Tuesday, 12 November 2024

স্টিল এ প্লেস ফর ওয়ান-


 

#ভূতুড়ে_গল্প

-স্টিল এ প্লেস ফর ওয়ান-

হোটেলের রিসেপশান থেকে রুমের চাবিটা নিয়ে এলিভেটারের দিকে পা বাড়াল অয়ন। অফিসের কাজে একদিনের জন্য শিকাগো শহরে এসেছে সে, কাজ শেষ হলে আগামীকাল ফিরে যাবে টরোন্টোতে। কাল সারাদিন একটার পর একটা মিটিং এ ব্যস্ত থাকতে হবে, সে সব সারা হলেই দৌড় দেবে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। সেজন্য শিকাগো শহরটা ঘুরেফিরে দেখবার আজই যা সুযোগ।
রুমটা খুব পছন্দ হয়ে গেল অয়নের। তিনতলার রুম, রাস্তা মুখো। জানালা দিয়ে লেক মিশিগান দেখা যায়। নীল রঙের জল, উপরে নীল আকাশ। চোখ জুড়িয়ে যায় একেবারে। লেক মিশিগান এতটাই বড়ো যে সমুদ্র বলে এক-একসময় ভ্রম হয়, শুধু ঢেউ নেই, একদম শান্ত।

ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ল অয়ন। দিনের আলো থাকতে থাকতে শহরটাতে যতটা পারা যায় চক্কর দিয়ে নিতে হবে। কাল আর সময় হবে না।
শিকাগো শহরে দেখবার জিনিসের অভাব নেই। বিল্ডিং এর আর্কিটেকচার দেখেই তো একবেলা দিব্বি কাটিয়ে দেয়া যায়। একটার থেকে আরেকটা সুন্দর। বেশিরভাগ আধুনিক ডিজাইনে তৈরি, কিছু কিছু অবশ্য পুরানো ধাঁচেরও রয়েছে। এছাড়া রয়েছে মিলেনিয়াম পার্ক, রয়েছে পিয়ের বা জাহাজঘাটা। শহরের প্রাণকেন্দ্র বা ডাউনটাউনে রয়েছে ম্যাগনিফিসেন্ট মাইল--- শপিং, হোটেল, রেস্তোরা, মিউজিয়ামের এক স্বর্গরাজ্য।

একবেলার মধ্যে যতটুকু সম্ভব ঘোরাঘুরি করে রাতের খাবার খেয়ে রুমে ফিরে এল অয়ন। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে, কাল খুব ধকল যাবে।
মাঝরাতে ঝটকা দিয়ে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল অয়নের। রাস্তার আলো ঘরের মধ্যে ত্যারছাভাবে এসে পড়েছে। পাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করল কিন্তু ঘুম এলোনা। জায়গা বদল হয়েছে বলে হয় তো, ঘুমের প্রবলেম হতেই পারে। কী মনে করে বিছানা ছেড়ে জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো। এত রাতে নীচের রাস্তা পুরো ফাঁকা। রাস্তার দুধারে সারি সারি গাড়ি পার্ক করে রাখা। তারিমধ্যে হঠাৎ একটা গাড়িতে চোখ আটকে গেল ওর। গাড়িটা বহু পুরোনো আমলের ঘোড়ার গাড়ি, সামনে কোচওয়ান বসা। আশ্চর্য হয়ে গেল অয়ন। শিকাগোর মত অত্যাধুনিক শহরে এ আদ্যিকালের গাড়ি এল কোথা থেকে? এত রাতে এখানে করছেই বা কী? ভাবতে ভাবতেই কোচোয়ান মুখ তুলে সরাসরি অয়নের দিকে তাকালো। ওকে উদ্দেশ্য করে বলল
--- স্টিল এ প্লেস ফর ওয়ান/একজনের জায়গা হবে!

চমকে এক পা পিছিয়ে এল অয়ন। অজানা ভয়ের এক ঠান্ডা স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। কোচোয়ানের মুখটা ভয়ংকর, বীভৎস, অস্বাভাবিক। চোখ সরিয়ে নিল অয়ন। ঠিক তখনি খেয়াল করল ঘোড়ার গাড়িটা আসলে পুরোনো আমলের লাশবাহী গাড়ি। পাশাপাশি দুটা কফিন শোয়ানো রয়েছে তাতে। একপাশে কিছু জায়গা খালি রয়েছে, সেখানে আরেকটা কফিনের জন্য জায়গা খালি রয়েছে।
ছিটকে জানালা থেকে সরে এল অয়ন। বাকি রাত কাটালো অস্বস্তির মধ্যে, আধো ঘুম আধো জাগরণে।

