'সুইসাইডাল বক্স'
উষস চট্টোপাধ্যায়
পর্ব : ৭
_____________________
..ওই বাড়ি থেকে মিতালী দি-র বের হতে বেশ ঝামেলাই পোহাতে হলো, অনেক নোংরা নোংরা কথাও শুনতে হলো তাকে৷ তারপরও যখন দিদি দৃঢ় ভাবে জানালেন তিনি চলেই আসবেন, তখন তারা তোতনকে আটকে দিতে চাইলো৷ তোতন তাদের মেয়ে, তোতনকে ছেড়ে মিতালী দি যেন যেখানে খুশি চলে যায়!
জীবনে প্রথমবার মিতালী দি বোধহয় সাহসের কাজটা করলো৷ সপাটে চড় লাগালো তোতনের কাকার গালে, তারপর বললো "শয়তান, তোর ঐ নোংরা হাতে আমার মেয়েকে ছুঁবি না .. তোর কপাল ভালো যে আমি তোকে পুলিশে দিচ্ছি না ..." মেয়েমানুষ আর মা এ দুয়ে বিস্তর তফাৎ৷ ঈশ্বর যখন কোন মেয়েকে মা বানান, তার মধ্যে যেন শক্তির আধার ঢেলে দেন৷ সন্তানের জন্য মা পারে-না এমন কোনও কিছু নেই এই পৃথিবীতে..
মিতালী দি চলে এলেন সকাল দশটায়৷ একটা ব্যাগ হাতে, যার মধ্যে তাদের দুজনের জন্য কিছু কাপড়-চোপড়.. আর কিছুই নেই৷ মা আর সেই ভাড়া বাড়ির আন্টি-আঙ্কেল মিলে তাদের জন্য একটা তোষক, একটা হাড়ি, কড়াইয় খুন্তি ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দিলেন৷ মিতালী দির যেন নতুন যুদ্ধ শুরু হলো; বেঁচে থাকার যুদ্ধ, বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ.... মরে যেতে তো সবাই পারে, বেঁচে থাকতে পারে ক'জন? বাঁচার জন্য লড়াই করতেই হয়৷ একেকজনের লড়াইটা হয় একেক রকমের৷ কারোটা প্রকট আবার কারও টা প্রচ্ছন্ন .. কিন্তু কারও জীবনই সহজ সরল গল্পের মতো হয় না৷ বাস্তব জীবনে সিনেমার মতো তিন ঘণ্টার শেষে ভিলেন ধরা পড়ে না৷ ভিলেনরাই হয়তো জিতে যায় বারবার .. তারপরও যুদ্ধ করে করে নিজেকে আরো শক্তিশালী মানসিকতার করতে যে পারে সেই হলো মহানায়ক অথবা মহানায়িকা..
মিতালী দির বিজনেসও শুরু করা হলো৷ ফেসবুকে পেজও ওপেন করা হলো, "তোতন ও টুকিটাকি" নাম দিয়ে৷ এলাকাতেই একটা স্কুলে তোতনতে ভর্তি করানো হলো ক্লাস ফোরে৷ বছরের মাঝামাঝি সময়, তাই খুব ভালো স্কুলে ভর্তি করানো গেলো না৷ তাতে অবশ্য মিতালী দির কোন মন খারাপ নেই, বরং তিনি বেশ হাসিখুশিই আছেন৷ মায়ের সাথে সাথে বেশ ভাব হয়েছে তার৷ মায়ের জন্যেও ভালো হয়েছে, আমি সময় দিতে না পারলেও এখন তোতন আর মিতালী দি, মা-কে সময় দেয়৷ একদিন দেখলাম মা বেশ জমিয়ে আমাদের বাড়ির গল্প করছেন...
