Tuesday 11 October 2022

সুখানুভূতির সাথে কিছুক্ষণ!

 


সারাটা দুপুরের উৎকন্ঠার বেড়াজালে কাটিয়ে, আঁধার নামতেই ঘরে নিয়ন আলোটি জ্বেলে টেবিলের ওপর বই খুলে বসলাম আমি। ফাইনাল সেমিস্টার সন্নিকটে, পড়ার চেষ্টা করলাম তাই। কিন্তু আঁখিপল্লব দু'টি বার বার ঝাপসা হয়ে এসে কাজে ব্যাঘাত ঘটালো। কোন বাঁধা-নিষেধ মানলো না অবাধ্য অশ্রুজল। নয়নের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অঝোরে। স্তব্ধ কক্ষে ভাসছে নাক টানার অস্ফুট শব্দ। টেবিলের একপাশে উপেক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকা মুঠোফোনটি জ্বলে উঠছে বারংবার। সাইলেন্ট মোড অন করে রাখা, রিংটোনের বদলে ভাইব্রেট করে উঠছে প্রতিক্ষণে। টেবিলও সে সুবাদে শিহরণ দিচ্ছে তালে তালে। হোমস্ক্রিনে মেসেজ, মিসড কলের স্তুপ জমেছে। অথচ অভিমানি মন অদেখার ভাণ করে আছে। পুনরায় মুঠোফোনটি ভাইব্রেট করে উঠতে ঝাপসা চোখে তাকালাম পাশে, উজ্জ্বল স্ক্রিনে ভাসছে 'অয়ন' নামটি। কান্নার বেগ বাড়লো। বিতৃষ্ণা চেপে ধরতেই বন্ধ করে ফেললাম ফোনটি। প্রিয় মানুষটির নামও দেখতে অসহ্য লাগছে আজ। অথচ এই মানুষটিই আমার প্রিয় তালিকায় শীর্ষে। সহসা মাথায় অবাধ যন্ত্রণা করে উঠতেই বইয়ের ওপর দুই হাত ভাঁজ করে মাথা নুয়ে ফেললাম। নেত্রপল্লব বন্ধ করা মাত্র নোনাজলে ভিজে যেতে থাকলো প্রিন্টের বইটি। কখন যে টেবিলের উপর মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই। 

ঘুম ভাঙলো আমার মাথায় কারো শীতল স্পর্শ পেয়ে, পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালাম। দৃষ্টি মেলার পর সর্বপ্রথম মায়ের চিন্তিত মুখটি সুস্পষ্ট হলো অক্ষিপটে। মা কন্ঠস্বর নামিয়ে বলছে, "টেবিলে মাথা রেখে কেউ ঘুমায়? আর শরীর খারাপ নাকি তোর? চোখ লাল হয়ে আছে কেন? জ্বর এসেছে নাকি?"


কথাটা বলেই মা উদ্বিগ্ন হয়ে কপালে, গালে হাত ছোঁয়ালো। গায়ের তাপমাত্রা গরম, জ্বর আসবে আসবে ভাব। আমি দ্রুত দৃষ্টি নামিয়ে ফেললাম, মাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না আমি কেঁদেছিলাম। নাহলেই বিপদ। কোনরকম জিভ ঠেলে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে কন্ঠ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললাম, "ঠিক আছি মা।"


মা রাগান্বিত ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠলো, "কতটা ঠিক আছিস সেতো দেখতেই পাচ্ছি। সকালে বৃষ্টিতে ভিজেছিলিস, তাই না?"


আমি উত্তর দিলাম না। আলগোছে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম শুধু। মা আমাকে খেতে দেওয়ার আগেই স্নানে যাওয়ার সময় বলে গেছিল খাবার গরম করতে। মা যেতেই অবসন্ন হাতে ফোনটা তুলে নিলাম, ফোনটা অন করবো কী-না দ্বিধাদ্বন্দে কিছুক্ষণ থেকে ফোনটা পুনরায় অবহেলায় ফেলে রাখলাম। খাওয়া দাওয়া হলো, ইত্তস্বরে মাথার যন্ত্রণাটা আবার বেড়েছে। ইচ্ছে করছে মাথাটা কেটে দুভাগ করে ফেলতে। মা নিজের হাতে খাবার, ওষুধ, জল খায়িয়ে দিয়ে বিছানায় ঘুমোনোর আদেশ দিয়ে গেল। আমিও ভদ্রবাচ্চার মত বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম, চোখে আবার জ্বালাটা শুরু হয়েছে, মাথাটাও ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন, শরীর দূর্বল হয়ে এসেছে। মনের কোণে কড়া নাড়ছে বিকেলের স্মৃতিটুকু। 



[এর আগে..]

