Saturday, 7 October 2023

সুইসাইডাল বক্স - পর্ব: ৭


 

'সুইসাইডাল বক্স'

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ৭

_____________________

..ওই বাড়ি থেকে মিতালী দি-র বের হতে বেশ ঝামেলাই পোহাতে হলো, অনেক নোংরা নোংরা কথাও শুনতে হলো তাকে৷ তারপরও যখন দিদি দৃঢ় ভাবে জানালেন তিনি চলেই আসবেন, তখন তারা তোতনকে আটকে দিতে চাইলো৷ তোতন তাদের মেয়ে, তোতনকে ছেড়ে মিতালী দি যেন যেখানে খুশি চলে যায়!


জীবনে প্রথমবার মিতালী দি বোধহয় সাহসের কাজটা করলো৷ সপাটে চড় লাগালো তোতনের কাকার গালে, তারপর বললো "শয়তান, তোর ঐ নোংরা হাতে আমার মেয়েকে ছুঁবি না .. তোর কপাল ভালো যে আমি তোকে পুলিশে দিচ্ছি না ..." মেয়েমানুষ আর মা এ দুয়ে বিস্তর তফাৎ৷ ঈশ্বর যখন কোন মেয়েকে মা বানান, তার মধ্যে যেন শক্তির আধার ঢেলে দেন৷ সন্তানের জন্য মা পারে-না এমন কোনও কিছু নেই এই পৃথিবীতে..


মিতালী দি চলে এলেন সকাল দশটায়৷ একটা ব্যাগ হাতে, যার মধ্যে তাদের দুজনের জন্য কিছু কাপড়-চোপড়.. আর কিছুই নেই৷ মা আর সেই ভাড়া বাড়ির আন্টি-আঙ্কেল মিলে তাদের জন্য একটা তোষক, একটা হাড়ি, কড়াইয় খুন্তি ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দিলেন৷ মিতালী দির যেন নতুন যুদ্ধ শুরু হলো; বেঁচে থাকার যুদ্ধ, বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ.... মরে যেতে তো সবাই পারে, বেঁচে থাকতে পারে ক'জন? বাঁচার জন্য লড়াই করতেই হয়৷ একেকজনের লড়াইটা হয় একেক রকমের৷ কারোটা প্রকট আবার কারও টা প্রচ্ছন্ন .. কিন্তু কারও জীবনই সহজ সরল গল্পের মতো হয় না৷ বাস্তব জীবনে সিনেমার মতো তিন ঘণ্টার শেষে ভিলেন ধরা পড়ে না৷ ভিলেনরাই হয়তো জিতে যায় বারবার .. তারপরও যুদ্ধ করে করে নিজেকে আরো শক্তিশালী মানসিকতার করতে যে পারে সেই হলো মহানায়ক অথবা মহানায়িকা..


মিতালী দির বিজনেসও শুরু করা হলো৷ ফেসবুকে পেজও ওপেন করা হলো, "তোতন ও টুকিটাকি" নাম দিয়ে৷ এলাকাতেই একটা স্কুলে তোতনতে ভর্তি করানো হলো ক্লাস ফোরে৷ বছরের মাঝামাঝি সময়, তাই খুব ভালো স্কুলে ভর্তি করানো গেলো না৷ তাতে অবশ্য মিতালী দির কোন মন খারাপ নেই, বরং তিনি বেশ হাসিখুশিই আছেন৷ মায়ের সাথে সাথে বেশ ভাব হয়েছে তার৷ মায়ের জন্যেও ভালো হয়েছে, আমি সময় দিতে না পারলেও এখন তোতন আর মিতালী দি, মা-কে সময় দেয়৷ একদিন দেখলাম মা বেশ জমিয়ে আমাদের বাড়ির গল্প করছেন...