"জানো তো, সে এক বিরাট হট্টগোলের ব্যাপার.. আমার শ্বশুর ওদের নাম রাখবেন রণজয় আর সমাপ্তি আর ডাকনাম রণি আর তিতলী.. বাড়ির সবার-ই তাতেই মত৷ কিন্তু তোমার মেসোমশাই গোঁ ধরে বসেছে৷ সে তার ছেলে-মেয়েদের নাম রাখবে রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থের নামে... কবি মানুষ ছিলেন কিনা! তিনি ছেলে-মেয়েদের নাম রাখবেন অমিত আর অমৃতা .. আমার শ্বশুর রাগে সে কী চিল্লামেল্লি শুরু করে দিয়েছেন৷ সবচেয়ে বিপদে পড়েছে আমার শ্বাশুড়ি, না পারছেন ছেলের কথা রাখতে, না পারছেন স্বামীর কথা ফেলতে! শেষে আমাকে এসে বললেন, বৌমা ওরা দুজনই গোঁয়ার, তুমি বরং মাঝের একটা পথ বাতলে দাও ... আমি আর কি বলবো! অনেক ভাবলাম, অনেক ভাবলাম .. ভেবেচিন্তে আমার শ্বশুরের কাছে গিয়ে বললাম, "বাবা, আমার একটা কথা আছে .. আমি চাই আমার ছেলে-মেয়েরা তাদের ঠাকুর্দার দেওয়া নামও পাক আর বাবার দেওয়া নামটাও পাক, দুটো ই থাকুক৷ ওদের নাম হোক অমিত/রণি, আর সমাপ্তি/তিতলী... আমার শ্বশুর আমাকে খুব স্নেহ করতেন৷ আমার কথা ফেললেন না ... রবীন্দ্রনাথের 'শেষের কবিতা' আর 'তিনকন্যা'-র মূল চরিত্র অনুযায়ী আমার পুত্র-কন্যাদ্বয়ের নাম হলো.. হা হা হা .."
আমি মুগ্ধ হয়ে শুনলাম .. আমার মা হাসছে! কতদিন পর ঠাকুর আমাদেরকে একটুখানি দয়া করেছে .. আমি মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানালাম ঠাকুরের কাছে৷
এ সপ্তাহে নতুন কোনো কেস এলো না একটাও৷ এটাও আমার জন্য আনন্দের৷ ভাবলাম সামসুল হকের খোঁজ নেওয়া যাক৷ ছেলেটা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাচ্ছে তো..?
সার্ফ করতে গিয়ে দেখলাম "জোনাকির আলো" আইডিটা ডিএক্টিভ করা৷ চিন্তায় পরে গেলাম একটু .. আমার সেই পরিচিত সাইকিয়াট্রিস্ট কে কল করলাম৷ উনি বললেন সৌম্য কাউন্সেলিং করাচ্ছে এখন, দুটো সেশন হয়েছে .. তার কথা শুনে ভালোই লাগলো, কিন্তু আরো একবার আমার সৌম্যর সাথে কথা বলা দরকার .. কিভাবে বলবো জানি না .. ওর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করিনি আমি মনের ভুলেই ..
এর মধ্যেই পড়লাম আরেক ঝামেলায়৷ পুলিশি ঝামেলা! কেউ একজন সাইবার ক্রাইমে মামলা করেছে আমার নামে৷ আমি নাকি সুইসাইডকে প্রোমোট করছি..
ব্যস, আমি পড়লাম অথৈ জলে! এই অবস্থায় কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না..
মনে পড়লো সুমনা রায়ের কথা, একজন স্বনামধন্যা উকিল৷ আমার 'সুইসাইডাল বক্স' গ্রুপের প্রথম দিককার কেস ছিলো ওনারটা.. উপায় না পেয়ে ওনাকেই কল করলাম৷ আমার কথা শুনেই ছুটে আসলেন তিনি আমার সাহায্য করতে৷ একদম বিপদের মুখ থেকে আমাকে বাঁচালেন৷ তবে গ্রুপটি বন্ধ করে দিতে হলো আমার৷ আগের সবকটা সল্ভ করা কেসের প্রমান দেখিয়েও গ্রুপটা বাঁচাতে পারলাম না আমি!