অবসর সময়টুকু ফেসবুক করেই কাটাচ্ছিলাম। এমন সময় একটা পোস্ট চোখে পড়লো যেখানে লেখা, "গেট ওয়েল সুন ব্রো।" 

পোস্টটা সাধারণ, চোখে পড়ার সেরকম কারণ নেই তবে পোস্টটা অয়নের প্রোফাইলের ওয়ালে তারই এক বন্ধু কয়েক ঘন্টা আগেই পোস্ট করেছে। মুহূর্তেই অপ্রীতিকর ভাবনাগুলো চেপে ধরলো আমায়। উৎকন্ঠিত হয়ে তৎক্ষনাৎ ফোন লাগালাম অয়নকে। দুবার রিং হতেই ফোন তুলল সে, "হ্যাঁ বলো.."


আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করি, "কি হয়েছে তোমার? তুমি ঠিক আছ তো?"


অন্যপাশ থেকে নিরস গলায় উত্তর এলো, "কেন কি হয়েছে?"


তার উত্তরে বুঝতে দেরি নেই সে কথা ঘোরাচ্ছে। আমি বললাম, "কথা ঘোরাচ্ছ কেন? সত্যি করে বলো কি হয়েছে? অভ্র দা কেন 'গেট ওয়েল সুন' বলে পোস্ট করলো? তোমার কি কিছু হয়েছে?"


ওপাশ থেকে সাথে সাথে উত্তর এলো না। কিছুটা সময় নিয়ে বলল, "আরে... বাইকে ব্যালেন্স রাখতে পারিনি। তাই পড়ে গিয়েছিলাম এই আরকি। হাতের কনুই আর পায়ে গোড়ালির দিকে সামান্য কেটেছে, খুব বেশি না।"


মুহুর্তেই আত্মা কেঁপে উঠলো আমার। তটস্থ মন বিষিয়ে গেল অজানা এক ভয়ে। প্রশ্ন জাগলো মনে, কখন হলো এসব? আমাকে জানাল না কেন? বেশি আঘাত পেয়েছে কী? নিজের উৎকন্ঠিত ভাব দমন করে বললাম, "ভিডিও কলে আসবে একটু?"


অয়ন উত্তর দেওয়ার আগেই আমি কল কেটে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল করে বসলাম। কারণ এখন ওকে উত্তর দিতে বললেই না করে বসবে, প্রচন্ড একরোখা। অধিকার না খাটালে কোন কাজ আদায় করা যায় না। অয়ন সময় নিয়েই ফোনটা ধরল। পিঠে বালিশ দিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে আছে সে, বাড়িতেই যে আছে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। চোখে মুখে তার বিরক্তির সুক্ষ্ম রেখা। এবার ভাবনা বেড়ে গেলো আমার, ও তো বাড়িতে বসে থাকার মানুষ না। গুরুতর কিছু না হলে অফিস ভুলেও কামাই করে না। তার মানে চোট কী বেশি পেয়েছে? পুনরায় ধক করে উঠলো প্রাণটা। হটাৎ কপালের পাশে দু'টি ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ আড়াআড়িভাবে লেপ্টে থাকতে দেখে নিজের উৎকন্ঠা ভাব লুকাতে ব্যর্থ হলাম। জিজ্ঞেস করে উঠলাম, "কখন হলো এসব? আমায় জানালে না কেন? বেশি ব্যথা পেয়েছ তাই না? কপালও কেটেছে অথচ বলে চলেছে কনুই, গোড়ালিতে ব্যথা পেয়েছে। সত্যি করে বলো তো আর কোথায় কোথায় কেটেছে? ওষুধ খেয়েছ? মলম লাগিয়েছ? দেখি তো একটু।"