"জানো তো, সে এক বিরাট হট্টগোলের ব্যাপার.. আমার শ্বশুর ওদের নাম রাখবেন রণজয় আর সমাপ্তি আর ডাকনাম রণি আর তিতলী.. বাড়ির সবার-ই তাতেই মত৷ কিন্তু তোমার মেসোমশাই গোঁ ধরে বসেছে৷ সে তার ছেলে-মেয়েদের নাম রাখবে রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থের নামে... কবি মানুষ ছিলেন কিনা! তিনি ছেলে-মেয়েদের নাম রাখবেন অমিত আর অমৃতা .. আমার শ্বশুর রাগে সে কী চিল্লামেল্লি শুরু করে দিয়েছেন৷ সবচেয়ে বিপদে পড়েছে আমার শ্বাশুড়ি, না পারছেন ছেলের কথা রাখতে, না পারছেন স্বামীর কথা ফেলতে! শেষে আমাকে এসে বললেন, বৌমা ওরা দুজনই গোঁয়ার, তুমি বরং মাঝের একটা পথ বাতলে দাও ... আমি আর কি বলবো! অনেক ভাবলাম, অনেক ভাবলাম .. ভেবেচিন্তে আমার শ্বশুরের কাছে গিয়ে বললাম, "বাবা, আমার একটা কথা আছে .. আমি চাই আমার ছেলে-মেয়েরা তাদের ঠাকুর্দার দেওয়া নামও পাক আর বাবার দেওয়া নামটাও পাক, দুটো ই থাকুক৷ ওদের নাম হোক অমিত/রণি, আর সমাপ্তি/তিতলী... আমার শ্বশুর আমাকে খুব স্নেহ করতেন৷ আমার কথা ফেললেন না ... রবীন্দ্রনাথের 'শেষের কবিতা' আর 'তিনকন্যা'-র মূল চরিত্র অনুযায়ী আমার পুত্র-কন্যাদ্বয়ের নাম হলো.. হা হা হা .."


আমি মুগ্ধ হয়ে শুনলাম .. আমার মা হাসছে! কতদিন পর ঠাকুর আমাদেরকে একটুখানি দয়া করেছে .. আমি মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানালাম ঠাকুরের কাছে৷


এ সপ্তাহে নতুন কোনো কেস এলো না একটাও৷ এটাও আমার জন্য আনন্দের৷ ভাবলাম সামসুল হকের খোঁজ নেওয়া যাক৷ ছেলেটা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাচ্ছে তো..? 


সার্ফ করতে গিয়ে দেখলাম "জোনাকির আলো" আইডিটা ডিএক্টিভ করা৷ চিন্তায় পরে গেলাম একটু .. আমার সেই পরিচিত সাইকিয়াট্রিস্ট কে কল করলাম৷ উনি বললেন সৌম্য কাউন্সেলিং করাচ্ছে এখন, দুটো সেশন হয়েছে .. তার কথা শুনে ভালোই লাগলো, কিন্তু আরো একবার আমার সৌম্যর সাথে কথা বলা দরকার .. কিভাবে বলবো জানি না .. ওর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করিনি আমি মনের ভুলেই ..


এর মধ্যেই পড়লাম আরেক ঝামেলায়৷ পুলিশি ঝামেলা! কেউ একজন সাইবার ক্রাইমে মামলা করেছে আমার নামে৷ আমি নাকি সুইসাইডকে প্রোমোট করছি.. 

ব্যস, আমি পড়লাম অথৈ জলে! এই অবস্থায় কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না.. 


মনে পড়লো সুমনা রায়ের কথা, একজন স্বনামধন্যা উকিল৷ আমার 'সুইসাইডাল বক্স' গ্রুপের প্রথম দিককার কেস ছিলো ওনারটা.. উপায় না পেয়ে ওনাকেই কল করলাম৷ আমার কথা শুনেই ছুটে আসলেন তিনি আমার সাহায্য করতে৷ একদম বিপদের মুখ থেকে আমাকে বাঁচালেন৷ তবে গ্রুপটি বন্ধ করে দিতে হলো আমার৷ আগের সবকটা সল্ভ করা কেসের প্রমান দেখিয়েও গ্রুপটা বাঁচাতে পারলাম না আমি!


বলা যায় আমি ভেঙেই পড়লাম এবার৷ আমার জীবনের উদ্দেশ্য যেন হঠাৎ করেই হারিয়ে গেলো৷


*******


রিমার সেই দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ছে ..অনার্সের প্রথম বছর৷ শৌভনিক ছিলো এক ব্যাচ সিনিয়র৷ প্রথমে কথা হয়েছিলো নোটের জন্য৷ বেশ সাবলীলভাবে দুজনের কথা হতো..


রিমা প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো৷ একদিন শৌভনিক-ই ওকে বললো "রিমা, তোমাদের ক্লাসের সমাপ্তি নামের মেয়েটাকে আমার খুব পছন্দ, একটু খোঁজ নাও না, ওর কি কাউকে পছন্দ? বা ও কারো সাথে রিলেশন আছে না কি!"