পরেরদিন।
গতরাতের কথা মনে পড়তে হাসি পেয়ে গেল অয়নের। যত্তসব আজগুবী ব্যাপার। নিশ্চয় স্বপ্ন দেখেছিল সে, সেটাকে সত্যি বলে ধরে নিয়েছে। নাহলে শিকাগো শহরে মাঝরাতে পুরোনো আমলের লাশবাহী ঘোড়ার গাড়ি দেখা সম্ভব? চটপট তৈরি হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিল সে। বাকি দিনটা এত ব্যস্ততার মধ্যে গেল যে গতরাতের কথা কখন মন থেকে উধাও হয়ে গেল, নিজেও টের পেলনা।
বিকেল চারটের দিকে কাজকর্ম চুকে গেল। এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে। এলিভেটর ধরার জন্য ল্যান্ডিং এ এসে অপেক্ষা করতে লাগল সে। এ অফিসটা তেরোতলায়। এলিভেটর আসতে বেশ খানিকটা সময় নিল। অপেক্ষা করে করে যখন ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে যাবে, ঠিক তখনি পিং শব্দে এলিভেটরের দরজাটা খুলে গেল। কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে যা হয়। এলিভেটরে গিজগিজ করছে মানুষ। এতো ঠাসাঠাসির মধ্যে ঢুকবে কী ঢুকবে না যখন ভাবছে, ভীড়ের পিছন থেকে একজনের গলার আওয়াজে চমকে উঠল অয়ন
--- স্টিল এ প্লেস ফর ওয়ান, ইউ ক্যান কাম ইন!

গতরাতের সেই কোচওয়ান। ভয়ংকর, বীভৎস, অস্বাভাবিক তার চেহারা। অয়নকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলি বলেছে সে।
অজানা অস্বস্তি আর ভয় নিয়ে অয়ন বলে ফেলল
--- ই..ইউ গাইজ গো এহেড। আই উইল টেক দা নেক্সট এলিভেটর।

---অ্যাস ইউ উইশ মাই সান..
পিং শব্দে এলিভেটরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছতে লাগলো অয়ন, পরের মুহূর্তেই বন্ধ এলিভেটর থেকে মর্মান্তিক আর্তনাদ ভেসে এল। কেবল ছিঁড়ে, প্রচন্ড গতিতে এলিভেটর একতলায় গিয়ে আছড়ে পড়ল, খুব সম্ভবত কেউ-ই আর বেঁচে নেই।

[বিঃদ্রঃ - এটা আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় লোকমুখে প্রচলিত একটি জনপ্রিয় গল্প। ধারণা করা হয় যে এর উৎপত্তি আয়ারল্যান্ডে, একটি সত্য ঘটনার উপরে ভিত্তি করে। জনপ্রিয় গল্পটির ভাবানুবাদ করলাম বাঙালী পটভূমিকায়।]

#ভুত #গল্প #ভয়

Saturday, 9 December 2023

মাঝরাতের আতঙ্ক!..

 


কর্মসূত্রে প্রত্যেক ছ'মাস অন্তর বদলি অর্থাৎ জায়গার পরিবর্তন করতে হয়। দেশের নতুন নতুন স্থানে গিয়ে অফিসের অ্যাকোমোডেশন নয়তো ভাড়া বাড়িতেই উঠতে হয়, এবার অনেকের মতে কোনো বাড়ি দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে থাকলে নাকি সেখানে খারাপ কিছু এসে থাকা আরম্ভ করে। আজকাল এসব বিশ্বাস করার সময় আর হয়ে ওঠে না। আমিও এসব বিশ্বাস করতাম না, যদি না আমার সাথে সেরকম কিছু ঘটত; 

অফিসের কাছাকাছি হওয়ায় সেই পরিত্যক্ত বাড়িটা আমাকে ভাড়া নিতে না হতো। 


আমার বাড়িটা বেশ পছন্দ হয়েছিল স্বল্প বসতির এলাকায় হওয়ার জন্য; খালি ছোট ছোট ঘর-বাড়ি, পাহাড় আর বিভিন্ন জংলা গাছপালা আর খোলা আকাশের সমাবেশ, আমায় সেই ছোটবেলার মতো টেনে নিয়ে যায় হিমালয়ের কোলে। তবে পাহাড় বলতে অতো উঁচু উঁচু পাহাড় না হলেও ছোট টিলা বা ডুংগার বলা ভালো..