সে বিরক্তিবোধ করল বোধহয়। মুখ কুঁচকে উত্তর দিল, "সকালে অফিস যাওয়ার সময় হয়েছে। এখন ঠিক আছি আমি, আর ন্যাকামো করতে হবে না।"


তার শেষ কথাটুকু শুনে থম মেরে বসে রইলাম। তার কাছে আমার চিন্তা, অস্থিরতা ন্যাকামো লাগছে? আজ তার মেজাজ এতই চটে আছে যে আমার সাথেও খারাপ ব্যবহার করতে পিছপা হচ্ছে না? জানি মানুষটা রগচটা ধরনের তবে আগে কখনো আমাকে তার রূঢ়তার বা কঠোরতার শিকার হতে হয়নি। তবে আজ কেন? বেশি ব্যথা পেয়েছে বলে? আমি নিজের খারাপ লাগাটা একপাশে রেখে বললাম, "রাগ করছ কেন? আমি তো ক্ষতটা দেখতে চাইছিলাম শুধু। আর তোমাকে কতবার না বারণ করেছি বাইক-টাইক চালাতে.. কিন্তু তুমি আমার কথা শুনলে তো? এখন হলো তো এক্সিডেন্ট? ভুগছে এবার কে বলো তো? আর আমাকে ও একটিবার ফোন করে জানালে না। লুকোলে কথাটা। মনে রাখব আমি ও.."


হঠাৎ তার কি হলো কে জানে। ও চেঁচিয়ে বলে উঠলো, "আমি কি করবো না করবো তার কৈফিয়ত তোমায় দিতে হবে নাকি, আজব তো! এসব ন্যাকামো নেক্সট টাইম আমার সাথে করতে আসবে না তো। অসহ্য লাগে আমার।"


তার কথার প্রেক্ষিতে নীরব থেকে গেলাম। কথার উত্তর খুঁজে পেলাম না কোন। এতদিন যে মানুষটার কাছ থেকে ভালোবাসার মিষ্টি বুলি শুনেছি তার কাছ থেকে আজ তিক্ত কথাগুলো হজম করতেই পারছি না। অন্তঃস্থলে সুক্ষ্ম এক ব্যথার আবির্ভাব আঁচ করতে পারছি। চোখের কোণে জমে আসা জলটুকু আড়াল করতে দৃষ্টি নত করে মেঝেতে স্থির করলাম। অপমানে মুখ থমথমে হলেও জোরপূর্বক হাসি টেনে বললাম, "মা-বাবা না বীরভূম গিয়েছে জমির কাজে? তো দেখাশোনা কে করছে তোমার? আমি কি আসবো?"


অয়ন কিছু বলতে যাবে তার আগেই পাশ থেকে এক মেয়েলি কন্ঠস্বর ভেসে এলো। মেয়েটা বলছে, "অয়ন তোর জন্য স্যুপ এনেছি, খেয়ে নে। আমি একটু প..."


এদিকে আমি চোখ তুলে তাকাতেই ভিডিও কলে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি অয়ন ভড়কে উঠে চোখের ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলছেন। হয়তো সে ভুলে গিয়েছিল আমরা ভিডিও কলে আছি। তবে কন্ঠের মালিককে আমি স্পষ্ট চিনি, তিনি নীলিমা দি। অয়নের কোন এককালের প্রাক্তন। দুইজনই সমবয়সী, এক-দুই বছরের ডিফারেন্স। ওরা কলেজে থাকাকালীন নীলিমাদির সাথে প্রেমে পড়েছিল তবে সম্পর্কের মেয়াদ ছিল মাত্র দু'মাস। বোঝাপড়ায় সমস্যায় থাকায় তারা বেশি দূর এগোনোর সাহস পায়নি। সম্পর্ক শেষে তাদের সম্পর্ক পুনরায় বাকি আট-দশটা বন্ধুদের মতোই হয়ে যায়। অয়ন নিজেই জানিয়েছিল আমাকে ওদের বিষয়টা। কিন্তু আজ দু'জন একা এক বাড়িতে আছে দেখে অজানা ভয়ে গায়ে শিহরণ দিয়ে উঠলো। রাগ অভিমান গুলো ছুঁয়ে উঠলো আকাশ সমান। যতই তারা বলুক তারা শুধুই বন্ধু এখন, কিন্তু কোন এককালে তো তাদের মাঝে প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল। যদিও নীলিমা দির বিয়ে ঠিক হয়েছে তবুও সে যে অয়নের এক্স এই কথাটার কি পরিবর্তন করা সম্ভব? তাহলে তার পাশে এসময়ে তাকে সহ্য করি কী করে? রাগে মন-মাথা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। তার উপর অয়নের এই লুকোচুরি খেলা, কথা লুকানো, রুক্ষ ব্যবহার। সবকিছুতেই বিরক্তি লাগছিল। আমি ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটিয়ে তুলে বলি, "কে? নীলিমা দি না?"