রিমা শৌভনিকের সেই কথা শুনে ভেতরে ভেতরে গুমড়ে গুমড়ে কেঁদে উঠেছিলো৷ ক্লাসের কারো সাথেই তার বন্ধুত্ব নেই৷ সমাপ্তি মেয়েটাকে সে আগে কখনও খেয়ালও করেনি৷ এবার খেয়াল করলো ... ভীষণ দুরন্ত, ছটফটে একটা মেয়ে সমাপ্তি৷ সারাক্ষন হৈ চৈ করছে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে, গলা ছেড়ে গান গাইছে.. ক্লাসে তার বন্ধু-বান্ধবীর অভাব নেই৷ রিমা সবসময় খেয়াল করতো সমাপ্তি কে .. আর মনকে বোঝাতে চাইতো মেয়েটা সুন্দর, দুরন্ত, চটপটে, শৌভনিক তো ওকেই ভালোবাসবে, এটাই স্বাভাবিক!


মনকে বোঝাতে চাইলেই কি আর মন বুঝবে! মন বুঝতো না.. ওর প্রচন্ড হিংসা হতো৷ বাড়ি ফিরে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাঁদতো৷ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার মতো কেউ ছিলো না৷ তাকে সান্ত্বনা দেবারও কেউ ছিলো না, ছিল না তার কষ্টগুলোতে ভালোবাসার মলম লাগিয়ে দেবারও কেউ...


ধীরে ধীরে সময় গড়াল, সেকেন্ড সেমিষ্টারের শুরুতেই সবাই জেনে গেলো সমাপ্তি আর শৌভনিকের প্রেম কাহিনী৷ ক্যাম্পাসে তাদের সারাক্ষন একসাথে দেখা যেতো৷ ওরা আবার একসাথে আড্ডাও দিতো সবার সাথে৷ দূর থেকে ওদের দেখতো রিমা! নিজেকে সে আরো চুপচাপ করে ফেললো৷ 


নিয়মিত ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দিলো৷ পড়াশোনা ছেড়ে দিলো৷ শুধু পরীক্ষার আগে আগে ক্লাসে যেতো৷ রেজাল্ট খারাপ হয়ে গেলো৷ 


সেকেন্ড ইয়ার শুরু হলো এভাবেই৷ ইয়ার চেঞ্জের রেজাল্ট দেখে রিমার বাবা খুব রাগারাগি করলেন৷ রিমা তাই চেষ্টা করলো সব ভুলে পড়ায় মন দিতে ... পারলো না! এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করতো সে সমাপ্তি আর শৌভনিক কে, কিন্তু সম্ভব হয়ে উঠতো না! বারবার যেন ওরা দুজনই চোখের সামনে আসতো ঘুরে ফিরে! 


এক তরফা প্রেম বড্ড বেশি ভয়ঙ্কর হয়৷ এক তরফা প্রেমের আগুনের উত্তাপও থাকে অনেক বেশি৷ সেই উত্তাপ একজন মানুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেয়.. 


রিমাও জ্বলে-পুড়ে একদম শেষ হয়ে গেছিলো ..


চলবে..


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #পর্ব_৭

Saturday, 30 September 2023

'সুইসাইডাল বক্স' (পর্ব:৬)


 

'সুইসাইডাল বক্স'

উষস চট্টোপাধ্যায় 

পর্ব : ৬

_____________________


ব্যালকনি তে বসে ফেসবুক স্ক্রলিং করছিলো রিমা৷ আবার ঐ গ্রুপটা চোখের সামনে পড়ে তার৷ রিমা মোবাইলটা বন্ধ করে রাখে৷ এই গ্রুপটা দেখলেই তার অস্বস্তি হয়, মনে হয় সবাই ওর মনের কথা বুঝে ফেলেছে! সবাই বোধহয় সবটা জানে! 