যাই হোক, ঘরে ওঠার কয়েক দিনের ভেতরেই সব গোছগাছ করে নিলাম। একা থাকি, নির্ঝঞ্ঝাট সব কিছু। সারাদিন অফিসে কাটিয়ে রাতটা খালি কাটাতে বাড়িতে আসা.. সপ্তাহ খানিক স্বাভাবিক ভাবেই কাটলো। এরপর এক রাতে রোজকার মতো অফিস থেকে ফিরে সব কাজ শেষ করে দরজা-জানলা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, এবার রাতে জানলায় আচমকা টোকা পড়ার শব্দে আমার ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল।


পাহাড়ের অঞ্চলে রাত ১০টা মানেই শুনশান, সেখানে ঘড়িতে দেখলাম রাত ১২ টা ২০। ঘরের একমাত্র জানলাটা আমার খাটের সঙ্গে প্রায় লাগোয়া, ঘরের দরজার মুখোমুখি উল্টো পাশে। কে যেন ডাকছে ঘরের পেছন থেকে! যদ্দুর দেখেছি, জানলার ওপাশে মানুষহীন পরিত্যক্ত বাড়িটা ছাড়া আর কোনো ঘর নেই। একরাশ বিরক্তি নিয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে রইলাম। টোকার শব্দ বদলে এবার কারো জোরে জোরে ধাক্কা দেওয়ার কারণে জানলাটা ঝনঝন করে কেঁপে উঠল। অতি প্রয়োজনের তাগিদে কেউ যেন জানলা খুলতে আবেদন করছে। আচমকা, অপ্রত্যাশিত এই ঝনঝন শব্দে বুকটা কেঁপে উঠল। ওপাশে যেই থাকুক না কেন, বেশ অধৈর্য পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, ক্রমাগত ঝনঝন করে কেঁপেই চলেছে জানলাটা। জানলা খোলার আগে আমি গলার আওয়াজ কিছুটা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কে ভাই?' সঙ্গে সঙ্গে জানলার কম্পন থেমে গেল। ক'য়েক মুহূর্ত কেটে গেল। কোনো সাড়া-শব্দও নেই। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, 'হ্যালো.. কে ওখানে, কী চাই?' আমি জানলা খুলবো কি খুলবো না ভাবছি এমন সময় আমার বুক কাঁপিয়ে দিয়ে আবার ঝনঝন করে কাঁপতে লাগলো জানলাটা। খুব জরুরী প্রয়োজন ছাড়া এমন করে এত রাতে কেউ ডাকবে না! আমি বিছানা থেকেই জানলার তিনটে পার্টের মাঝখানেরটা ধিরে ধিরে খুলতে গেলাম, উৎসুক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকালাম।


কিন্তু..


কেউ নেই জানলার সামনে। আশ্চর্য্য! 

এর মানে কী! বালিশের পাশ থেকে টর্চটা তুলে হাত বাইরে বের করে আলো এদিক সেদিক ঘোরালাম, সত্যিই কেউ নেই! জানলাটা বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়লাম। বড়ো জোর দশ-পনেরো মিনিট কেটেছে বোধ হয়, চোখ পুরোপুরি লাগেনি। আবার জানলায় টোকার আওয়াজ পড়লো, পরের মুহূর্তেই ঝনঝন করে কাঁপতে লাগলো ওটা। এবার প্রচণ্ড রাগ হলো। জানলা খুলে বাইরে তাকালাম। সেই একই অবস্থা। কেউ নেই। এবার বিরক্তির পাশাপাশি রাগও অনুভব করলাম। এত রাতে কেউ রসিকতা করছে আমার সাথে! টর্চ হাতে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। মৃদু চাঁদের আলো, উঠোনের বাল্বের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে আছে চারপাশ। এই দুতলা ঘরের উল্টোমুখে বাড়িওয়ালাদের থাকার ঘর। ওদের ঘরের সব আলো বন্ধ। শুনশান একটা ভাব। আশেপাশের সব বাড়িগুলোর ও একই অবস্থা। সামনে একটা লাঠি পড়ে থাকতে দেখে কী মনে করে তা হাতে নিয়ে ঘরের পেছনের দিকে চলে এলাম। উৎসুক ভাবে এদিক-সেদিক আলো ফেলে খুঁজে দেখলাম, কিন্তু কারও অস্তিত্বই পেলাম না।


