সবাইকে দীপাবলির শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে আজকের সকালে আমার এই গল্পটা দিলাম, পড়ে দেখুন, ভালো লাগবে আশা করি!
জানাতে ভুলবেন না, কেমন লাগল 🙏🏼🙂
***********************************
এগারো হাজার নশো, এই নিয়ে বার তিনেক গুনলাম। আমি জানতাম এখানে এগারো হাজার নশো টাকাই আছে। তারপরও পর পর দুইবার আবারো গুনলাম। আরও দুই হাজার টাকা লাগবে। অফিসে এসেই অয়ন স্যারের কাছে গেলাম, যদিও আগের পাঁচ'শ টাকা এখনো শোধ করা হয়নি। তারপরও গিয়ে বললাম, 'স্যার হাজার দুয়েক টাকা লাগতো! প্রতি মাসে পাঁচ'শ করে ফেরত করে দেব।'
'কী ব্যাপার রজত বাবু, সকাল সকাল টাকা ধার চাইছ, দিওয়ালির বোনাস ও কম পড়ল নাকি?'
'সে তো বটেই স্যার, আর একটা কাজ ও আছে স্যার..'
'সেটা তো বুঝলুম, তুমি তো কাজ ছাড়া এক টাকাও খরচ করো না! তবে কাজটা কী, শুনি?
'মেয়েটার জন্য একটা ফোন কিনব স্যার, স্মার্ট ফোন। মেয়েটা কলেজে ভর্তি হয়েছে কিনা! লেখাপড়ার নানা কাজ এই ফোন ছাড়া নাকি হয় না। মাঝে মাঝে তো নাকি ফোনেও ক্লাস হয়! মেয়ের মামা মোবাইল একটা দিয়েছিল বটে, কিন্তু সেটা অনেক পুরনো। আজ ঠিক তো কাল সারাই করার দোকানে, এটা চলে তো ওটা চলে না। মেয়েটা নাজেহাল হয় ঠিকই কিন্তু আমার আয়ের কথা জানা আছে বলে মুখ ফুটে কিছু বলে না। মেয়ের মা কয়েকদিন ধরে বলছিল, স্মার্ট ফোন কেনার মতো এত গুলো টাকা একসাথে জোগাড় করা বেশ কঠিন। গত কয়েক মাসে মোটামুটি কিছু টাকা জমিয়েও ফেলেছি, আজ বোনাস পেয়ে ও দামে কুলোচ্ছে না..'
'ভালো কথা, কিন্তু আমার হাতে এখন নগদ অতোগুলো টাকা তো নেই রজত। লাঞ্চের সময় বাইরে গেলে এটিএম থেকে কিছু টাকা তুলে দেব, তখন না হয় নিও, কেমন?'
'ঠিক আছে স্যার, তখন দিলেই হবে।..'
অয়ন স্যারের কাছ থেকে ফিরে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন লাঞ্চের সময় হবে। টাকাটা বের করে আরেকবার গুনতে ইচ্ছে হলো। যদিও গুনে কোনো লাভ নেই সেটা আমি জানি। ওখানে এগারো হাজার নশো টাকাই আছে। এদিকে মেয়েটা দু-তিনবার মিসকল দিয়েছে। মিসকল দেওয়ার কারণও আছে। ভেবেছিলাম, সকালে অফিসে এসে অয়ন স্যারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য ছুটি নেব। মেয়েটাকে তেমন করে বলেও রেখেছি। কথা ছিল অফিসে এসে হাতের কাজ গুছিয়ে আমি ফোন করব। আমি ফোন করলেই দুই মেয়ে আর তার মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়বে, দমদম মতিঝিল থেকে ডালহৌসি। সেই ডালহৌসির কাছেই একটা মোবাইল শোরুম থেকে আমরা ফোনটা নেব, ঠিক করে রেখেছি। এদিকে হাতের কাজ গুছিয়ে ফেললেও টাকা জোগাড় হয়নি। ভেবেছিলাম একটু পরে মেয়েদের ফোন করে বলব দুপুরের পর বাড়ি থেকে বেরোতে। কিন্তু তার আগেই মেয়েটার দু-দুবার মিসকল দিয়ে দিয়েছে। আমি জানি, মেয়েরা এই নিয়ে খুব উত্তেজিত। অনেকদিন এতো দাম দিয়ে আমার বাড়িতে কিছু কেনা হয়নি। মেয়েদের সাথে মেয়ের মাও ভীষণ খুশি। মেয়ের মা খুশি কারণ এখন সে মাঝে মাঝে বাড়িতে ভিডিও কল করতে পারবে বলে। তাছাড়া সে