রকিং চেয়ারে বসে দোল খেতে খেতে রিমা চোখ বন্ধ করে ফেলল; তারপর মনে মনে ভাবতে থাকে সে আসলে ঠিক কী কারনে সুইসাইড করতে চায়! সে ভীষণ একা, বাবার স্নেহবর্জিত ... এটাই কি একমাত্র কারন? না, এর সবচেয়ে বড় কারন অপরাধবোধ৷ একটা গোপন পাপে পাপী রিমা৷ নিজেকে তাই নিজেই ক্ষমা করতে পারে না সে ...যতবার ঐ দূর্ঘটনার কথা মনে পড়ে, ততবার রিমার নিজেকে সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে এই পৃথিবী থেকে৷ ব্যাপারটা কি ভোলার চেষ্টা রিমা করেনি! করেছে...বহুবার করেছে... কিন্তু আজ অবধি পারেনি, আজকাল রিমার মনে হয় পারবেও না৷


শৌভনিক .... ফর্সা, গোলগাল মুখ, বড় বড় কবিতা বলা চোখ ..কোঁকড়া চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ .. আচ্ছা এমন একটা ছেলের প্রেমে পড়া কি খুব অন্যায় ছিলো! শৌভনিকের প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছিলো রিমা .. আর শৌভনিক! সে ছিলো সমাপ্তির প্রেমে অন্ধ৷ দুজন ছিলো কলেজের সবচেয়ে পরিচিত জুটি৷ বেশ মানাতো দুজনকে৷ সবার প্রিয় ছিলো ওরা, শুধু রিমা বাদে! রিমা সহ্য করতে পারতো না ওদের .. অসহ্য লাগতো রিমার! তারপরেও সহ্য করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো৷ 


কিন্তু, সেদিন যখন লাইব্রেরির পেছন দিকটাতে শৌভনিকের বুকের মধ্যে লতার মতো করে লেপ্টে থাকতে দেখলো সমাপ্তি কে, সেদিন নিজেকে আর কনট্রোল করতে পারেনি রিমা! যে গল্পটায় তার হবার কথা সে ভেবে আসছে শয়নে-স্বপনে, সেই গল্পের নায়িকা যখন অন্য কেউ হয় তা ঠিক কতক্ষন সহ্য করতে পারা যায়? যারা সহ্য করতে পারে তারা বোধহয় মহান মানুষ, রিমা সাধারন মানুষ, সে মহান হতে চায়না৷ রিমা পারেনি ...


অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে রিমার৷ ভয়াবহ সেই গোপন পাপের স্মৃতি রিমাকে বাঁচতে দিচ্ছে না৷ নিজেকে নোংরা মনে হয় ওর .. আচ্ছা তার কি ঐ সুইসাইডাল বক্সটা দরকার? এর আগেও সে চেষ্টা করেছে কয়েকবার, সফল হতে পারেনি, এই সুইসাইডাল বক্স কি তাকে নিশ্চিত মৃত্যু দিতে পারবে! সেখান থেকেও তাকে ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসতে হবে না তো?


******


ছোট্ট একটা ফুলের মতো ফুটফুটে মেয়েকে নিয়ে মিতালী গোস্বামী দেখা করতে এসেছেন৷ এ বয়সের মেয়েরা হবে ছটফটে ফড়িং এর মতো, অথচ মিতালী-র কন্যাটি বড্ড বেশিই চুপচাপ৷ 


আমাকে দেখে মিতালী বললেন 


—আপনিই কি আঁধার?


—আজ্ঞে হ্যাঁ 


—ও.. আপনার আসল নামটাকি বলা যাবে? 


—আমার ডাক নাম রণি৷ আপনি আমাকে রণি বলে ডাকতে পারেন .. 


—আচ্ছা৷ আমার বক্সটি কি এনেছেন? আমি টাকা নিয়ে এসেছি.. 


—আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই ৷ আপনি যদি আমাকে ভাই ভাবেন, আমি কি কথাগুলো আপনাকে বলতে পারি.. যদি আপনি অভয় দেন তবেই..!


—ভাই ভাবলে আর আপনি বলছো কেন? তুমি বলো৷ আর তুমি আমার বেশ ছোটই হবে৷ আমি বেশিক্ষন কাউকে আপনি আজ্ঞে করতে পারিনা৷


—বেশ দিদি, আমি আসলে কোন সুইসাইড বক্স বিক্রি করি না৷ আমি চেষ্টা করি মানুষদের সুইসাইড থেকে ফেরাতে৷ টাকার কথাটা বলি যাতে মানুষ কিছুদিন সুইসাইডের চিন্তা বাদ দিয়ে টাকার চিন্তায় থাকে৷ তুমি বলো ..এই কটাদিন তোমার মাথায় কোন চিন্তাটা ছিলো?


—টাকা জোগাড়ের চিন্তা.. কিন্তু রণি, আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম! তুমি এভাবে আমাকে ঠকালে?


