো টর্চ নেই।' একুশ বাইশ বছরের একটা মেয়ে। শাড়ি পড়ে কেমন অপ্সরার মতো লাগছে তাকে। বুকের ধুকপুকানি সামান্য হলেও বেড়ে গেল।


আমি চেয়ারে উঠে বাল্বটা লাগানোর চেষ্টা করলাম। বেশ উপরে হোল্ডার হওয়াতে সামান্য বেগ পেতে হলো। কাজটা করতে করতে কৌতূহল বশত জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনি কী একা এসেছেন?' এবার আমার পুরো শরীর জমিয়ে দিয়ে একটা পুরুষালি গলা ঘর ভরে গমগম করে উঠল, 'আমরা একা কোথাও যাই না! তোরও একা অপরিচিত ঘরে ঢোকা উচিত হয়নি!' আমার হাত থেকে বাল্ব আর টর্চ দুটোই ফস্কে পড়ে গেল। আতঙ্কে শিউরে উঠে নিচে তাকালাম। টর্চটা বন্ধ হয়ে পুরো ঘর তিমিরে ডুবে গেল। তখনই মেয়েটা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখান থেকেই জ্বলজ্বলে আগুনের শিখার মতো দুটো চোখ জ্বলে উঠল। সেই শিখার আলোতে যে মুখটা দেখলাম এটা কোনো মানুষের মুখ হতে পারে না! ওটার কোনো নাক কিংবা মুখ নেই! গোল মুখটার মাঝামাঝি ফুঁড়ে বেরিয়ে আছে দুটো আগুনের শিখার চোখ। গলার সামান্য নিচে একটা ফাঁক। মনে হলো ওটাই ওর মুখ। চিৎকার করার জন্য আমার সমস্ত শরীর জুড়ে চেষ্টা করে উঠল। 


চিৎকার করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু গলা দিয়ে টুঁ শব্দটি বের হলো না। উল্টে পা ফস্কে চেয়ার থেকে মেঝেতে পড়ে গেলাম উপুড় হয়ে। অল্পের জন্য মাথাটা মেঝেতে ঠুকতে ঠুকতে ঠুকলো না। আমি ঘুরে মেয়েটার দিকে তাকালাম। ওটার চোখ থেকে বিচ্ছুরিত আলোই ওটার অবয়ব মেলে ধরলো আমার চোখের সামনে।


ওটার লোমশ সারা শরীর গিজগিজ করছে অদ্ভুত এক প্রকার সাদা পোকায়। অনেকটা কেঁচোর মতো দেখতে ওগুলো। ওগুলো এগিয়ে আসছে আমার দিকে। ভয়ে আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে, ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলাম দুটো পা-ই বেশ ভালো রকম মচকে গেছে। পালানোর কোনো উপায় নেই.. কিন্তু কী এটা! ভ্রম..!


এবার নিজের সব শক্তি খরচ করে একটা চিৎকার করলাম। নিজের মুখ থেকে বের হওয়া বিকট চিৎকার পুরো ঘরময় এমন ভাবে অনুরণন খেয়ে কেঁপে উঠল যে নিজেই চমকে উঠলাম। মেয়েটার হাত থেকে বাল্বটা নেওয়ার আগে হাতে করে আনা লাঠিটা মেঝেতে ফেলে ছিলাম। অন্ধকার হাঁতড়ে ওটার নাগাল পেলাম। অদ্ভুত প্রাণীটার শরীর ঝুঁকতে লাগলো আমার দিকে। লোমশ শরীরের আড়াল থেকে ওর দুটো হাত উন্মুক্ত হয়ে গেল আমার সামনে। লাঠিটা সজোরে এগিয়ে এনে আঘাত করলাম ওটার বুক বরাবর। ওটা অশরীরী নয়! সামান্য আর্তনাদ তুলে পিছিয়ে যেতে লাগলো ওটা পেছনে। আমি আবার চিৎকার করলাম। শরীরে সামান্য যে শক্তি ছিল তার সাথে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে হাতের উপর ভর দিয়ে মেঝে টেনে টেনে শরীরটাকে বারান্দায় এনে হাজির করলাম। বারান্দার বাল্বটাও বন্ধ হয়ে আছে। কয়েকজন মানুষের ছুটে আসার আওয়াজ পেলাম। আমার চিৎকার কাজে লেগেছে। আমার বাড়িওয়ালা সহ আশেপাশের অনেকেই গেটের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো। একসাথে কয়েকটা টর্চের আলো আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিল।


কিন্তু... 