বিরক্তি নিয়ে ঘরে ফিরতে যাবো, হঠাৎ খেয়াল করলাম পাশের পরিত্যক্ত দু-তলা বাড়িটার বারান্দার লাগোয়া ঘরটায় আলো জ্বলছে। কিছুটা অবাক হলাম। কারণ যতটুকু জানি, এই বাড়িটা দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে আছে। তাছাড়া এতক্ষণের ভেতরে, বেশ কয়েকবার বাড়িটার দিকে চোখ পড়েছিল আমার; কিন্তু, আলোটা আমার চোখে পড়েনি। আমার ঘরের জানলা দিয়ে তাকালেও পুরো বাড়িটাই প্রায় দেখা যায়। তখন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ও আলোটা দেখিনি। বাড়িতে কেউ উঠেছে বোধ হয়! টর্চের আলো গেটের উপর ফেলতেই অবাক হলাম। সেই আগেকার মতোই বড় পিতলের তালাটা লাগানো আছে ছিটকিনি-তে বাইরে থেকে। ওই রুমে তালা না খুলে কেউ ঢুকতে পারবে না। কেমন যেন একটা সন্দেহ হলো।


আমি সন্তর্পণে বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলাম। বারান্দার ঘরটার একটা কাঠের জানলা বাইরের দেওয়ালের দিকে। ওটায় ধাক্কা দিয়ে জানতে চাইলাম, 'কে আছে ভেতরে?' কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম ভেতরে কারও নড়াচড়ার শব্দ শুনে। খানিক পরেই খটখট আওয়াজ করে ওটা খুলে গেল। একটা মেয়ে, উৎসুক মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার চাউনিতে কেমন অভিভূত হয়ে পড়লাম আমি। কম্পিত গলায় বললাম, 'ইয়ে মানে.. এই বাড়িতে কেউ থাকে বলে জানতাম না, আলো জ্বলছে দেখে অবাক হয়ে এখানে এলাম..!'


মেয়েটা হাসিমুখে বলল, 'আজই আমরা এলাম! কিছুক্ষণ আগে..'


'কিন্তু গেট বাইরে থেকে তালা দেওয়া যে!'


'কই?'


আমি ঘুরে বাড়ির গেটের দিকে আলো ফেলেই বিস্মিত হলাম। একটু আগেও দেখলাম বাইরে থেকে তালা দেওয়া কিন্তু এখন তালার কোনো চিহ্নই নেই! গেটটা সামান্য ফাঁক হয়েও আছে। মেয়েটার মুখ এখনো হাসি হাসি। বলল, 'এর আগের বার যখন এসেছিলাম আপনাকে তো দেখিনি! নতুন প্রতিবেশী নাকি আপনি?'


'ওই ইয়ে.. মানে ওই ঘরটায় সপ্তাহ খানেক হবে উঠেছি। আপনাকে এত রাতে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত!' অপ্রস্তুত ভাবে জবাব দিলাম।


'..জানলায় কারো ধাক্কার আওয়াজ পেয়ে বেরিয়েছিলেন বোধ হয়..!'


আমি সামান্য মানসিক ধাক্কা খেলাম। 'আপনি জানলেন কী করে?'


'আমিও যে ঝনঝন শব্দ শুনে জানলা খুলে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। আপনার জানলার পাশে একটা অদ্ভুত ছায়ার মতো কালো কিছু দেখে ভয় পেয়ে আবার জানলাটা বন্ধ করে দিয়েছি। তারপরে এই আপনি এলেন!'


অদ্ভুত এক ভয়ের শিহরণ অনুভব করলাম আমি। মেয়েটা বলল, 'এসেছেন যখন ভালোই করেছেন, একটা উপকার করে দিয়ে যাবেন, প্লিজ? একটু ভেতরে আসুন..'


এই বলে জানলাটা বন্ধ করে দিল হুট করে, আবার পরমুহূর্তেই বারান্দার আলো জ্বেলে উঠল। গেটটার অর্ধেক নিশ্ছিদ্র লোহা আর বাকি অংশ গ্রিলের হওয়ায়, বারান্দার আলো গেট ভেদ করে বাইরে আসছিল। আমি হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর প্রবেশ করলাম ভেতরে ওনার আমন্ত্রণে, ওনারই সঙ্গে..