—দিদি, আমার কথাটা শেষ করতে দাও প্লিজ৷ তারপর যা বলবে আমি মাথা পেতে নেবো ..


—বলো, কত মানুষের কত কথাই তো শুনলাম! তুমিও বলো না হয়..


—আমি সাধারণত কোন কেস সল্ভ করার জন্য তার আপনজনদের সাহায্য নিই, কিন্তু এইবার আমি আমার সেই পুরোনো পদ্ধতিতে কাজ করতে পারিনি৷ দিদি, আমি খুঁজে পেতেও তোমার কোনও আপনজন খুঁজে পাইনি৷ কিন্তু দিদি, তোমার এই ছোট্ট শান্তু টুনটুনিটার আপনজন খুঁজে পেয়েছি, যে ওকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে, যে ওর পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে পারে ..


— ক.. কে, কে!


—দিদি, তুমি!


—হা হা হা ! রণি, হাসালে তুমি আমাকে .. ঠাট্টা করছো তুমি আমার সাথে?


—না মিতালী দি, ঠাট্টা আমি করি না .. যা বলছি ভেবেই বলছি৷ দিদি, মেয়ের জন্য ঢাল হয়ে তোমাকেই দাঁড়াতে হবে৷ একটাবার চিন্তা করে দেখো ... এই নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে তুমি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে? একটাবার যুদ্ধের চেষ্টাও করবে না? 


—আমার কী করার আছে রণি!?


—আমি ভেবে রেখেছি৷ বলছি .. শোনো, তোমার হাতে আছে দশহাজার টাকা৷ প্রথমে তুমি মামনিকে নিয়ে ঐ বাড়িটা ছাড়বে৷ একটা ভাড়া বাড়ি আমি দেখে রেখেছি৷ একটা বয়স্ক দম্পতি থাকে৷ একটা রুম ভাড়া দেয়৷ সুন্দর রুম, রুমের সাথে বাথরুম আর বারান্দা আছে৷ ভাড়া তিনহাজার টাকা প্রতিমাসে৷ ওনারা এক মাসের ভাড়া এডভান্স রাখেন৷ কিন্তু আমি ওনাদের বুঝিয়ে দু'হাজার এডভান্সে দেবো বলেছি৷ এরপর তোমার কাছে থাকলো আট হাজার টাকা৷ এর ভেতর থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তুমি কাপড়ের ব্যবসা শুরু করবে৷ কিছু কাপড় এনে তাঁতীদের থেকে আরো ছবি নিয়ে আসবে৷ অনলাইন প্লাস অফলাইনে বিভিন্ন স্কুলের সামনে গিয়ে গার্জিয়ানদের কাছে বিক্রির চেষ্টা করবে৷ আমরা প্রথমেই নেবো একদম কমের মধ্যে বাটিক, ব্লক, স্ক্রিন প্রিন্টের থ্রিপিস৷ লাভও রাখবো খুব সীমিত৷ এগুলো এখন বেশ ভালো চলে৷ আমি সব খোঁজ খবর করে এনেছি৷ ছ'টা মাস তুমি শুধু আমাকে বিশ্বাস করো, দেখো ...তারপরও কিছু না হলে তুমি যা বলবে মাথা পেতে নেবো৷ 


—যত সহজে বললে, এত সহজে কী সম্ভব!


—নিশ্চয় সম্ভব৷ এখন ওঠো, তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো৷


—কোথায়?


—আমাদের বাড়িতে৷ আমার মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে৷


আমার মা মিতালী গোস্বামী-র জন্য অপেক্ষা করে আছেন৷ মা এতকিছু জানেন না৷ মা কে শুধু বলেছি, "একজন বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করছি মা, তুমি পাশে থেকো৷" 


মিতালী দির মেয়ের নাম মৌলি, ডাকনাম তোতন! আমার মায়ের সাথে তোতনের বেশ ভাব হয়ে গেলো৷ আমাদের বাড়ির কাছেই মিতালী দিদির জন্য বাড়ি দেখেছি৷ তাকে সেই বাড়িও দেখিয়ে আনলাম ... তারপর দিদি একসময় চলে গেলেন ... যাবার সময় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন "বসার ঘরের ছবিটা কি কম্পিউটারে ফটোশপ করেছো? একই মুখ খালি ছেলে আর মেয়ের তফাৎ.. দারুণ হয়েছে... মনে হচ্ছে পাশাপাশি দুটো জেন্ডারে তুমি!"