আমার গলা শুনে অয়ন চোরা চোখে আমার দিকে তাকাল। নীলিমা দি চমকালো কী না জানা নেই, কারণ তার প্রতিচ্ছবি দেখা যায়নি। নীলিমাদি পাশ থেকে হয়তো অয়নকে বলল ফোনটা দিতে, অয়ন ফোনটা দিতে চাইল না বোধহয়, হাবেভাবে তাই বুঝলাম। কিন্তু নীলিমাদি একপ্রকার জোর করেই ফোনটা নিল। মুহূর্তেই আমার স্ক্রিনে নীলিমা দির মুখশ্রীটা ভেসে ওঠে। সে বলল, "কেমন আছো বিতস্তা?"


আমি নিজের অনুভূতি চাপা দিয়ে হাসি মুখেই বললাম, "ভালোই আছি, তুমি?"


"খুব যে ভালো আছি তা বলতে পারছি না। সকালেই এক্সিডেন্ট করেছি, বা হাতের অবস্থা ততটা ভালো না। অনেক খানি ছুলে গিয়েছে।"


নীলিমাদি হয়তো কথাগুলো সরল মনেই বলছিল তবে আমার কানে তীরের মত লাগে কথাটা। কৌতূহল হয়েই জিজ্ঞেস করি, "তোমরা দু'জনে কী একসাথে ছিলে?"


দিদি হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বললেন, "হ্যাঁ! আমার গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছিল বলে আমি অয়নকে বলেছিলাম আমাকে আজ অফিসে নামিয়ে দিতে। যাওয়ার পথেই হঠাৎ একটা অটো সামনে চলে আসায় অয়ন ব্যালেন্স হারায়, আর আমরা মাঝ রাস্তায় পরে যাই। আমার তো মাথায় হেলমেট ছিল বলে এত আঘাত পাইনি, বা হাতটাই ছুলেছে যা। তবে অয়নের কপালে, হাতে আর পায়ে ভালোই চোট পায়। খানিকটা কেটেওছে।"


আমি কোন প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগেই অয়নের ধমক কানে এলো, "মিলি মোবাইলটা দে আমার, আর তোকে না ভাস্কর নিতে আসবে? আসে নি এখনো নাকি? আসলে যা তো, দূর হ চোখের সামনে থেকে। এসব আদিখ্যেতা আর ভাল্লাগে না আমার।"


নীলিমা দি মুখ কালো করে অয়নের দিকে ফোনটা এগিয়ে দিতে গিয়ে বলল, "যাচ্ছি তো! সবসময় এমন করিস কেন? বললাম তো সরি।"


কথাটা বলে নীলিমা দি চলে যায়। অয়ন মুখের সামনে ফোনটা ধরতেই আমার ক্রন্দনরত মুখ দেখতে পায়। আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে এবার হয়তো তার রাগ পড়লো। সাথে সাথে বিচলিত কন্ঠে বলে উঠলো, "মানা, তুমি ভুল বুঝছো। এমন কিছু.."