পরিত্যাক্ত বাড়ি বলতে এটা খুব সাদা-মাটা একটা দু-তলা বাড়ি। দুটো বেডরুম পাশাপাশি। রুম থেকে বের হলেই ডান পাশে বাথরুম ঘর এবং বাম পাশে আরেকটা ছোট হল ঘর। যেই ঘরের জানলা খুলে মেয়েটা আমাকে আসতে আহ্বান করলো।


বারান্দার ঘরটিতে উঁকি মেরে দেখলাম মেয়েটি নেই। আশ্চর্য্য! ডান পাশের বেডরুমের ভেতর থেকে ডাক এলো মেয়েটির মিষ্টি আওয়াজে, 'ভেতরে আসুন!' আমি কিছুটা সংকোচ নিয়ে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। ঘরের বাল্ব বন্ধ। টর্চের আলোতে ঘরটা ভরে উঠল। আমার থেকে কয়েক হাত দূরেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা এগিয়ে এসে একটা চেয়ার ইঙ্গিত করে দেখিয়ে আমার হাতে একটা বাল্ব ধরিয়ে দিয়ে বলল, 'এটা একটু লাগিয়ে দিন না! এটার জন্যে খুবই জ্বালাতনে পড়েছি। পুরো বাড়িতে কোনো টর্চ নেই।' একুশ বাইশ বছরের একটা মেয়ে। শাড়ি পড়ে কেমন অপ্সরার মতো লাগছে তাকে। বুকের ধুকপুকানি সামান্য হলেও বেড়ে গেল।


আমি চেয়ারে উঠে বাল্বটা লাগানোর চেষ্টা করলাম। বেশ উপরে হোল্ডার হওয়াতে সামান্য বেগ পেতে হলো। কাজটা করতে করতে কৌতূহল বশত জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনি কী একা এসেছেন?' এবার আমার পুরো শরীর জমিয়ে দিয়ে একটা পুরুষালি গলা ঘর ভরে গমগম করে উঠল, 'আমরা একা কোথাও যাই না! তোরও একা অপরিচিত ঘরে ঢোকা উচিত হয়নি!' আমার হাত থেকে বাল্ব আর টর্চ দুটোই ফস্কে পড়ে গেল। আতঙ্কে শিউরে উঠে নিচে তাকালাম। টর্চটা বন্ধ হয়ে পুরো ঘর তিমিরে ডুবে গেল। তখনই মেয়েটা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখান থেকেই জ্বলজ্বলে আগুনের শিখার মতো দুটো চোখ জ্বলে উঠল। সেই শিখার আলোতে যে মুখটা দেখলাম এটা কোনো মানুষের মুখ হতে পারে না! ওটার কোনো নাক কিংবা মুখ নেই! গোল মুখটার মাঝামাঝি ফুঁড়ে বেরিয়ে আছে দুটো আগুনের শিখার চোখ। গলার সামান্য নিচে একটা ফাঁক। মনে হলো ওটাই ওর মুখ। চিৎকার করার জন্য আমার সমস্ত শরীর জুড়ে চেষ্টা করে উঠল। 


চিৎকার করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু গলা দিয়ে টুঁ শব্দটি বের হলো না। উল্টে পা ফস্কে চেয়ার থেকে মেঝেতে পড়ে গেলাম উপুড় হয়ে। অল্পের জন্য মাথাটা মেঝেতে ঠুকতে ঠুকতে ঠুকলো না। আমি ঘুরে মেয়েটার দিকে তাকালাম। ওটার চোখ থেকে বিচ্ছুরিত আলোই ওটার অবয়ব মেলে ধরলো আমার চোখের সামনে।


ওটার লোমশ সারা শরীর গিজগিজ করছে অদ্ভুত এক প্রকার সাদা পোকায়। অনেকটা কেঁচোর মতো দেখতে ওগুলো। ওগুলো এগিয়ে আসছে আমার দিকে। ভয়ে আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে, ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলাম দুটো পা-ই বেশ ভালো রকম মচকে গেছে। পালানোর কোনো উপায় নেই.. কিন্তু কী এটা! ভ্রম..!