আমি বললাম "দিদি, ওটা আমার জমজ বোনের ছবি৷ ও দু'বছর আগে সুইসাইড করেছে৷ ওর জন্যই আমি আঁধার! ওর মৃত্যু ঠেকাতে পারিনি, তাই চেষ্টা করে যাই যতটা সম্ভব মানুষের সমস্যার সমাধান করতে ..."


মিতালী দি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, "রণি, তুমি পারবে ..নিশ্চয় পারবে ... আগামীকাল আমি চলে আসবো৷ সকাল সকালই চলে আসবো৷ পাশেই থেকো আমার৷ তুমি থাকলে তোতনের ভার আমি নিতে পারবো, তোতনের ঢাল আমিই হতে পারবো...ভগবান চাইলে ঠিক পারবো .."


আমাকে জড়িয়ে ধরলেন মিতালী দি৷ আমার আবার মনে হলো আমাকে জড়িয়ে ধরেছে তিতলী! 


আচ্ছা ওপারে বসে কী তিতলী দেখতে পায়, আমি, মা, আমরা যে সারাটাক্ষন ওকে মিস করি! পাগলের মত মিস করি! 


*******


রিমার বাবা গেছেন দেশের বাইরে৷ তার কি নাকি জাহাজে কোন সমস্যা হয়েছে, সেই জাহাজের পেছনেই ছুটেছেন তিনি৷ রিমা আজ এসব চিন্তা বাদ দিয়ে একটু মন ভালো করার চেষ্টা করছে৷ 


মায়ের আলমারি খুলে একটা লাল শাড়ি বের করে রিমা৷ তারপর রান্নাঘরে গিয়ে রাঁধুনি কে বলে আসে ভালো করে কষিয়ে মাংস, মুগের ডাল আর ভাত রান্না করতে৷ সাথে টমেটোর চাটনি৷ বলে এসে নিজের ঘরে না গিয়ে মায়ের ঘরেই ঢোকে৷ মায়ের ঘরটা এখনও আগের মতই আছে৷ মায়ের ড্রেসিং টেবিল, তার সাজ-গোজের জিনিসপত্র .. অবশ্য সাজগোজের জিনিস বলতে শুধু কয়েকটা কাজল, আর একটা হালকা কালারের লিপস্টিক৷ এসবের এক্সপায়ারি থাকার কথা না, তবু.. রিমা জানে, আনোয়ারা তার আশেপাশেই আছে, তাই আনোয়ারা কে ডেকে তার ঘর থেকে তার কাজল আর লিপস্টিকটা আনতে বলে৷ আজ সে মায়ের মত করেই সাজবে ..


সময় নিয়ে সাজে রিমা৷ সুন্দর করে শাড়ি পড়ে, চোখে কাজল দেয়, ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক দেয় ...তারপর মুগ্ধ হয়ে নিজেকে দেখে সে৷ ওর বেশ ভালো লাগতে থাকে৷ এভাবে সেজেগুজেই দীর্ঘদিন পর সে ডাইনিং টেবিলে বসে নিজের সব পছন্দের খাবার তৃপ্তি করে খায়৷


তারপর ঘরে এসে নিজেকে এলিয়ে দেয় বিছানায় ....

ঠিক তখন ওর মনে হয় শাড়িটা জঞ্জাল লাগছে ...শাড়ি খুলে একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার পরে ফেলে সে৷ তারপর আবার ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে ... এই রিমা একটু আগে আনন্দে থাকা রিমা না..বরং এ সেই পুরোনো ডিপ্রেসড রিমা..


সাজ-গোজ বা খাওয়া-দাওয়া ডিপ্রেশন কমায় না৷ যখন কাউকে বলা হয় খুব মন খারাপ হলে আপনি কি করেন? বেশিরভাগ মেয়েই উত্তর দেয়, আমি তখন সাজি, বা আমি তখন খাই ... এসবই আসলে নিজেই নিজেকে বোকা বানানো, ধোঁকা দেওয়া৷ সাময়িকভাবে নিজেকে ডাইভার্ট করা৷ কিন্তু পরিপূর্ন সমাধান এটা নয়৷ আসলে আমরা ক'জনই সমস্যার পরিপূর্ন সমাধান চাই! আমরা বোধহয় দুঃখবিলাস করতেই বেশি ভালোবাসি ....


চলবে..


#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #ষষ্ঠ_পর্ব