তারা কেউ ভেতরে আসতে পারলো না। কারণ গেটটা বাইরে থেকে তালা দেওয়া। তারা বিস্মিত হয়ে বাইরে থেকে চেঁচাতে লাগলো, জানতে চাইলো কী করে আমি ভেতরে ঢুকলাম তালা না খুলে! আমাকে এমন কাহিল অবস্থায় দেখে তারাও ঘাবড়ে গেছে। অবশ্য, তারা বেশিক্ষণ লাগালো না তালাটি ভেঙে আমাকে উদ্বার করতে। কোনো জবাব দেওয়ার মতো অবস্থায় আমি ছিলাম না। চোখ দুটো বন্ধ করলাম। এক মৃত্যু আতঙ্ক আমার শরীরটাকে পুরোপুরি অবশ করে ফেলেছিল। 


পা দুটো সম্পূর্ণ ভালো হতে প্রায় মাস পেরিয়ে গেল। আমি অবশ্য ঘটনার পরের দিনই সেই ঘর, সেই এলাকা ছেড়ে ভয়েই এক প্রকার পালিয়ে এসেছিলাম। সেই বীভৎস, ভয়ঙ্কর চেহারা আর শরীরটা বা রাতের কথা যখনই মনে উদয় হতো, আমার গোটা শরীরটা কেঁপে উঠত। কত রাতে দুঃস্বপ্নে এসে যে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল ওই প্রাণীটা... কী বলব! এরপর থেকে আজ পর্যন্ত অন্ধকারের ভীতি দূর করতে পারিনি আমি, এখনো আলো জ্বেলে ঘুমাতে হয় আমাকে। 


যেই লোকগুলো সেইরাতে আমাকে উদ্ধার করেছিল তাদেরকে আমার কাহিনী বললে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেনি তখন, আবার আমিও যে কিভাবে বাড়িতে ঢুকেছিলাম সেই কিনারাও করতে পারেনি। অনেক বছর পর যখন সেই এলাকায় আবার ফিরে গিয়েছিলাম তখন জানতে পারি আমি চলে যাওয়ার পর থেকে ওই বাড়িটার উত্তরাধিকারীরা ওখানে ফিরে এসে পরিত্যক্ত বাড়িটা ভেঙে বহুতল বিল্ডিং করার আগে পর্যন্ত সেই বাড়ির আশেপাশের অনেক ঘরের লোকেরাই মাঝরাতে জানলায় টোকা বা ধাক্কানোর আওয়াজ পেয়েছিল। কেউ কেউ মাঝরাতে সেই পরিত্যক্ত বাড়ির ঘরে আলো জ্বালা অবস্থাতেও দেখেছে। কয়েকজন তো একটি রূপসী মেয়ের অবয়বও দেখেছিল খোলা জানালা দিয়ে। আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা জেনে অনেকেই আগের থেকে সতর্ক থাকায় বিপদে পড়েনি যদিও.. 


অবশ্য, আমি যা দেখেছিলাম সেরাতে, সেই দৃশ্যটা অন্য কেউই দেখেনি। আমি চাইও না ওটা আর কেউ দেখুক। চাই না, যেন কারও ঘরের জানলায় মাঝরাতে পড়ুক অন্য জগতের, অচেনা কারও টোকা..! 


(সমাপ্ত) 


#মাঝরাতের_আতঙ্ক 


লেখা: #উষস_চট্টোপাধ্যায়

Saturday, 2 December 2023

সুইসাইডাল বক্স (শেষ পর্ব)..

 


সুইসাইডাল বক্স

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ১০ / অন্তিম পর্ব

_____________________


সবকিছু রিমার চোখের সামনে ভাসছে৷ রিমার মাথাটা ভীষণ ঘোরাচ্ছে৷ ভীষণ ক্লান্তি লাগছে, মনে হচ্ছে এই ঘাসের মধ্যেই শুয়ে পড়লে আরাম পেতো সে ....


তারপরও সে সেখান থেকে উঠে দাঁড়ায়৷ ভালো লাগছে না এই খোলা হাওয়াও তার! মনের মধ্যে অশান্তি থাকলে কি আর খোলা হাওয়ায় মন জুড়ায়? 


কলেজ স্কোয়ারে-র কাছে সিগন্যালে গাড়িটা থেমে আছে৷ কিন্তু... এ..এ কীভাবে সম্ভব..?

গাড়ির জানালা দিয়ে রিমা স্পষ্ট দেখছে সমাপ্তি বই দামাদামি করছে৷ ফুটপাতের বইয়ের দোকানে দাঁড়ানো লাল শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা ছেলেটা পুরো সমাপ্তি-ই তো! এই মুখ চিনতে রিমার ভুল হবার কথা নয়৷ তারপরও নিজের চোখ আবার কচলে নেয় রিমা৷ ভুল দেখছে না তো সে! না না...! এই তো সমাপ্তি ... সমাপ্তি কি তাহলে বেঁচে আছে, লোকের চোখে ফাঁকি দিতে ছেলের রূপ ধারণ করেছে কি!?