আমি তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে অভিমানী হয়ে বলি, "যেহেতু তোমাকে দেখাশোনা করার মানুষ আছে সেহেতু আমার আসার প্রয়োজনবোধ করছি না। আর চিন্তা নেই, তোমাকে আমি আর ফোন করে বিরক্ত করবো না, রেস্ট করো। খামোখা একজন গুরুত্বহীন মানুষের ন্যাকামো আর সহ্য করতে হবে না।"


কথাটা বলেই ফোনটা রেখে দিলাম আমি। আঁখিপল্লব জুড়ে নামলো তীব্র বর্ষণের ঘনঘটা। ঝাপসা চোখেই দেখলাম অয়ন নিজের থেকে কল করছে। কিন্তু ততক্ষণে তার সাথে কথা বলার আগ্রহ, সমস্ত স্পৃহাই যে চলে গিয়েছে আমার। ফোনটা টেবিলের পাশে রেখে এক ভাবে তাকিয়ে রইলাম মেঝের দিকে। 



আমাদের দুইজনের ফেসবুকেই পরিচয় এবং সেখান থেকেই প্রেম। টানা তিনবছর প্রণয়ের পরে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি পরিশেষে। ছ'মাস আগেই দুই পরিবারের সম্মতিতে আমাদের ঘরোয়াভাবে বিয়ে হয়েছে, ফাইনাল পরীক্ষার পরেই আমায় নিয়ে যাওয়ার কথা। আমাদের সম্পর্ক থাকাকালীন কথা কাটাকাটি, মনমালিন্য হয়েছে অসংখ্যবার। কিন্তু অয়ন কখনো এতটা রুক্ষ, এত রূঢ় আচরণ করেননি আমার সাথে। দোষ আমার হলেও না। আমাকে আঘাত দিয়ে কথা বলার অভ্যাস তার নেই। অথচ সেই অভ্যাস আজ বদলে গেল? ভালোবাসা নাকি রঙ বদলায়, আসলেই যে বদলায়, এটাই তার নমুনা? কিভাবে পারল সে আজ আমায় এভাবে কথা শোনাতে? এক তো নিজের এক্সিডেন্ট কথা লুকোল, মিথ্যে বলল। দ্বিতীয় নীলিমাদিকে নিয়ে একাই বাড়িতে থাকল? এতটা অবনতি? যে মানুষটার ভালোবাসায় সিক্ত থাকা আমার অভ্যাস সে মানুষটার তুচ্ছতাচ্ছিল্য কিভাবে সহ্য করি আমি? 

আমার ভাবনার মাঝেই কখন যে সন্ধ্যা গড়িয়ে পড়লো কে জানে? তবে দূরে মন্দিরের মিষ্টি আরতির ধ্বনিতেই হুঁশ ফিরল আমার।



রাত তখন ক'টা বাজে জানা নেই৷ পুরো ঘর আচ্ছাদিত ভয়ঙ্কর আঁধারে৷ আকাশে মেঘ ডাকছে, বৃষ্টি নামবে হয়তো। ঠিক এমন সময় উতপ্ত পেটের কাছে কারো শীতল হাতের স্পর্শ অনুভব হলো, ধীরে ধীরে বাঁধন শক্ত হলো, কেউ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো আমায়। মুহূর্তেই তন্দ্রাভাব কেটে গিয়ে আতঙ্ক ভর করে বুকে। আমি পাশ ফিরে তাকানোর আগেই অতি শীতল অধরযুগলের আলতো ছোঁয়া অনুভব করতে পারি কাঁধের কাছে। ক্ষণেই যেন বিদ্যুৎ খেলে যায় সর্বাঙ্গে। দূর্বল শরীরেই পাশের মানুষটিকে নিজ থেকে দূরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু তার শক্তির সাথে পেরে উঠতে না পেরে যেই না চেঁচাতে যাবো তখনই ব্যক্তিটি আমার কানে ঠোঁট স্পর্শ করে বলে, "সরি বউ!"