শুনেছে, স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে নাকি টাকা ছাড়াও কল করা যায়, কী যেন গুগুলে না স্কাইপিতে। এইটা শোনার পরে সে মহা খুশি। গতকাল অফিস বন্ধের পরে আমি আর বড় মেয়ে শিখা এই ফোনটা একবার দেখে গিয়েছি। মেয়েটা একটু লাজুক প্রকৃতির। কিনব না, কিন্তু দামদর করে দেখতে শোরুমে যেতে একটু ইতস্তত করছিল। আমিই জোর করলাম। বললাম, 'দামি জিনিস। একটু আগে থেকে দেখে শুনে কিনলে ঠকবো না। তাছাড়া আমাদের তো আর জানা শোনা নেই। আগে থেকে দেখে শুনে দামদর করে একটু দেখে আসলে সুবিধাই হবে।'
আমার কথায় মেয়েটা রাজি হলো। ডালহৌসিতেই দু-চারটে শোরুম ঘুরে ঘুরে দেখলাম। আমাদের বাপ-বেটিকে দেখে দোকানিরা দামি দামি সব ফোন দেখায়। ফোনের নানা সব ফাংশান বলে, ওতসব আমার জানা নেই। মেয়েটা কিছু কিছু জানে বটে; ওইটুকুই ভরসা। কিন্তু দামি ফোন দেখে মেয়েটা কেমন যেন জড়োসড়ো হয়ে থাকে। আমাকে কানে কানে ফিসফিস করে বলতে থাকে, 'বাবা, এখানে দেখার দরকার নেই, চলো এখান থেকে..'
আমি বুঝতে পারি, মেয়ে আমার দাম নিয়ে ভয় পাচ্ছে। দোকানের বাইরে এসে বাপ-মেয়ে শলাপরামর্শ করি, তারপর আবার দোকানে যাই। হাজার দশেকের মধ্যে মোবাইল খুঁজি। মেয়েটার কাজ হবে এমন মোবাইল হাজার দশেকের মধ্যে পাওয়া মুশকিল। মেয়েটার মন খারাপ হয়। আমি জানি বার বার এই দোকান সেই দোকান ঘুরতে তার লজ্জা কচ্ছে। তারপরও সেই লজ্জা আমার কাছে লুকিয়ে রেখে মেয়েটা বলে, 'বাবা, আমরা না হয় আর কিছুদিন পরে ফোনটা কিনি!'
মেয়েটার কথা আমার বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে। এত আশা নিয়ে, এতটা পথ এসে ফোন কেনা হবে না ভাবতেই আমার কেমন যেন বুকটা ফেটে যেতে চাইছে। মনে মনে ভেবে রাখলাম আজ ফোন পছন্দ করেই তবে ফিরব। হাজার দুই তিনেক টাকা বেশি লাগে তো লাগুক। মেয়েকে নিয়ে আবার ঘুরতে লাগলাম। শেষে এই তের হাজার আটশো টাকা দামের ফোনটা আমাদের খুব পছন্দ হলো। সেই পছন্দ করা হয়ে গেলে, বাপ-মেয়ে বেশ খোশ মেজাজে বাড়ি ফিরলাম। আমার ছোট মেয়েটা পড়ে ক্লাস সিক্স। সেও বায়না ধরল ফোন কেনার সময় সাথে যাবে। এদিকে মেয়ের মাকেও দেখলাম যেতে রাজি। ভাবলাম ভালোই হলো, একটা ফোন যখন কিনছি তবে সবাই গিয়েই না হয় কিনি। সেই থেকে বাড়িতে উৎসব লেগে আছে। এমনিতেই দীপাবলির অনেক অফার বেরিয়েছে। গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত দেখলাম দুই মেয়ে ফিসফিস করে এই ফোন নিয়ে কী সব বলছে। মেয়েদের খুশি দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগে। হাজার দশেক টাকা আগেই জমানো ছিল। রাতে মাটির ব্যাংকটা ভাঙলাম। ভেবেছিলাম বাকি টাকা ওখানে পাওয়া যাবে। কিন্তু পেলাম ঐ হাজারের কাছাকাছি। এদিকে মেয়েদের কথা দিয়ে রেখেছিলাম আজই ফোন কিনব। সুতরাং রাতেই ভেবে রেখেছি, অফিসে এসে অয়ন স্যারের কাছ থেকে বাকি দু-হাজার টাকা ধার নিয়ে ফোনটা কিনে ফেলব। বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছি, দুপুরের পরেই রওনা দিতে। এদিকে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন লাঞ্চের সময় হবে। বড় স্যারের কাছ থেকে আগেভাগে লাঞ্চের পর থেকে ছুটি নিয়ে রেখেছি। এখন টাকাটা হাতে পেলেই হলো। ডালহৌসির ট্রাভেল এজেন্সির এই অফিসে আমরা লোকজন বলতে জনা দশেক। বড় স্যারের পর ওই অয়ন স্যার। বড় স্যার ধার দেনা পছন্দ করে না। এদিকে অয়ন স্যার ছাড়া বাকি সবার হাতের অবস্থা ঠিক আমার মতো। বিপদে আপদে ওই অয়ন স্যার আমাদের অনেকের ভরসা, আজও তাই। তাছাড়া আমার মতো অফিস পিয়নকে টাকা পয়সা ধার দিতে ও সচরাচর অনেকে ভয় পায়। আমিও খুব একটা বিপদে না পড়লে ধারদেনা পছন্দ করি না। আমার অল্প মাইনে আর শিখার মায়ের সেলাই এর কাজের টাকা দিয়ে টেনে টুনে সংসার চলে যায়, তাই নিয়ে আমরা খুশি। কিন্তু হঠাৎ করে এই ফোনের টাকা জোগাড় করতে এবার বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
লাঞ্চের সময় কিছুটা পেরিয়েছে। অয়ন স্যার একটু আগে বেরিয়েছেন, আমাকে বলে গেলেন লাঞ্চ করে আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসবেন। আমার টাকার কথা তার মনে আছে। যাওয়ার সময় আমাকে আশ্বস্ত করায় আমি কিছুটা সাহস পেলাম। এদিকে আমিও মেয়েদের বলে দিলাম রওনা দিতে। এতক্ষণে এসেও গিয়েছে বোধহয়। শিখা জানে কোথায় দাঁড়াতে হবে। তাছাড়া আমি বলে দিয়েছি যে দোকানটায় ফোন পছন্দ করে রেখেছি সেখানে গিয়ে ফোনটা দেখে রাখতে। আমাকে যেহেতু মিস কল দিয়েছে তাই নিশ্চিত হলাম পৌঁছে গিয়েছে।
লাঞ্চের সময় ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে গেল। অয়ন স্যার এখনো আসেন নি। আমি একটু বিচলিত হয়ে পড়লাম। এদিকে মা-মেয়েরা এসে দাঁড়িয়ে আছে। বড় মেয়েটা দুবার ফোন দিয়ে জানতে চাইলো আমার আসতে দেরি হবে কি না। তারা নাকি বেশ কিছুক্ষণ ওই দোকানেই ছিল। এখন বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছে। ফোন না কিনে দীর্ঘক্ষন একটা দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ অস্বস্তির। অয়ন স্যারকে ফোন করলাম, তিনি ফোন ধরছেন না। এমন তো হওয়ার কথা নয়..
সময় আরো কিছু পেরিয়েছে। আমার ভীষণ মন খারাপ হচ্ছে। আমার অফিস থেকে মিনিট দশেক হাঁটলেই সেই মোবাইল ফোনের দোকান। এদিকে অয়ন স্যার আসবে আসবে করে আমি কোথাও নড়তে পারছি না। এখন মনে হচ্ছে কোথাও পালিয়ে যাই। মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে। আমি জানি, কিছু টাকা জোগাড় হয় নি শুনেও মেয়েটা হাসি হাসি মুখ করে বাড়ি যাবে; ফোনের কথা একবার ও তুলবে না। মেয়েটা তখন অন্য একটা গল্প জুড়ে দেবে। সেই গল্প শুনে আমার হাসি পাবে, খুব হাসি। মেয়েটা লাজুক হলেও ভীষণ ভালো গল্প বলে। এতো গল্প তার মাথায় কোথা থেকে আসে আমি বুঝি না। আমার শুনতে বেশ ভালো লাগে। মাঝে মাঝে আমার যখন খুব মন খারাপ হয় তখন মেয়েটার কাছে গিয়ে বসি। মেয়েটা খুব বুঝতে পারে, আমাকে মন খারাপের কোনো কারণ জিজ্ঞেস না করেই গল্প বলা শুরু করে। মাঝে মাঝে সেই গল্প শুনে আমি হাসি। বাচ্চাদের মতো করে হাসি। আমার হাসি দেখে বউ বলে আমি নাকি পাগল। কিন্তু আমি জানি, আজ আমার গল্প শুনতে ভালো লাগবে না। একটুও না। আজ গল্প বললেও আমার মন ভালো হবে না। তাই আমি বসে আছি। মনে মনে ভাবলাম আর কিছুক্ষণ দেখি। অয়ন স্যার এসে পড়লে সব সমাধান হয়ে যাবে। মা-মেয়েরা না হয় আরোও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুক।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমি রওনা হলাম স্ত্রী এবং মেয়েরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেইখানে। যাওয়ার আগে লাজ-লজ্জা ফেলে দু-একজনের কাছে দুই হাজার টাকা ধার চাইলাম, কেউ পারল না দিতে। মোবাইল ফোনের দোকানের কাছে এসেই দেখলাম দোকান থেকে একটু আড়ালে মা-মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে তাদের দেখে আমার পা যেন আটকে গেল। আমি তাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি কিন্তু পা দুটি যেন অসাড় হয়ে আছে। নিজেকে টেনে নিয়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে দেখেই বড় মেয়েটা দ্রুত পায়ে কাছে এসে বলল, 'বাবা, আজকে ফোন নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমরা না হয় দুদিন পরে নিই। চলো আজ আমরা কিছুক্ষণ এসপ্ল্যানেডে ঘুরে বাড়ি ফিরি।'
আমি কিছু একটা বলতে গেলাম কিন্তু গলাটা কেমন যেন আটকে আসল। মেয়েরা অনেক কিছু বুঝতে পারে। আমার আজকের সীমাবদ্ধতার কারণও নিশ্চয় মেয়েটার জানা হয়ে গিয়েছে। জানা হয়ে গিয়েছে বলেই হয়তো আমারে কাছে কোনো কৈফিয়ৎ জানতে চেয়ে আমাকে কষ্ট দিতে চাইছে না মেয়েটা।
ডালহৌসি থেকে আমরা সবাই হাঁটা ধরলাম এসপ্ল্যানেডের দিকে। ভাবলাম সেখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সময় কাটিয়ে বাসে করে সবাই মতিঝিল ফিরে যাব।
কিছুটা দূর আসতেই দেখি অয়ন স্যার ফোন করছেন। ফোন ধরতেই বলল, 'রজত বাবু, তুমি কোথায়?'
'আমি বাড়ি যাচ্ছি স্যার..'
'এখন আছো কোথায় তুমি?'
'গ্র্যান্ড হোটেলের তলায়..'
'তুমি ওখানেই দাঁড়াও, আমি এখুনি আসছি..'
পাঁচ মিনিটের মধ্যে অয়ন স্যার এসে হাজির। এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, 'তুমি তো দেখলে আমি লাঞ্চে গেলুম। যেইমাত্র খেতে বসেছি অমনি বাড়ি থেকে ফোন এলো যে আমার ছোট মেয়েটা রুমে আটকা পড়েছে। কিছুতেই লক খুলতে পারছে না। এদিকে মেয়েটার আবার শ্বাস কষ্ট আছে, ভয়ে সেই শ্বাস কষ্ট আরো বেড়ে যায়। আমি কিছু না ভেবেই রওনা দিলুম বাড়ির দিকে। জ্যামের কারণে অর্ধেক পথ গেলুম দৌড়ে, এ ছাড়া উপায় ও নেই। আমার খুব আদরের মেয়ে। মেয়ের কথা ভেবে কাঁদছি আর দৌড়চ্ছি। শেষে আমি গিয়ে, দরজার তালা ভেঙে মেয়েকে বের করলুম। এত কিছুর মধ্যে তোমার টাকার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলুম রজত। সবকিছু শান্ত হতেই তোমার কথা মনে পড়ল। ভেবেছিলুম আসব না। কিন্তু আমি চাই না আজ তোমার মেয়ের একটুও মন খারাপ হোক।'
আমি বললাম, 'আরে, সমস্যা নেই স্যার। আরেক দিন নিয়ে নিতাম।'
'আরেক দিন মানে? আমি আবার আসলম ফোন কিনতে আর তুমি বলছ আরেক দিন? চলো কোথায় ফোন দেখেছিলে..'