রিমা দ্রুত গাড়ির দরজা খুলে ছেলেটির কাছে গিয়ে দাঁড়ায় ... 


তারপর গলায় একগাদা বিস্ময় নিয়ে বলে "সমাপ্তি না..."


ছেলেটি রিমার দিকে ঘুরে তাকাতেই জ্ঞান হারিয়ে ধপাস করে সেখানে পরে যায় রিমা ...


**********


হঠাৎ করে এমন সব ঘটণা আমার সাথেই কেন হয় কে জানে! মেয়েটার এখনো জ্ঞান ফেরেনি৷ খুব বড়লোকের মেয়ে বোঝা যাচ্ছে৷ মেয়েটির বাবা এসেছে, তারপর থেকে এখানে ডাক্তার-নার্সদের ছোটাছুটি বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে৷ 


আমি এখন এখানে বসে থাকবো না কি চলে যাবো সেটাও বুঝতে পারছি না; আমার আসলে কি করা উচিত? মেয়েটা বোধহয় তিতলী-র পরিচিত৷ আমাদের একই রকম চেহারা হওয়ায় ও আমাকেই তিতলী ভেবেছে৷ মৃত একজন মানুষকে চোখের সামনে জলজ্যান্ত দেখে বোধহয় মেয়েটা নিজেকে সামলাতে পারেনি৷ আমি ওকে এটুকুও বলার সুযোগ পেলাম না যে আমি সমাপ্তি নই বা ওর কোন রূপ ও ধারণ করিনি! আমি ওর-ই জমজ ভাই অমিত, সমাপ্তি নই..


আমার ভীষণ মন খারাপ লাগছে৷ তিতলী আর আমার কলেজ পর্যন্ত একসাথেই পড়াশোনা ছিলো৷ তারপর তিতলী চান্স পেয়ে গেলো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর আমি ভর্তি হলাম অ্যামিটি কলেজে৷ কলেজ পর্যন্ত আমাদের বন্ধুবান্ধব সেম থাকলেও হায়ার স্টাডিতে গিয়ে ওর অনেক নতুন নতুন বন্ধু হয়েছিলো৷ ও যে রকম প্রানবন্ত মেয়ে ছিলো, সবার সাথে বন্ধুত্ব করতে পারতো এক নিমেষেই, এতই মিশুকে ছিলো!


এই মেয়েটাও বোধহয় তিতলীর ফ্রেন্ড ই হবে৷ আমার বোধহয় ওর জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করাই উচিৎ!


***********


রিমার জ্ঞান ফিরলো দীর্ঘক্ষণ পর৷ রিমার বাবা ওর মাথার কাছেই বসে ছিলো৷ ভদ্রলোক কান্নাকাটি করেছেন চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে৷ চোখ মুখ কেমন ফুলে আছে! রিমা ধীরে ধীরে বললো "স..মা..প্তি.."


রিমার বাবা ডেকে পাঠালেন সেই ছেলেটিকে, যে ছেলেটা ড্রাইভারের সাহায্য নিয়ে রিমাকে হাসপাতাল পর্যন্ত এনেছে! 


রিমা আর ছেলেটি এখন মুখোমুখি ...


—কিন্তু.. এ কী করে সম্ভব, এ তো সমাপ্তির মুখ, পুরো সমাপ্তি!


—আপনি ভুল করছেন৷ আমি অমিত ওরফে রণি, ওর জমজ ভাই৷ সমাপ্তি আমদের ছেড়ে চলে গেছে দু'বছর আগে ..


এটুকু শুনতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে রিমা৷ তারপর প্রথমবারের মতো নিজ মুখে তার বাবা আর রণির সামনে স্বীকার করে সবটা ...


রণি যা স্বপ্নেও ভাবেনি, তাই হলো আজ! 


তার সামনে হাসপাতালের সাদা চাদরে ঢাকা দিয়ে শোয়ানো মেয়েটি আসলে তার বোন তিতলী-র খুনী! 


দুই হাত জোর করে ক্ষমাপ্রার্থনা করছে খুনী মেয়েটি! 


রিমার দিকে তাকিয়ে রণি বলে "তোমার কি মনে হয় না পুলিশের কাছে ব্যাপারটা বলা উচিত? নিজের ভাগের শাস্তিটা ভোগ না করলে শান্তি তে বাঁচতে পারবে তো..?" 


**********


রিমার বাবা কাঁদছে.. 


সময়ের ব্যবধানে পুলিশ হাসপাতালে এসে স্টেটমেন্ট নিচ্ছে রিমার, সে আকুল হয়ে কাঁদছে..


আরেকজন আজ উদাসীন হয়ে কাঁদছে, সে রণি, ওরফে আঁধার ...আজ সে জানে তার তিতলী কেন তাদের ছেড়ে চলে গেছে ..!


                                      (সমাপ্ত)


         #ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #শেষ_পর্ব