কন্ঠটি কানে যাওয়া মাত্রই শান্ত হয়ে যাই আমি। একধাপেই তাপমাত্রা বেড়ে যায় দু ডিগ্রি। আনমনে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলাম, "ভুল শুনলাম নাকি? অয়ন কী সত্যি এখানে?" আমার ভাবনার মাঝেই অয়ন আবার বলে উঠল, "কী, কথা বলবে না? আর শরীরে এমন ভয়াবহ জ্বর বাঁধালে কী করে? তোমার তাপে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছি তো।"


দ্বিতীয়বারের মত তার আওয়াজ কর্ণগোচর হতেই ঠোঁট দুটো আপন শক্তিতেই আলাদা হয়ে এলো আমার। তার মানে মানুষটা সত্যি এসেছে? সে তার ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিয়েই কলকাতা টু বহরমপুরের সফর করে ফেলল? কেন করল? আমার জন্য কী? মনটা একটু হালকা হলো তখন। আমি হুট করে জিজ্ঞেস উঠলাম, "তুমি এখানে?"


সে পুনরায় কাঁধে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল, "তা না হলে আর কে?"


মুহূর্তের মধ্যেই বিকেলের ঘটনা মনে পড়ে যায় আমার। তার বলা প্রত্যেকটা কথা সূঁচের মতো বিঁধে উঠলো শরীরে। রাগ-অভিমানের পাল্লা ভারি হলো। আমি তার বাঁধন থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি শুরু করতেই সে আরও নিবিড়ভাবে আমায় জড়িয়ে ধরল, গা থেকে ভেসে এলো তার নিজস্ব গন্ধ। সে ধীর কন্ঠে বলল, "আমার শক্তির সাথে পারবে না তুমি মানা! এমনিতেই শরীর দূর্বল তোমার, ব্যথা লাগবে।"


আমি কন্ঠস্বর খানিকটা উঁচিয়েই বললাম, "কেন এসেছ তুমি? আমার ন্যাকামো দেখতে নাকি আরও কিছু বলার ছিল তোমার? থাকলে বলে বিদায় হোন, আমার মত ন্যাকার সাথে তোমার থাকা শোভা পায় না। তাই যার কাছে ছিলে তার কাছে ফিরে যাও।"


"তখন মাথার ঠিক ছিল না, তাই তোমার সাথে ভুলবশত অমন আচরণ করে ফেলেছি মানা; আ'ম সরি মানা।"


আমি কান্নারত অবস্থায় বলি, "সরি বললেই বুঝি সব ঠিক হয়ে যায়? তুমি আজ আমায় কত আঘাত করেছ তার কোন ধারণা আছে?"


সে অনুতপ্ত কন্ঠেই বলল, "আমি ইচ্ছে করে তোমায় আঘাত করতে চাইনি। আসলে তখনকার পরিস্থিতিটা বলে বোঝাতে পারবো না। আজকে এক্সিডেন্টের জন্য আমার একটা ইমপরট্যান্ট মিটিং মিস হয়ে যায় ফলে কোম্পানিকে কয়েক লাখ টাকার লোকসান ফেস করতে হয়। এর জন্য দুপুর নাগাদ বসের কাছে অকথ্য ভাষায় গালাগালি খেতে হয়, সাথে ওয়ার্নিং দেন, নেক্সট টাইম এমন হলে আমার চাকরিটাই যাবে। এই ঘটনার পর একরকম মন-মেজাজ খারাপই ছিল তার উপর নীলিমা তখন ওষুধপত্র গোছাতে গিয়ে তোমার দেওয়া ঘড়িটাকেও ভেঙে ফেলে। ঘড়িটা আমার কত প্রিয় ছিল সেটা একমাত্র আমিই জানি, দেড় বছর ইউস করেও সামান্য আঁচড় ও পড়তে দিইনি। অথচ ও কিনা ভেঙে ফেললো? মাথা বিগড়নো স্বাভাবিক কী না? আর তারমধ্যে এলো তোমার ফোন, তোমার ঘ্যানঘ্যান করা, বিষন্নতা ভালো লাগছিল না। এতগুলা প্রশ্ন করছিলে যে রাগ উঠে গেছিল আর আগে-পরের সবকিছুর রাগ গিয়ে পড়ে তোমার ওপর। তাই ওভাবে কথা শুনিয়ে ফেলি। কিন্তু পরে বুঝতে পারি যে কত বড় ভুল করে ফেলেছি- আর এর জন্য আমি সত্যি অনুতপ্ত।"


তার কথা শেষ হতেই শব্দ করে কেঁদে উঠি আমি। মান-অভিমান সব ভেঙ্গে চুরমার হয়ে পড়ে ফ্লোরে। অয়ন আমাকে তার বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, "কাঁদে না সোনা। সরি বলছি তো!"