এবার নিজের সব শক্তি খরচ করে একটা চিৎকার করলাম। নিজের মুখ থেকে বের হওয়া বিকট চিৎকার পুরো ঘরময় এমন ভাবে অনুরণন খেয়ে কেঁপে উঠল যে নিজেই চমকে উঠলাম। মেয়েটার হাত থেকে বাল্বটা নেওয়ার আগে হাতে করে আনা লাঠিটা মেঝেতে ফেলে ছিলাম। অন্ধকার হাঁতড়ে ওটার নাগাল পেলাম। অদ্ভুত প্রাণীটার শরীর ঝুঁকতে লাগলো আমার দিকে। লোমশ শরীরের আড়াল থেকে ওর দুটো হাত উন্মুক্ত হয়ে গেল আমার সামনে। লাঠিটা সজোরে এগিয়ে এনে আঘাত করলাম ওটার বুক বরাবর। ওটা অশরীরী নয়! সামান্য আর্তনাদ তুলে পিছিয়ে যেতে লাগলো ওটা পেছনে। আমি আবার চিৎকার করলাম। শরীরে সামান্য যে শক্তি ছিল তার সাথে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে হাতের উপর ভর দিয়ে মেঝে টেনে টেনে শরীরটাকে বারান্দায় এনে হাজির করলাম। বারান্দার বাল্বটাও বন্ধ হয়ে আছে। কয়েকজন মানুষের ছুটে আসার আওয়াজ পেলাম। আমার চিৎকার কাজে লেগেছে। আমার বাড়িওয়ালা সহ আশেপাশের অনেকেই গেটের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো। একসাথে কয়েকটা টর্চের আলো আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিল।


কিন্তু... 


তারা কেউ ভেতরে আসতে পারলো না। কারণ গেটটা বাইরে থেকে তালা দেওয়া। তারা বিস্মিত হয়ে বাইরে থেকে চেঁচাতে লাগলো, জানতে চাইলো কী করে আমি ভেতরে ঢুকলাম তালা না খুলে! আমাকে এমন কাহিল অবস্থায় দেখে তারাও ঘাবড়ে গেছে। অবশ্য, তারা বেশিক্ষণ লাগালো না তালাটি ভেঙে আমাকে উদ্বার করতে। কোনো জবাব দেওয়ার মতো অবস্থায় আমি ছিলাম না। চোখ দুটো বন্ধ করলাম। এক মৃত্যু আতঙ্ক আমার শরীরটাকে পুরোপুরি অবশ করে ফেলেছিল। 


পা দুটো সম্পূর্ণ ভালো হতে প্রায় মাস পেরিয়ে গেল। আমি অবশ্য ঘটনার পরের দিনই সেই ঘর, সেই এলাকা ছেড়ে ভয়েই এক প্রকার পালিয়ে এসেছিলাম। সেই বীভৎস, ভয়ঙ্কর চেহারা আর শরীরটা বা রাতের কথা যখনই মনে উদয় হতো, আমার গোটা শরীরটা কেঁপে উঠত। কত রাতে দুঃস্বপ্নে এসে যে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল ওই প্রাণীটা... কী বলব! এরপর থেকে আজ পর্যন্ত অন্ধকারের ভীতি দূর করতে পারিনি আমি, এখনো আলো জ্বেলে ঘুমাতে হয় আমাকে। 


যেই লোকগুলো সেইরাতে আমাকে উদ্ধার করেছিল তাদেরকে আমার কাহিনী বললে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেনি তখন, আবার আমিও যে কিভাবে বাড়িতে ঢুকেছিলাম সেই কিনারাও করতে পারেনি। অনেক বছর পর যখন সেই এলাকায় আবার ফিরে গিয়েছিলাম তখন জানতে পারি আমি চলে যাওয়ার পর থেকে ওই বাড়িটার উত্তরাধিকারীরা ওখানে ফিরে এসে পরিত্যক্ত বাড়িটা ভেঙে বহুতল বিল্ডিং করার আগে পর্যন্ত সেই বাড়ির আশেপাশের অনেক ঘরের লোকেরাই মাঝরাতে জানলায় টোকা বা ধাক্কানোর আওয়াজ পেয়েছিল। কেউ কেউ মাঝরাতে সেই পরিত্যক্ত বাড়ির ঘরে আলো জ্বালা অবস্থাতেও দেখেছে। কয়েকজন তো একটি রূপসী মেয়ের অবয়বও দেখেছিল খোলা জানালা দিয়ে। আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা জেনে অনেকেই আগের থেকে সতর্ক থাকায় বিপদে পড়েনি যদিও.. 


অবশ্য, আমি যা দেখেছিলাম সেরাতে, সেই দৃশ্যটা অন্য কেউই দেখেনি। আমি চাইও না ওটা আর কেউ দেখুক। চাই না, যেন কারও ঘরের জানলায় মাঝরাতে পড়ুক অন্য জগতের, অচেনা কারও টোকা..! 


(সমাপ্ত) 


#মাঝরাতের_আতঙ্ক 


লেখা: #উষস_চট্টোপাধ্যায়