অয়ন স্যারের জোরাজুরি তে আমরা সবাই আবার ফিরে গেলাম সেই দোকানে। ফোন নিয়ে অয়ন স্যার সব টাকা তার কার্ড থেকে পরিশোধ করে দিয়ে বলল, আজ এই ফোন আমার শিখা মায়ের জন্য আমার তরফ থেকে উপহার। এই টাকা তোমাকে শোধ করতে হবে না।'
আমি খুব না করলাম কিন্তু অয়ন স্যার বলল, 'এটা আমি খুশি হয়ে দিচ্ছি। তোমার মতো ভালো মানুষের মেয়েকে কিছু দিতে পারলে আমার ভালো লাগবে। তুমি না করলে আমি কষ্ট পাব!'
অয়ন স্যারের কথা ওপর কিছু বলার সাহস আমার হলো না। ফোন কিনে অয়ন স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা রওনা দিলাম বাড়ির দিকে। ডালহৌসি থেকে একটা ট্যাক্সি নিলাম, জানি খরচ একটু বেশি হবে; তারপরেও নিলাম। ট্যাক্সিতে মেয়েটা লুকিয়ে কাঁদছে। আমি জানি মেয়েটা খুশিতে কাঁদছে। মেয়েটা চুপচাপ। অন্য সময় হলে কিছু একটা নিয়ে মেয়েটা গল্প করত। আজ করছে না। ছোট মেয়েটা একবার ফোনটা বের করে দেখতে চাইলো। শিখা নিপাট রাগ দেখিয়ে বলল, 'হাত দিবি না এখন, এই ফোন এখন ধরা যাবে না।'
বাড়িতে ফিরে সবাই নেড়েচেড়ে ফোনটা দেখলেও এই ফোন দিয়ে কোথাও ফোন করতে দেবে না মেয়েটা। শিখার মা বলল, 'তোমার মামাকে একটা ভিডিও কল করো। অনেকদিন দেখি না ভাইটা কে, সেই সুযোগে বুড়ো বুড়িকেও দেখা হয়ে যাবে..'
শিখার এক কথা, 'আজ কোথাও ফোন করা যাবে না, কাউকে ফোন হাতে দেওয়া যাবে না। সবকিছু কাল থেকে হবে।' আমরাও আর জোর করলাম না। মেয়েটা যেমন চায় করুক। তার খুশিতেই আমাদের খুশি।
পরদিন সকালে আমি অফিসে এসেছি অফিসে পুজোর গোছগাছ করতে, একটু দেরিতে। পথে ভীষণ জ্যাম ছিল। এরই মধ্যে মেয়ে দুইবার ফোন করেছে। আমি অফিসে এসে বড় স্যারের একটা কাজ করছিলাম অমনি অয়ন স্যার ডাক দিয়ে তার মোবাইল ফোনটা আমার হাতে দিয়ে বলল, 'তোমার তো আবার বাটন ফোন। শিখা তাই আমার ফোনে ভিডিও কল করেছে। নতুন ফোন দিয়ে তোমার সাথে নাকি প্রথমে কথা বলবে। এই কারণে অন্য কারো সাথে এখনো কথা বলেনি। কথা বলো রজত..'
ফোনটা হাতে নিতে দেখলাম আমার শিখা মেয়েটার মুখ। মেয়েটা কাঁদছে। আমিও যেন কেমন বাচ্চা হয়ে গেলাম। আমি কাঁদছি। ভিডিও কলে আছি, অথচ আমরা বাপ-মেয়ে কোনো কথা বলছি না। দুজন দুজনের কান্না দেখছি। মেয়ের সেই কান্না দেখে আমার মনে হচ্ছে আমি কোনো এক সুখের গল্প শুনছি। মুখে না বললেও মেয়ের সেই গল্প ঠিকই আমি শুনতে পাচ্ছি।
আমাদের বাপ-মেয়ের মধ্যে কোনো কথা না হয়ে সেই ভিডিও কল শেষ হলো। বুঝলাম মেয়েটা কেন গতকাল রাতে আমার ফোন থেকে অয়ন স্যারের ফোন নাম্বার নিয়েছিল। আমি একটু আড়ালে হাতের কব্জি দিয়ে দুচোখ মুছে অয়ন স্যারের দিকে ফোনটা দিলাম। স্যার আমার হাত থেকে ফোন নিতে নিতে বলল, 'পৃথিবীতেও কিছু স্বর্গ সুখ আছে রজত বাবু! আজ তোমাদের বাপ-মেয়েকে দেখে মনে হলো আমি সেই স্বর্গ সুখ দেখছি..'
॥ দিওয়ালির বোনাস ॥
©Chatujje Moshai - চাটুজ্জে মশাই~
No comments:
Post a Comment