আমি অস্পষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করি, "আমাকে কেন জানালে না আগে এক্সিডেন্টের কথা? লুকালে কেন?"


"টেনশনে ফেলতে চাইনি তোমায়।"


আমি নাক টেনে জিজ্ঞেস করি, "এই শরীর নিয়ে জার্নি কেন করলে? শরীর খারাপ লাগছে না?"


সে হেসে বলে, "এতক্ষণ লাগছিল কিন্তু তোমাকে বুকের মাঝে নেওয়ার পর থেকে আর লাগছে না। আর বউ রুষ্ট হয়ে থাকলে একটু-আধটু কষ্ট করাই যায়।"


"পরবর্তীকালে কখনো নীলিমাদির সাথে একা একই কোন বাড়িতে থাকলে একদম খুন করে ফেলবো তোমায়।"


"এইরকম দুঃসাহস আর এই বান্দা দেখাচ্ছে না গো। পরবর্তীকালে একা থাকতে হলে বউ নিয়ে থাকবো।"


হটাৎ করে একটা প্রশ্ন মাথায় আসতেই জিজ্ঞেস করলাম, "গেট কে খুলে দিল?"


অয়ন অপ্রস্তুত হয়ে বলল, "শ্বশুরমশাই! বুঝলে বাবা ভয়ঙ্কর রকমের অভিজ্ঞ একজন মানুষ৷ আমাকে দেখেই চট করে জিজ্ঞেস করে বসলেন, তার মেয়ের সাথে ঝগড়া করেছি কি-না? মানে বুঝতে পারছো একটা মানুষের কতটা এক্সপিরিয়েন্স হলে জামাইয়ের মুখ দেখেই বলে দেয় সমস্যাটা কি?"


আমি তার পেটে আস্তে করে গুঁতো মেরে বলি, "চুপ! শ্বশুর হয় তোমার। আর এত রাতে আসলে যে কেউ বুঝবে গল্পটা কি, হুঁ!"


অয়ন আকস্মিক ভাবে আমার গালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলল, "তা ম্যাডাম, জ্বর কমাতে একটু সাহায্য করবো নাকি?"


গলায় তখন তার বদমাইশি। আমি তার থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করে বলি, "খবরদার!"


কিন্তু একরোখা মানুষটা কি আর আমার কথার ধার ধারে? অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরজুড়ে ঘুরতে থাকে আমার অনুভূতিগুলো, যেন কারুর নজর না লাগে। লাগলেই বা কী, আমি আছি আর অয়ন আছে আমার সুখানুভূতির সাথে কিছুক্ষণ!..


[সমাপ্ত]



॥ সুখানুভূতির সাথে কিছুক্ষণ ॥


©চাটুজ্জে মশাই~


[অনেকদিন পর আবার কিছু লিখলাম। জানি না কেমন হয়েছে, যদিও ছন্নছাড়া লাগছে। এখন পাঠকরাই বলবে কেমন হয়েছে? সকলের দুষ্টু-মিষ্টি, ভালোবাসাময় ছোট-বড় মন্তব্যগুলা ভীষণভাবে মিস করছি। 

তা আজ সবাই একটু কষ্ট করে মন্তব্য করবেন কেমন? আবদার আমার। ভালোবাসা রইলো, নমস্কার 🙏🏼❤️]

2 comments:

  1. বেশ ভালো লেগেছে। তবে সম্পর্কের গল্প না বলে এরপর অন্য রকম কোনো গল্প পড়তে পারলে খুব ভালো লাগবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. গল্পের তো আর সীমা নেই, তাই লেখার ও কোনো সীমা করে উঠতে পারিনা! সম্পর্কের মতো জটিল এবং সুন্দর একটা জিনিস তার চেয়ে অন্যরকম লেখার বিষয় মাথায় আসলেই লিখবো, ধন্যবাদ পড়ার জন্য🙏🏼

      Delete