বলা যায় আমি ভেঙেই পড়লাম এবার৷ আমার জীবনের উদ্দেশ্য যেন হঠাৎ করেই হারিয়ে গেলো৷
*******
রিমার সেই দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ছে ..অনার্সের প্রথম বছর৷ শৌভনিক ছিলো এক ব্যাচ সিনিয়র৷ প্রথমে কথা হয়েছিলো নোটের জন্য৷ বেশ সাবলীলভাবে দুজনের কথা হতো..
রিমা প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো৷ একদিন শৌভনিক-ই ওকে বললো "রিমা, তোমাদের ক্লাসের সমাপ্তি নামের মেয়েটাকে আমার খুব পছন্দ, একটু খোঁজ নাও না, ওর কি কাউকে পছন্দ? বা ও কারো সাথে রিলেশন আছে না কি!"
রিমা শৌভনিকের সেই কথা শুনে ভেতরে ভেতরে গুমড়ে গুমড়ে কেঁদে উঠেছিলো৷ ক্লাসের কারো সাথেই তার বন্ধুত্ব নেই৷ সমাপ্তি মেয়েটাকে সে আগে কখনও খেয়ালও করেনি৷ এবার খেয়াল করলো ... ভীষণ দুরন্ত, ছটফটে একটা মেয়ে সমাপ্তি৷ সারাক্ষন হৈ চৈ করছে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে, গলা ছেড়ে গান গাইছে.. ক্লাসে তার বন্ধু-বান্ধবীর অভাব নেই৷ রিমা সবসময় খেয়াল করতো সমাপ্তি কে .. আর মনকে বোঝাতে চাইতো মেয়েটা সুন্দর, দুরন্ত, চটপটে, শৌভনিক তো ওকেই ভালোবাসবে, এটাই স্বাভাবিক!
মনকে বোঝাতে চাইলেই কি আর মন বুঝবে! মন বুঝতো না.. ওর প্রচন্ড হিংসা হতো৷ বাড়ি ফিরে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাঁদতো৷ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার মতো কেউ ছিলো না৷ তাকে সান্ত্বনা দেবারও কেউ ছিলো না, ছিল না তার কষ্টগুলোতে ভালোবাসার মলম লাগিয়ে দেবারও কেউ...
ধীরে ধীরে সময় গড়াল, সেকেন্ড সেমিষ্টারের শুরুতেই সবাই জেনে গেলো সমাপ্তি আর শৌভনিকের প্রেম কাহিনী৷ ক্যাম্পাসে তাদের সারাক্ষন একসাথে দেখা যেতো৷ ওরা আবার একসাথে আড্ডাও দিতো সবার সাথে৷ দূর থেকে ওদের দেখতো রিমা! নিজেকে সে আরো চুপচাপ করে ফেললো৷
নিয়মিত ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দিলো৷ পড়াশোনা ছেড়ে দিলো৷ শুধু পরীক্ষার আগে আগে ক্লাসে যেতো৷ রেজাল্ট খারাপ হয়ে গেলো৷
সেকেন্ড ইয়ার শুরু হলো এভাবেই৷ ইয়ার চেঞ্জের রেজাল্ট দেখে রিমার বাবা খুব রাগারাগি করলেন৷ রিমা তাই চেষ্টা করলো সব ভুলে পড়ায় মন দিতে ... পারলো না! এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করতো সে সমাপ্তি আর শৌভনিক কে, কিন্তু সম্ভব হয়ে উঠতো না! বারবার যেন ওরা দুজনই চোখের সামনে আসতো ঘুরে ফিরে!
এক তরফা প্রেম বড্ড বেশি ভয়ঙ্কর হয়৷ এক তরফা প্রেমের আগুনের উত্তাপও থাকে অনেক বেশি৷ সেই উত্তাপ একজন মানুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেয়..
রিমাও জ্বলে-পুড়ে একদম শেষ হয়ে গেছিলো ..
চলবে..
#ধারাবাহিক_গল্প #সুইসাইডাল_বক্স #পর্ব_৭